ভারতের প্রায় দুই তৃতীয়ংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন দেশের মোট উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ। কৃষি ও কৃষিজীবী কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনস্থ, কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদনের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ‘ফোরকাস্টিং এগ্রিকালচারাল আউটপুট ইউসিং স্পেস, আগ্রো-মেটেওরোলোজি অ্যান্ড ল্যান্ড বেসড অবজারভেশনস (FASAL )’ নিয়মিত কার্যকর আছে। এই পদ্ধতি ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো), ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সি এবং স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার একসঙ্গে পরিকল্পনা ও তৈরি করেছেন। আর এই পরিকল্পনা ও পদ্ধতি অনুযায়ী, মৌলানাবিশ ন্যাশনাল ক্রপ ফোরকাস্টিং সেন্টার (MNCFC) নিয়মিত কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদনের পূর্বাভাস দেয়। এর মধ্যে ধান, গম, ডাল, পাট, আখ, তুলা, সরষে ইত্যাদি ফসলের সাম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ সংসদে বাজেট অধিবেশনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত ও আলোচিত হয়।
আরও পড়ুন-ভারতীয় রেলে ডিজেল ক্রয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি! অডিটে ফাঁস কেলেঙ্কারি
প্রযুক্তি ও উপগ্রহের ব্যবহার
ভারতে মহাকাশ গবেষণা শুরু হয় ১৯৬২ সাল থেকে এবং পরবর্তীকালে ১৫ অগাস্ট ১৯৬৯ গঠিত হয় ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে ইসরো। একই ছাতার তলায় বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা একত্রে উপগ্রহ সংক্রান্ত নানা কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়। বর্তমানে প্রয়োজন অনুযায়ী নানা দেশি ও বিদেশি সংস্থা, শর্তসাপেক্ষ এই উপগ্রহ প্রযুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ করছে। বিশ্বায়নের যুগে উপগ্রহ প্রযুক্তির ব্যবহার আকাশছোঁয়া। কৃষিক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও অবলোহিত বিকিরণ তরঙ্গ ব্যবহার করে বিশেষ ভাবে রিমোট সেন্সিং উপগ্রহের সাহায্য নেওয়া হয়। মোট ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ, ফসলের অবস্থা, উৎপাদন ইত্যাদির পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-বিতর্কে তিহার
দৃশ্যমান ও অবলোহিত বিকিরণ তরঙ্গ
দিনের আলোয় খালিচোখে যা দেখতে পাই অথবা সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হয় তা সবই দৃশ্যমান তরঙ্গ। সূর্যের আলো অথবা অন্য কোনও আলোর দৃশ্যমান তরঙ্গের সাহায্যে আলোকিত বস্তু আমরা দেখতে পারি বা ছবি তুলতে পারি। বিজ্ঞানের সূত্র বলছে কোনও বস্তুর তাপমাত্রা চরম শূন্যের বেশি হলেই ওই বস্তু থেকে অবলোহিত তরঙ্গের বিকিরণ হবে। এই বিকিরণ দিনরাত নির্গত হয়। আধুনিক যন্ত্রে, প্রযুক্তির সাহায্যে এই অবলোহিত তরঙ্গের মান ও তীব্রতা নির্ণয় করা যায়। যন্ত্রের নাম ইনফ্রারেড সেন্সর। এর সাহায্যে ও বিজ্ঞানভিত্তিক জটিল ধারণা প্রয়োগ (অ্যানিমেশন) করে পৃথিবীর উপরিতলের সমস্ত বস্তুর ছবি তোলা হয়। একে ইনফ্রারেড ছবি বলে। আধুনিক যুগে আবহাওয়া, কৃষিক্ষেত্র, বনসৃজন, সমুদ্রবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান, রিমোট কন্ট্রোল ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এই ইনফ্রারেড প্রযুক্তির প্রজনীয়তা অপরিসীম।
আরও পড়ুন-২৫ কোটি না দিলেই মাদক মামলা, আরিয়ানকে হুমকি, সিবিআই এফআইআরে অভিযুক্ত ওয়াংখেড়ে
রিমোট সেন্সিং কী?
আজকাল টিভি ও নানাবিধ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি চালাতে রিমোট কন্ট্রোলের ব্যবহার অনেকেরই জানা। বেশির ভাগ রিমোটের মধ্যে সুইচ অন করে ইনফ্রারেড সিগন্যাল তৈরি করা হয়। টিভি ওই সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং পছন্দমতো প্রোগ্রাম চালু হয়। সরাসরি টিভি স্পর্শ করতে হয় না। দূর থেকেই টিভি চালনা করা যাচ্ছে। এটি রিমোট সেন্সিং-এর মূল কথা। ইনফ্রারেড সেন্সর যন্ত্র দূর থেকে অবলোহিত তরঙ্গের বিকিরণ গ্রহণ করে। এই বিকিরণের কম্পাঙ্ক, তীব্রতা ইত্যাদি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পর্যালোচনা করে পদার্থটি মাটি, জল, গাছপালা, মেঘ, বালি, পাথর ইত্যাদি নির্ণয় করা যায়। এটাকে ছবি আকারে প্রকাশ করলে সেটাকে ইনফ্রারেড পিকচার বলে। এই বিকিরণের গতি আলোর গতির সমান এবং অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পার। অর্থাৎ বহুদূর থেকেও ইনফ্রারেড পিকচার নেওয়া সম্ভব। এটাই রিমোট সেন্সিং। যখন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বর্ণালী ব্যবহার করা করা হয়, তখন তাকে রেডিওমিটার বলে। সূর্য অথবা মহাজাগতিক বস্তুর তাপমাত্রা, গঠন ইত্যাদি এই সমস্ত পদ্ধিতে নির্ণয় করা হয়।
আরও পড়ুন-‘১০ বছর আটকে রাখার ফন্দি ছিল’, সেনার বিরুদ্ধে তোপ ইমরানের
রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ কী?
বস্তুত কৃত্রিম উপগ্রগুলি পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। উচ্চতা ও কক্ষপথ অনুযায়ী এদের বিভিন্ন নাম। সব উপগ্রহই বস্তুত দৃশ্যমান ক্যামেরা, ইনফ্রারেড সেন্সর, রেডিওমিটার ও ট্রান্সপন্ডার বহনে সক্ষম করেই তৈরি করা হয়। তবে সাধারণত রিমোট সেন্সিং উপগ্রহগুলির উচ্চতা পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ কিলোমিটারের কম হয়। উচ্চতা কম হওয়াতে পৃথিবী থেকে বিকীর্ণ সংকেত গ্রহণ করতে সুবিধা হয়। এগুলি মোটামুটি ১০০ মিনিটের মধ্যেই পুরো পৃথিবী ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। আর একই স্থানে পুনরায় আসতে প্রায় ১৩ দিন সময় লাগে। ভারতের নিজেস্ব অনেক রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ আছে। এগুলির নাম IRS-১, IRS-২ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-বিজেপিকে বয়কটের ডাক, পার্টি অফিসে হামলা, কুড়মিদের কুকথা দিলীপের
কীভাবে ফসলের পূর্বাভাস?
একজন অভিজ্ঞ কৃষকের কৃষিক্ষেত্রে বীজ বপন থেকে শস্য উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি অবস্থা একেবারে নখদর্পণে থাকে। তিনি তাঁর পূর্ব -অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন শস্য উৎপাদন কেমন হতে চলেছে, উন্নতি না অবনতি। কোনও বিশেষ কারণে, যেমন বিরূপ আবহাওয়া, কোনও বিশেষ কীটপতঙ্গের আক্রমণ ইত্যাদির জন্য শস্যের সজীবতার (সবুজ রঙের) পরিবর্তন হলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী নিতে হবে এবং সর্বোপরি ওই বছরের উৎপাদন কেমন হবে তা অনেক আগেই বলে দিতে পারেন। কিন্তু সারা ভারতের শস্যের পূবার্ভাস ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে দেওয়া এবং তা সময়মতো ভারতের প্রধান কৃষিমন্ত্রকে জানানো প্রায় অসম্ভব। ঠিক এই কাজটি মৌলানাবিশ ন্যাশনাল ক্রপ ফোরকাস্টিং সেন্টার (MNCFC) নিয়মিত (১৪ দিন বাদে বাদে) রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সমগ্র ভারতের ইনফ্রারেড ছবি পর্যালোচনা করে, কোথায় ফসল কেমন হতে চলেছে তার পূর্বাভাস ফলনের অনেক আগেই কৃষিমন্ত্রককে জানিয়ে দেন।