অনেকেই বলেন, একালের দাদাঠাকুর। যাঁরা নিয়মিত রবীন্দ্র সদন বা বইমেলা যান, সবাই চেনেন। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে ঘুরে হাসি মুখে বিক্রি করেন বই। মেলার ভিড়ের মধ্যে সহজেই চিনে নেওয়া যায় তাঁকে। এবারেও আছেন। স্বমহিমায়। কাঁচাপাকা দাড়ি, আটপৌরে সাজে এবং মেজাজে। তিনি সকলের অলোকদা, অলোক দত্ত।
আরও পড়ুন-সন্দেহভাজন আল-কায়দা জঙ্গি গ্রেফতার বেঙ্গালুরুতে
তাঁকে চিনি ‘কিনবেন দু-টাকায়, পড়বেন কুড়ি মিনিট, হাসবেন আধঘণ্টা’। তাঁর চলার শুরু তারও কয়েক বছর আগে। তখন তিনি জড়িয়ে ছিলেন একটি পত্রিকার সঙ্গে। লিখতেন না, শুধুই আঁকতেন। ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ। আরও অনেকেই পথে নামতেন। তবে তিনিই হতেন বেস্টসেলার।
১৯৭৬। শুরু হয় কলকাতা বইমেলা। সেই বছর থেকেই মেলার মাঠে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন বই। বদলেছে মাঠ। ময়দান থেকে মিলনমেলা, অবশেষে স্থায়ী ঠিকানা, করুণাময়ী বইমেলা প্রাঙ্গণ। তিনি থেকে গেছেন একই তিমিরে। বদল এটুকুই, দাম বেড়েছে তাঁর বইয়ের। শুরুর দিকে বিক্রি করতেন আট আনা, এক টাকায়।
আরও পড়ুন-কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিচ্ছে ধনকুবের পরিবার
অলোকবাবুর সঙ্গে কথা হল। জানালেন, প্রথম বছর থেকেই নজরে পড়েছিলাম পাঠকদের। অনেকেই কাছে এসে আলাপ করেছেন, কিনেছেন বই। ধীরে ধীরে বেড়েছে পরিচিতি। সিরিয়াস সাহিত্য দিয়ে শুরু, পরবর্তী সময়ে হাস্যরসাত্মক বিষয়কে আঁকড়ে ধরেছি। বুঝেছি, এটাই আমার নিজস্ব জায়গা।
লিখেছেন নিজেও। ছড়া, কবিতা, নাটক ইত্যাদি। পাশাপাশি ছড়িয়ে দেন অন্যদের বইও। আবৃত্তির পাশাপাশি দুর্দান্ত কথা বলেন। বই নিয়ে সামনে দাঁড়ালে সচরাচর কেউ ফেরাতে পারেন না। তবে আগের পরিস্থিতি এখন আর নেই। মনে করেন তিনি। মাঝেমধ্যেই ঝরে পড়ে আক্ষেপ। তবু এক মেলা থেকে অন্য মেলা স্বপ্ন ফেরি করে যান সাহিত্যের এই ফেরিওয়ালা।
আরও পড়ুন-কলেজিয়াম ব্যবস্থায় বদল নিষ্প্রয়োজন, মত দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির
আর্ট কলেজের ছাত্র। বহু বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। আঁকা শেখান। সবই পেটের প্রয়োজনে। বই ফেরি করেন নিতান্তই ভালবাসা থেকে। অসুস্থ শরীর। চিকিৎসকের নির্দেশ একপ্রকার অমান্য করেই এবার প্রায় প্রতিদিনই এসেছেন মেলায়। শুধুই কি বিক্রির জন্য? অর্থ উপার্জনের জন্য? একেবারেই না। তিনি বইমেলার পরম বন্ধু। বলেন, আসি মানুষের টানে, নতুন বইয়ের গন্ধের টানে। এগুলো বাঁচার অক্সিজেন। ভালবাসা থেকেই ছুটে যাই বিভিন্ন বইমেলায়। কেউ আমন্ত্রণ জানান, কোথাও যাই স্বেচ্ছায়। কলকাতা বইমেলার সময় ঘরে বসে থাকলেই বরং শরীর খারাপ লাগে বেশি। হয় মনখারাপ। তাই রোজ বেরিয়ে পড়ি।
আরও পড়ুন-কলেজিয়াম ব্যবস্থায় বদল নিষ্প্রয়োজন, মত দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির
সামনে-পিছনে ব্যানার ঝোলানো। তার উপর হাতে লেখা নানারকম মজার ক্যাপশন। ব্যাগে সাহিত্য সম্ভার নিয়ে তিনি ঘোরেন মেলায়। ভাব বিনিময় করেন চেনা-অচেনা ক্রেতা-পাঠকের সঙ্গে।
সত্যিই তিনি একালের দাদাঠাকুর। জড়িয়ে গেছেন মেলার ভালমন্দের সঙ্গে। তাই তাঁকে ছাড়া আজ কলকাতা বইমেলা ভাবাই যায় না।