মহাকাশে শেক্সপিয়ার

মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রায় সর্বত্রই শেক্সপিয়ারের উপস্থিতি অনুভব করা যায়; এমনকী ওই মহাশূন্যে ইউরেনাসের চতুর্দিকেও; জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেই ইউরেনাসই এখন হয়ে উঠেছে হটকেক! লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

পটভূমি
তখন ইংরেজি ইতিহাসের স্বর্ণযুগ; সেদিন ২৬ এপ্রিল, ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ; সিংহাসনে রাজ করছেন রানি প্রথম এলিজাবেথ; ইংল্যান্ডের বুক আলো করে জন্মগ্রহণ করলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার; বহুল আলোচিত এবং সমাদৃত নাট্যকার ও কবি; আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব; সক্রিয় কার্যকাল ১৫৮৫-১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ; আমরা আমাদের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সদা-সর্বত্রই শেক্সপিয়ার অর্থাৎ তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রভাব লক্ষ্য করি। অত্যাশ্চর্য, তাঁর উত্তেজক উপস্থিতি ওই অন্তরীক্ষেও খুব উজ্জ্বল; তাঁর মৃত্যুর প্রায় দেড়শো বছরেরও অধিক পরে আবিষ্কৃত গ্রহ ইউরেনাসের চতুর্দিকেও ঘূর্ণায়মান উপগ্রহের প্রায় সবগুলোর নামই শেক্সপিয়ারের তৈরি সাহিত্য-চরিত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। মহাকাশে শেক্সপিয়ারের এইরূপ উপস্থিতি কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিকদের নয়, সাধারণ আকাশপ্রেমী মানুষদেরও বিস্মিত করে।

আরও পড়ুন-‘বেছে বেছে’ বাতিল আধার কার্ড! প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর

গ্রহ পরিচিতি
আমাদের সৌরজগতের সপ্তম গ্রহটিই হল ইউরেনাস। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল এই গ্রহটিকে আবিষ্কার করেন এবং তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের নাম অনুসারে এই গ্রহটির নাম রেখেছিলেন ‘জর্জিয়াম সাইডাস’, ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ জর্জের নক্ষত্র। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাক্রমে এই গ্রহটির নামকরণ হয় গ্রিসের আকাশ-দেবতার নাম অনুযায়ী ইউরেনাস। অনেকেই মনে করেন ইউরেনাস হল ক্রোনোসের জনক, রোমান পুরাণে যাঁকে স্যাটার্ন বা শনি বলা হয়ে থাকে।
গ্রহের বৈশিষ্ট্য
এটিই সৌরজগতের তৃতীয় বৃহত্তম গ্রহ, যাকে আইস জায়ান্ট বা বরফের দানব বলা হয়ে থাকে। সৌরজগতে দুটি বরফের দানব রয়েছে, একটি ইউরেনাস এবং অপরটি স্যাটার্ন বা শনি। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি চওড়া এই গ্রহটি কক্ষপথের দিকে বিশেষ আনতির জন্য তার পাশ বরাবর ঘোরে; চতুর্দিকে ঝাপসা বলয় পরিলক্ষিত। এই গ্রহটির বহির্ভাগ পদার্থের ‘সুপারক্রিটিক্যাল’ পর্যায়ের; হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের ঠান্ডা বাতাস বয় এর বায়ুমণ্ডলে। এই গ্রহটির কেন্দ্রে জল, মিথেন, অ্যামোনিয়া, কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের দেখা মেলে; মিথেনের আধিক্যের জন্য এই গ্রহটিকে সবুজাভ-নীল রঙের দেখায়। এই গ্রহটিকে খালি চোখে দেখা সম্ভব, তবে ঘোলাটে; টেলিস্কোপ দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। অন্যান্য গ্রহের তুলনায় এর কেন্দ্রীয় তাপমাত্রা অনেক কম, প্রায় ৪৯৮২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং বহির্ভাগের তাপমাত্রা মাইনাস ২২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস; এখানেই প্রায় ৯০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে শীতল বাতাস বয়। সৌরজগতে এর ঘূর্ণনকাল মাত্র সতেরো ঘণ্টা হওয়ায় এই গ্রহের মেরু অঞ্চলে একটানা ৪২ বছর দিন এবং তারপর একটানা ৪২ বছর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন-‘বেছে বেছে’ বাতিল আধার কার্ড! প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর

শেক্সপিয়ার ও উপগ্রহ
ইউরেনাসের কাছাকাছি ঘূর্ণায়মান ১৮টি নিয়মিত উপগ্রহ এবং এর থেকে বেশ কিছু দূরের অবস্থানে ঘূর্ণায়মান ৯টি অনিয়মিত উপগ্রহ রয়েছে। মোট ২৭টি প্রাকৃতিক উপগ্রহের মধ্যে কবি আলেকজান্ডার পোপের কবিতা থেকে এরিয়েল এবং আম্ব্রিয়েল নামে দুটি উপগ্রহকে চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং বাকি ২৫টি উপগ্রহের নাম শেক্সপিয়ারের তৈরি চরিত্র ও তাঁদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রাখা হয়েছে। সেই উপগ্রহগুলো হল ওবেরন, টাইটানিয়া, মিরান্ডা, ফার্দিনান্দ, ক্যালিবান, কর্ডেলিয়া, হাউস্টন, ঈগল, ট্রাঙ্ক্যুইলিটি, পাক, প্রসপেরো, সেলিবস, ওফেলিয়া, সাইকোরাক্স, ডেসডেমোনা, পার্ডিটা, আর্ডেন, ডানসিন্যাক, হ্যামলেট, বিয়াঙ্কা, ক্রেসিডা, জুলিয়েট, রোজালিন্ড এবং বেলিন্ডা।
সাম্প্রতিক আলোড়ন
মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করতে বৈজ্ঞানিক মহলে ইউরেনাসকে নিয়ে শুরু হয়েছে জোর জল্পনা-কল্পনা। কিছুদিন আগে সেকথা আরও জোর দিয়ে জানান দিলেন ফেলো অব আমেরিকান ফিজিক্যাল স্যোসাইটি ও মিশিগান টেক ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক রবার্ট নেমিরফ এবং মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কম্পটন গামা রে অবজারভেটরির জ্যোতির্পদার্থবিদ জেরি টি বোনেল; জনসমক্ষে তুলে ধরলেন ইউরেনাসের মনোগ্রাহী ছবি ও তাঁর উপগ্রহের সঙ্গে শেক্সপিয়ারের গল্প। গবেষণার জন্য ইউরেনাসকে পর্যবেক্ষণ করতে এ-যাবৎ একটিই মাত্র অভিযান হয়েছে গোটা পৃথিবীতে— সেই ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ অগাস্ট নাসার পক্ষ থেকে ভয়েজার-২ অন্তরীক্ষ অভিযান। এই মহাকাশযানটি ইউরেনাসকে খুব কাছ থেকে দেখেছিল ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি, পৃথিবী থেকে মাত্র ৮১৫০০ কিলোমিটার দূরে; পাঠিয়েছিল বহু মূল্যবান ছবি। তার পর থেকে আর কোনও অভিযান চালানো হয়নি।

আরও পড়ুন-আর কত নীরব থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রশ্ন চন্দ্রিমার

আগামীর পরিকল্পনা
গত ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই একটিমাত্রই ইউরেনাস অভিযান; তাই ইউরেনাস ও তার প্রাকৃতিক উপগ্রহের বহু বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যের সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং তার গুরুত্বের অনুসন্ধানে নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট-এর মধ্যে তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকার ‘ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে’র প্রস্তুত করা ‘প্ল্যানেটরি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোবায়োলজি ডেকাড্যাল সার্ভে ২০২৩-২০৩২’-তে ইউরেনাস অভিযান ‘ইউরেনাস অরবিটার অ্যান্ড প্রোব মিশন’কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইউরেনাস গ্রহ বৈজ্ঞানিক সমাজের চোখে অত্যন্ত রহস্যময়ী রূপে ধরা দিয়েছে। এই গ্রহের কেন্দ্রীয় অঞ্চল স্থিতিস্থাপক প্লাজমা দিয়ে তৈরি, অথচ বাইরের কাঠামো শক্ত খোলের; বহির্ভাগের শীতল বাতাসের উৎস কিংবা বরফের গভীরতাই বা কতটুকু— সবই রহস্য! ইউরেনাস গ্রহের জলবায়ুর বিচিত্রতা, ও তার ভৌগোলিক জন্মবৃত্তান্ত; তার প্রাকৃতিক উপগ্রহগুলোর মধ্যে তাপের উৎস কী, সেখানে কি কোন মহাসাগর আছে, এ-সবই অজানা। এই গ্রহের ত্রিমাত্রিক বায়ুমণ্ডলের গঠন, চতুর্দিকে আশ্চর্য চৌম্বক ক্ষেত্রের অজানা রহস্য এবং প্রকৃত অর্থে এই গ্রহের ঘূর্ণনকাল কত, এইসব কৌতূহলই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে ইউরেনাস অভিযানকে এতটাই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে যে, নেপচুন গ্রহ অভিযান ‘এনসেলাডাস অরবিল্যান্ডারে’র আগেই এই অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।

আরও পড়ুন-কমল নাথের পর মণীশ তেওয়ারি

আগামীর অন্তরীক্ষ অভিযান
ইউরেনাস অভিযানই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক কর্মপরিকল্পনা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে। সম্ভাব্য আমেরিকার ‘কেনেডি স্পেস সেন্টার লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯এ’ থেকে ২০৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ‘ফ্যালকন হেভি এক্সপেন্ডেবল’ রকেটের মাধ্যমে এই অন্তরীক্ষ অভিযানের শুভসূচনা করা হবে। এই মহাকাশযান আনুমানিক ২০৪৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইউরেনাস গ্রহের কক্ষপথ এবং ২০৪৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডল পরিদর্শন করবে। নিসর্গবিদদের নিরলস বিজ্ঞান সাধনার উপর জোর দিয়ে আমরা হয়তো আগামী এক-দুই দশকের মধ্যে ওই গ্রহ, তার জন্মবৃত্তান্ত, সৌরজগতে তার অনবদ্য ভূমিকার কথা ও বহু অজানা রহস্যের সন্ধান পাব, যা আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও তার সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।

Latest article