‘এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য;/তবু শেষ সত্য নয়।/ কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;/তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।’ — জীবনানন্দ দাশ ; ‘সুচেতনা’
এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার মুকুটে সেরা পালক নিঃসন্দেহে সারা বিশ্বে দুর্গাপুজোর (Durga Puja) হেরিটেজ তকমা ও স্বীকৃতি। বাঙালির জন্য খুবই গর্বের খবর; ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার দুর্গাপুজোকে ইউনেস্কো intangable (অধরা) cultural heritage of humanity এর তালিকায় যুক্ত করে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্গাপুজোকে ধর্ম ও শিল্পের সর্বজনীন মিলনক্ষেত্রের সর্বোত্তম উদাহরণ হিসাবে দেখা হয়। সহযোগী শিল্পী ও ডিজাইনারদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হয়। এই উৎসব শহুরে এলাকাতে বড় আকারে পালিত হয় এবং মণ্ডপগুলির পাশাপাশি রয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাক এবং দেবীর পুজো। উৎসব চলাকালীন সব শ্রেণির মানুষ ধর্ম এবং জাতিগত বিভাজন ভেঙে দর্শকদের ভিড়ের কথা উল্লিখিত হয়েছে এবং গোটা প্রক্রিয়াই ভীষণভাবে প্রশংসিত হয়েছে ইউনেস্কোর দরবারে।
১৯৫৪ সালে ‘Economic and Political weekly’ এর একটি প্রবন্ধে ছাপা হয়েছিল দুর্গাপুজোর অর্থনীতি নিয়ে। সে বছর উত্তরবঙ্গে বন্যা আর দক্ষিণবঙ্গে খরা। সেপ্টেম্বরের মাইনে পাননি কর্মীরা। চলছে প্রতিবাদ, স্লোগান। পুজোর বোনাসের জন্য রাস্তায় চলছে আন্দোলন। এমতাবস্থায় জামাকাপড়, জুতো ইত্যাদি উপহার সামগ্রীর বিক্রি এবং ছাড়, এমনকী পুজোসংখ্যা বিক্রিকেও ধরা হয়েছিল অর্থনীতির সূচক, জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষমতার নির্দেশক আর ব্যবসায়ের প্যারামিটার।
দুর্গাপুজো বঙ্গজীবনে আমোদ-প্রমোদকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
দুর্গাপুজোর সঙ্গে বাংলার অর্থনীতি কতখানি যুক্ত? কত মানুষের রুটিরুজির সাথে যুক্ত এই উৎসব প্রক্রিয়া? মৃৎশিল্পী থেকে শুরু করে মণ্ডপসজ্জা অলঙ্কারশিল্পী ঢাকি থেকে ব্রাহ্মণ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন শিল্পী ও কলাকুশলীরা, গায়ক- গায়িকারা এই উৎসবে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে ন্যূনতম আয়ের সংস্থান করেন। এমনকী প্রতিমাকে অর্পণ করার ফুল দিয়েও ফুলচাষি ও বিক্রেতাদের অন্নসংস্থান হয়।
আরও পড়ুন: কেন্দ্র অসহযোগিতা করছে, বলল কোর্ট
দুর্গাপুজোর (Durga Puja) উৎসব ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি কীভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে তা নিয়ে ২০১৩ সালে আসচেম একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে পশ্চিবঙ্গের পুজোয় অর্থনীতির বহর হিসাবে ধরা হয়েছিল ২৫,০০০ কোটি টাকা। Associated Chambers of Commerce and Industry of India (ASSOCHAM)এর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দুর্গাপুজো অর্থনীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার নাকি ৩৫ শতাংশ। বিস্ময়কর বৃদ্ধির হার!
বাংলায় দুর্গাপুজোর অর্থনীতি নিয়ে সুসংবদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন অর্থনীতির পণ্ডিত ও শিল্পবাণিজ্য মহলের অনেকেই। আগ্রহী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। এই পুজোর সাথে বাংলার অর্থনীতি কীভাবে জড়িত তা সমীক্ষা করেছে ব্রিটিশ কাউন্সিল। ২০২১ সালে অক্টোবরে ব্রিটিশ কাউন্সিল পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজো নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিল। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দুর্গাপুজোয় সৃজনশীলতা ৩২,৩৭৭ কোটি টাকার ব্যবসা তৈরি করে। যা পশ্চিমবঙ্গের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বা জিএসডিপির ২.৫৮ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দফতর ব্রিটিশ কাউন্সিল এই গবেষণাটি করার জন্য কমিশন করে। এই সমীক্ষা চালানো হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। এই ধরনের সমীক্ষা সম্ভবত প্রথম। দুর্গাপুজোয় মূর্তি স্থাপন, নানান ধরনের ইনস্টলেশন, আলোকসজ্জা, বিভিন্ন খুচরো বিক্রয় স্পনসরশিপ বিজ্ঞাপন ইত্যাদি সমস্তকিছু আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করা হয়েছে। এর পোশাকি নাম ‘mapping the creative economy around durga puja in 2019’। তাঁদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই পুজোয় সমাজের সমস্ত অর্থ সমস্ত শিরা-ধমনী দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকায় গরিব মানুষের কাছে। তবে এটা ঘটনা যে, দেশের অর্থনীতির ক্রমাবনতির সাথে সাথে স্পনসরশিপ ও বিজ্ঞাপনের ওপর পুজোকর্তাদের নির্ভরতা চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটা ক্লাব ও বারোয়ারি ব্যতীত প্রায় সব পুজোকর্তাদের ক্ষেত্রে স্পনসরশিপ ও বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা কার্যত তলানিতে এসে ঠেকেছে। অথচ প্রতিটি ক্লাবের বারোয়ারি পুজোর খরচের প্রায় সমস্ত অর্থ সমাজের ধমনী দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকায় গরিব মানুষের কাছে।
তাই পুজোর সঙ্গে জড়িত দরিদ্র মানুষের রুটিরুজির কথা চিন্তা করে রাজ্যের এই বিরাট অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের কথা ভেবেই পুজো ও ক্লাবগুলিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বর্তমানে রাজ্যে স্বীকৃত পুজোর সংখ্যা ৪০ হাজার ৯২টি। গত দু’বছরে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কমিটিগুলিকে ৫০,০০০ টাকা। এবারে বাড়িয়ে ৬০,০০০ টাকা করা হল। এতে সম্ভাব্য খরচ ২৪০ কোটি টাকার মতো। এবারও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে গেল গেল রব উঠেছে।
অথচ বাম আমলে প্রতিবছর কোঅর্ডিনেশন কমিটির রিক্রিয়েশন ক্লাবকে অনুদান হিসাবে অর্থ দেওয়া হত। তখনও প্রতিবছর রাজ্য বাজেটের মোট খরচের যে অনুপাতে অনুদান দেওয়া হত বর্তমান সরকারের আমলে এই অনুপাত খুব বেশি বাড়েনি। পার্থক্য শুধু একটাই। তখন এই স্বার্থভোগী ছিল বামফ্রন্টের কতিপয় কোঅর্ডিনেশন কমিটির সদস্য। আর এখন এর চূড়ান্ত স্বার্থভোগী রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের বসবাসকারী খেটে খাওয়া মানুষেরা। নিন্দুকেরা সবকিছু জেনেবুঝেও ধ্বংসাত্মক সমালোচনায় মশগুল।
তাই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এই বিরাট অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের সুফল রাজ্যের কোনায় কোনায় গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবে এবং যার জন্যই রাজ্য সরকার এই ছাড় বা অনুদান ঘোষণা করেছে, যা যথার্থ। একেই তো অর্থনীতির ভাষায় ‘trickle down hypothesis’ বলা হয়।