ছকভাঙা নারী

অসীম জেদ, সাহসিকতাকে সঙ্গী করে ছকভাঙা পেশা বেছে নিয়েছেন বিশ্বের কয়েকজন নারী। এসেছে বাধা। পরোয়া করেননি। অবিচল থেকেছেন লক্ষ্যে। পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। নতুন বছরের প্রথম ‘অর্ধেক আকাশ’-এ চারজন নারীর অদম্য লড়াইয়ের কথা শোনালেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী এবং অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

সরগম কৌশল

‘হ্যালো এভরিওয়ান, আই অ্যাম সরগম কৌশল, মিসেস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড ২০২২’। এই উক্তি ২০২২-এর সদ্য জেতা মিসেস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড-এর। প্রায় দু’দশক পর আবার ভারতের কাছে ফিরে এল সৌন্দর্যের শিরোপা মিসেস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড সম্মান। ২০০১-এ এই মুকুট জিতে নিয়েছিলেন ভারতীয় মডেল, অভিনেত্রী অদিতি গোবিত্রিকর। ২১ বছর পর লস ভেগাসে আয়োজিত মিসেস ওয়ার্ল্ডের আসরে এই মুকুট আবার উঠে এল ভারতীয় সুন্দরী সরগম কৌশলের মাথায়।
৫১ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়াই করে আন্তর্জাতিক এই খেতাবটি ছিনিয়ে নিলেন সরগম। জুরিদের প্যানেলে ছিলেন সোহা আলি খান, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, বিবেক ওবেরয়, ডিজাইনার মাসুম মেওয়াওয়ালা এবং প্রাক্তন মিসেস ওয়ার্ল্ড অদিতি গোবিত্রিকর ও আরও অনেকে। সরগমের সাফল্যে তাঁকে অভিনন্দন জানান অদিতি। ৬৩টি দেশের প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে সরগম সেরার সেরা হন।

আরও পড়ুন-স্মরণে সুপ্রিয়া

কী এই মিসেস ওয়ার্ল্ড খেতাব
মিসেস ওয়ার্ল্ড খেতাবটি হল বিশ্বের বিবাহিত মহিলাদের জন্য প্রথম পরিবেশিত একটি শিরোপা। মিসেস আমেরিকা শিরোপা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৪-তে এই বিউটি পিজেন্টের পরিকল্পনা করা হয়। প্রথমে এই প্রতিযোগিতার নাম ছিল মিসেস উইমেন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। তারপর ১৯৮৮ সালে এই প্রতিযোগিতার নাম দেওয়া হয় মিসেস ওয়ার্ল্ড। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর আশিটিরও বেশি দেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে এবং সর্বাধিক শিরোপা পেয়েছে আমেরিকার প্রতিযোগী।
জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ সম্মান
২১ বছর পরে আবার ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে সরগমের হাত ধরে। গত সপ্তাহে বিমানবন্দরে পা রাখামাত্রই সরগমকে ঘিরে ছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা। তাঁর পরনে সেদিন ছিল হালকা ক্রিম ও রুপোলি রঙের লম্বা ঝলমলে গাউন।
মুম্বই এয়ারপোর্টে নেমেই প্রথম ইনস্টাগ্রামে পোস্টিয়ে ছিলেন সেই উচ্ছ্বাসের ছবি, তাতে ক্যাপশন ছিল ‘অ্যান্ড সো দ্য জার্নি বিগিন, হাই হিলস অ্যান্ড ইভিন হাইয়ার এক্সপেকটেশন’। সত্যি এক নতুন জার্নি শুরু হল মিসেস ওয়ার্ল্ডের। দেশকে জিতিয়ে আনা বড় সহজ কাজ নয়— কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে যা করে দেখালেন সরগম।

আরও পড়ুন-লক্ষ্মী-মঞ্চ

২০২২-এর জুন মাসে মিসেস ইন্ডিয়া ইনকর্পোরেটেড আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মিসেস ইন্ডিয়ার খেতাব জিতেছিলেন তিনি। এরপরে লাস ভেগাস, নেভাদাতে অনুষ্ঠিত মিসেস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ১৮ ডিসেম্বর একদিকে যখন ফুটবল-জ্বরে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব, কাতারে আর্জেটিনা বনাম ফ্রান্সের ফাইনাল ফাইট তখন অন্যদিকে চলেছিল আর-একটি লড়াই। বিশ্বকাপের রাতে ভারতের বিশ্বজয় হল সরগমের। বিভিন্ন দেশের ৬৩ জন প্রতিযোগীকে পরাজিত করেন। জেতার পর নিয়ম অনুযায়ী আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-এর মিসেস ওয়ার্ল্ড শ্যালিন ফোর্ড তাঁকে মুকুট উপহার দেন। ফাইনাল রাউন্ডে একটি সুন্দর ডিজাইনার গোলাপি সেন্টার স্লিট গ্লিটারি গাউন পরেছিলেন তিনি। এই গাউনটি ডিজাইন করেছেন ডিজাইনার ভাবনা রাও। আর কানে ছিল ক্রিস্টাল ইয়ার রিং। অপূর্ব সুন্দরী এবং আত্মবিশ্বাসী লাগছিল তাঁকে।

আরও পড়ুন-রাজ্যের ক্ষতি করছেন বিরোধী দলনেতা

কে এই সরগম কৌশল
কী পরিচয় এই ভারত-সুন্দরীর? তাহলে তাঁর সঙ্গে একটু পরিচয় করা যাক। ৩২ বছরের সরগম কৌশল জম্মু-কাশ্মীরের মেয়ে। বাবা ঘনশ্যাম কৌশল একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত চিফ ম্যানেজার এবং মা মীনা কৌশল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সরগমের বড় হয়ে ওঠার মন্ত্র মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। স্বপ্ন ছিল উঁচুতে ওড়ার। কিছু করে দেখাবার। জম্মু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সরগম কৌশল পেশায় একাধারে মডেল, চিত্রকর আবার লেখিকাও।
শৈশব থেকে যৌবনে পাড়ি
স্কুলিং জম্মুতেই। সেখানকার গান্ধীনগর প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশুনো করেছেন। তারপর জম্মুর মহিলা কলেজ থেকে এডুকেশনে স্নাতক হন। শুধু স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নয় সরকারি কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রিও নিয়েছেন তিনি। বিশাখাপত্তনমে করেছেন শিক্ষকতা। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আদিত্য মনোহর শর্মাকে বিয়ে করেন ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। বাবাই তাঁর জীবনের মূল স্তম্ভ। তাঁর জীবনের সাফল্যের জন্য বাবাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন চিরকাল। বাবাই তাঁর শিক্ষাগুরু। সরগম বলেছেন, ‘আমার বাবা বলতেন আমি সকলের চেয়ে আলাদা। তিনি সেটা আমার চোখের মধ্যে দেখতে পেতেন। তিনি বলতেন, আমি একদিন ঠিক জীবনে বড় কিছু করব। মানুষ যা পাওয়ার স্বপ্ন দেখে আমি তাই পাব। এটাই বিশ্বাস ছিল বাবার।’

আরও পড়ুন-হলদিয়া-নন্দীগ্রাম সেতু উপহার মুখ্যমন্ত্রীর

পাশাপাশি স্বামীর কথাও বলেছেন। ‘আমার সঙ্গে এক অনবদ্য মানুষের দেখা হয়েছে এবং আমরা খুব সুন্দর জীবন কাটাই। ও আমার মেরুদণ্ড।’ তাঁদের ছাড়া এই সাফল্য অসম্ভব ছিল— একথাই বারবার বলেছেন মিসেস ওয়ার্ল্ড। বিয়ের পরেই সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতায় তাঁর অংশগ্রহণ।
গুণী মেয়ে সরগম খুব ভাল কলমচিও। গ্রেটার কাশ্মীরের ওয়েবসাইটে তিনি নিয়মিত লেখেন। বছরের শুরুতে মিসেস ইন্ডিয়ার খেতাব জিতেছিলেন সরগম। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না পরবর্তীতে এই জয়ের মূল্য দিতে পারব কি না।’ তিনি পেরেছেন ভারতকে ফের গর্বিত করতে। সানিয়া মির্জা

না টেনিস প্লেয়ার তিনি নন, জেতেননি গ্র্যান্ড স্ল্যাম তবে তিনি নাম লিখিয়েছেন ভারতীয় বায়ুসেনার ইতিহাসে। তিনিও সানিয়া মির্জাই। টেনিস কোর্টের সানিয়া প্রায় এক দশক ধরে ভারতীয় টেনিস-অঙ্গনে এক নম্বরে থাকা সর্বোচ্চ রেকর্ডধারী। আর বায়ুসেনার সানিয়া এই মুহূর্তে দেশের প্রথম মুসলিম মহিলা যুদ্ধবিমান-চালক। সেই সঙ্গে তিনি উত্তরপ্রদেশেরও প্রথম মুসলিম মহিলা যুদ্ধবিমান-চালক। সত্যি এক অভূতপূর্ব সাফল্যের দাবিদার ছোট্ট গ্রামের মেয়ে সানিয়া।

আরও পড়ুন-মেঘালয়ে প্রথম দফার তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা

স্কাই ইজ দ্য লিমিট
স্কাই ইজ দ্য লিমিট— এই কথাটাই সত্যি করে দেখাতে চলেছেন সানিয়া। ইতিহাসের পাতায় উঠতে চলেছে দেশের প্রথম ফাইটার পাইলট উত্তরপ্রদেশের সানিয়া মির্জার নাম।
উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের দেহাত কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত যশোভার গ্রামের বাসিন্দা সানিয়া। ছোট্ট গ্রামের সরল, শান্ত জীবনযাপন থেকে সোজা যুদ্ধক্ষেত্র! গ্রামজীবনের ঠিক বিপরীতে আকাশের বুকে ফাইটার জেট প্লেনের চালকের আসনে তাঁর এই উত্তরণ উদাহরণীয়।
আকাশের ডাকে
টিভি মেকানিক শহিদ আলির কন্যা সানিয়া ন্যাশনাল ডিফেন্স আকাদেমি (এনডিএ)-র পরীক্ষায় সামগ্রিক ভাবে ১৪৯তম স্থান পেয়েছেন। এই পরীক্ষায় পুরুষ এবং মহিলা মিলিয়ে মোট ৪০০টি আসন ছিল। গতবছর এপ্রিল মাসে তিনি পরীক্ষায় বসেছিলেন। সেখানে মহিলাদের জন্য ছিল মাত্র ১৯টি আসন, তার মধ্যে যুদ্ধবিমান চালকদের জন্য আসন ছিল মাত্র দুটি। প্রথমবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি কিন্তু দ্বিতীয়বার সফল হন সানিয়া মির্জা। অনেক ভ্রান্ত ধারণা তাঁর এই সাফল্য ভেঙে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ইংরেজিতে কথা বললেই যোগ্য প্রার্থী হিসেবে কদর মেলে এমন ধারণা ভুল। আমি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম পরিচিত সকলেই আমাকে হিন্দি-ইংরেজিমাধ্যম নিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। বলেছিল ফোর্সে ইংরেজি জানা বাধ্যতামূলক। তবে আমি কোনও সমস্যায় পড়িনি। বিজ্ঞানে খুব আগ্রহী ছিলাম, ভেবেছিলাম ইঞ্জিনিয়ার হব।’ উত্তরপ্রদেশে হিন্দিমাধ্যম স্কুলে পড়াশুনো করা সানিয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, হিন্দিমাধ্যমে পড়া ছাত্রছাত্রীরাও যদি দৃঢ়সংকল্প হয় তাহলে সাফল্য অর্জন করতে পারে। সানিয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অবনি চতুর্বেদী আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাঁকে দেখে আমি এনডিএতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আশা করি আমি একদিন তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারব।’

আরও পড়ুন-শাশুড়ি-যশোদাবেন শেষ দেখায় বাধা মোদির পুলিশ

লক্ষ্য পাখির চোখ
মির্জাপুরের যশোভার গ্রাম থেকে ফাইটার জেটের এই সফর কঠিন হলেও লক্ষ্যে পৌঁছেছেন সানিয়া অনায়াসেই। ছোট থেকেই পড়াশুনোয় দারুণ ভাল তিনি। নিজের গ্রামের চিন্তামণি দুবে ইন্টার স্কুলে প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন সানিয়া। এরপর গ্রামে আর কোনও স্কুল না থাকায় তিনি শহরের গুরু নানক গার্লস ইন্টার কলেজে ভর্তি হন। দ্বাদশের ইউপি বোর্ডের পরীক্ষায় জেলায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছিলেন। এরপর এনডিএ পরীক্ষার জন্য সেঞ্চুরিয়ান ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে তিনি কোচিং নেন। লক্ষ্য ছিল পাখির চোখ ফাইটার পাইলট হওয়া। তাই তির সেখানেই বিদ্ধ হয়েছে নিপুণভাবে। বাবা-মা ও পরিবারের পাশাপাশি গ্রামবাসীরাও আজ তাঁকে নিয়ে গর্বিত।

আরও পড়ুন-মন্দিরের চূড়ায় ধাক্কা লেগে ভেঙে পড়ল বিমান, মৃত্যু পাইলটের

স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট

ইতিহাসের পাতায়
লড়াকু এক নারী। যিনি পালক-শরীর নিয়ে আটপৌরে নারীসুলভ কাজের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি। চেয়েছেন ছক ভাঙতে, সীমানা পেরিয়ে এমন কিছু করতে, যেখানে ছিল শুধুমাত্র পুরুষদের একছত্র অধিকার। ছোটখাটো বাধা এসেছে। সবকিছু পেরিয়ে আজ সাফল্যের কাপে চুমুক। ইতিহাসের পাতায় তুলেছেন নিজের নাম। তিনি স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট।
কী করেছেন তিনি?
কাতার বিশ্বকাপ। ১ ডিসেম্বর ২০২২। গ্রুপ ই-এর কোস্টারিকা বনাম জার্মানি ম্যাচ। প্রথম মহিলা রেফারি হিসেবে পুরুষদের বিশ্বকাপের হাইভোল্টেজ ওই ম্যাচটি খেলান স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট। এইভাবেই তিনি রচনা করেছেন নতুন ইতিহাস। তাঁর আগে কোনও মহিলা রেফারি পুরুষদের বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পাননি। ম্যাচে সহকারী হিসেবে ছিলেন আরও কয়েকজন মহিলা। তবে তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। বাঁশি মুখে ছুটেছেন সবুজ মাঠের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন দুই দলের তাবড় তাবড় পুরুষ ফুটবলাররা।
১৯ মে প্রকাশিত হয়েছিল তালিকা। কাতার বিশ্বকাপের সেই তালিকায় নিজের নাম দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট। সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, আমি যখন জানতে পারি ২০২২ বিশ্বকাপে যাচ্ছি, তখন শোনার পর প্রথম দু-তিন মিনিট নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। এটা আমার কাছে আশ্চর্যজনক একটি খবর ছিল। শুধু আমার জন্যই নয়, আমার পরিবারের জন্য এবং আমার দেশের রেফারিদের জন্যও।

আরও পড়ুন-বন্দে ভারতে সবচেয়ে বেশি পাথর ছোঁড়া হয়েছে উত্তরপ্রদেশ থেকেই

ফরাসি-কন্যা
ছবি এবং কবিতার দেশ ফ্রান্স। প্লাতিনি, জিদান, এমবাপের দেশ। এই দেশেই ১৯৮৩-র ১৪ ডিসেম্বর জন্ম স্টেফানি ফ্র্যাপার্টের। ছোট থেকেই ছিলেন ফুটবল-ভক্ত। ১৯৯৩ সালে দশ বছর বয়সে ফ্র্যাপার্ট প্রথম ফুটবল খেলা শুরু করেন। তখন নারীদের ফুটবল খেলাকে বিশেষ ল্যান্ডমার্ক হিসাবে ধরা হত। কারণ তার দুই বছর আগেই শুরু হয়েছে নারীদের বিশ্বকাপ। তবে ইউরোপে নারী চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল উইমেনস সকার লিগ ছিল না। ছিলেন না কোনও পেশাদার নারী রেফারি।
বড় সুযোগ
মহিলা রেফারি হিসেবে তিনি সামনে আসেন মোটামুটি ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে, ৩৮ বছর বয়সি স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট পুরুষদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রথম মহিলা রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ম্যাচটি জুভেন্টাস এবং ডায়নামো কিয়েভের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফ্র্যাপার্ট লিগ-১, ইউরোপা লিগ, পুরুষদের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও পরিচালনা করেছেন। এর আগে তিনি বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পুরুষদের ম্যাচে রেফারিং করেছেন। ২০১৯ মহিলা বিশ্বকাপ ফাইনালেও রেফারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পুরুষদের ফ্রেঞ্চ কাপ ফাইনালেও রেফারি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফ্র্যাপার্ট। ২০২২ বিশ্বকাপে তিনি মেক্সিকো এবং পোল্যান্ডের মধ্যে গ্রুপ সি ম্যাচে চতুর্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই প্রথম মহিলা রেফারি যিনি এইসমস্ত বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।

আরও পড়ুন-আমেরিকায় একই পরিবারের আট সদস্যের দেহ উদ্ধার

ইতিবাচক পদক্ষেপ
কাতারে ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের জন্য মোট ৩৬ জন রেফারিকে নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে ছিলেন তিনজন মহিলা রেফারি। ফ্র্যাপার্ট ছাড়াও বাকি দুজন হলেন রুয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা এবং জাপানের ইয়ামাশিতা। ৬৯ জন সহকারী রেফারিও বাছাই করা হয়। বিশ্বকাপের আগে ফিফা রেফারি কমিটির চেয়ারম্যান পিয়েরলুইগি কোলিনা বিশ্বকাপে তিনজন মহিলা রেফারি সম্পর্কে বলেছিলেন, মহিলা বলে এঁদের নির্বাচিত করা হয়নি। এঁরা নির্বাচিত হয়েছেন ফিফা রেফারি হিসাবে। এঁরা যে কোনও ম্যাচ পরিচালনা করতে পারেন। সেই যোগ্যতা অর্জন তাঁরা করেছেন।
কোস্টারিকার ম্যানেজার লুইস ফার্নান্দো সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, রেফারি হিসাবে পুরুষদের বিশ্বকাপে স্টেফানি ফ্র্যাপার্টের নিয়োগ লিঙ্গবৈষম্য মুছে ফেলার আরেকটি ধাপ। এই মহিলা যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন সেখানে পৌঁছনো খুব কঠিন। এটি ফুটবলের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
সহজ ছিল না পথ
ফ্র্যাপার্ট যখন লিগ ১-এ আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তখন তাঁকে বিবিধ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। কারণ তিনি মহিলা। ফুটবলে রেফারির ভুলের কোনও ক্ষমা নেই। সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন ফ্র্যাপার্ট। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি চাকরিতে একজন নারীকে হাজারো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। প্রমাণ দিতে হয় তাঁর কী গুণ। কিন্তু একের পর এক ম্যাচে সার্থক ভাবে রেফারির দায়িত্ব পালন করে আমার সম্পর্কে গড়পড়তার ধারণাটাই বদলে দিয়েছি। ভুল প্রমাণ করেছি সমালোচকদের।

আরও পড়ুন-প্রবল ঠান্ডায় কাঁপছে দিল্লি

কোস্টারিকা এবং জার্মানির ম্যাচ সম্পর্কে ফ্র্যাপার্ট বলেছেন, পুরুষদের বিশ্বকাপ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া ইভেন্ট। আমি ফ্রান্স এবং ইউরোপে প্রথম রেফারি ছিলাম। তাই জানি কীভাবে এর মোকাবিলা করতে হয়। এই পর্যায়ে আসার জন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনুসরণ করেতে হয়েছে পুরুষদের স্বপ্ন। কারণ আমার চারপাশের অনেক মানুষ ছিলেন। রুয়ান্ডায় একজন মহিলা বিশ্বকাপ রেফারি ছিলেন, যিনি দুবার বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন। তিনিই আমার অনুপ্রেরণা। আমি মনে করি আমার এই সাফল্য সমাজে কিছু নারীকে আরও বেশি দায়িত্ব নিতে অনুপ্রাণিত করবে।
পাখির চোখ
পুরুষদের আসরে এই নারী পেয়েছেন রানির মর্যাদা। মহিলা রেফারি হিসেবে পুরুষদের বিশ্বকাপের ম্যাচ পরিচালনা করে নাম তুলেছেন ইতিহাসের পাতায়। এবার হয়তো তাঁর পাখির চোখ পুরুষদের বিশ্বকাপ ফাইনাল। তাঁকে সামনে রেখে হয়তো আরও এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছেন বিশ্ববাসী! দানিয়া আকিল

আরও পড়ুন-বন্দে ভারত বিজেপির মধ্যেই তীব্র মতভেদ

ভ্রমণ যখন আশীর্বাদ
স্পিড এবং অ্যাডভেঞ্চার ছোট থেকেই পছন্দের ছিল দানিয়া আকিলের। বড়রা বলতেন, ধীর স্থির হও। কোনও কথায় কর্ণপাত করতেন না আকিল। যদিও পুরোপুরি অবাধ্য তাঁকে বলা যেত না। পালন করার চেষ্টা করতেন বড়দের অন্যান্য কথা।
কার র‍্যা লির প্রতি আকর্ষণ ছিল তীব্র। মোটর গাড়ির প্রতি তাঁর আগ্রহ দৃঢ় হয় যখন তাঁর পরিবার যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানেই তিনি হাই স্কুল এবং কলেজের পাঠ শেষ করেন। সংবাদমাধ্যমে আকিল জানান, আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে ভ্রমণ করেছি প্রচুর। সময় পেলেই ইংল্যান্ডে কার্ট ট্র্যাকগুলিতে যেতাম এবং দারুণ এনজয় করতাম।
সেই সময় স্বপ্ন দেখতেন একদিন নিজেও অংশ নেবেন রোমহর্ষক গাড়ি-দৌড়ে। একটু বড় হওয়ার পর শুরু করেন প্রস্তুতি। সৌদি আরবের মেয়ে তিনি। ওই দেশে মেয়েদের প্রকাশ্য গাড়ি চালানোর অনুমতি মিলেছিল ২০১৮ সালে।

আরও পড়ুন-৯ জানুয়ারি থেকে তিনদিনের বৈঠকে প্রাধান্য পাবে বিশ্ব অর্থনীতি, ব্যাঙ্কিং সিস্টেম, জি-২০ অতিথিদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত মহানগরী

প্রকাশ্য রাস্তায়
তবে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সময় কাটানোর সুবাদে আকিল প্রকাশ্য রাস্তায় গাড়ি চালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। কম বয়সেই পেয়েছিলেন মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স। পাঁই-পাঁই করে গাড়ি ছোটাতেন আকিল। পিছনে ফেলে দিতেন সবাইকে। অবাক হতেন অন্যরা। সংযত হতে বলতেন। কিন্তু আকিলের মনে তখন শুধুই স্পিড আর স্পিড। বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ছোটাতেন। চালিয়েছেন দু চাকার বাইকও। সঙ্গে থাকতেন বন্ধু এবং পরিবারের ভাই-বোনেরা। তাঁরা তাঁকে উৎসাহ দিতেন। এই অভ্যেস তাঁকে রেসিং জগতের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
হাল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর আকিল দুবাই চলে আসেন। কিছুদিন পর দুবাই অটোড্রোমো রেসট্র্যাকে নেমে পড়েন। এই বিষয়ে তিনি বলেন, বুঝতে পারছিলাম আমি সত্যিই খেলাধুলো ভালবাসি এবং ভাল সময় কাটাচ্ছি। কিছু রেসার আমাকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে, জাতীয় সিরিজে রেসে নামার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। তাঁদের কথা শুনে আমি রেসিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিই এবং পরীক্ষায় সফল হয়ে সৌদি মোটর স্পোর্টস ফেডারেশন থেকে লাইসেন্স পাই। এইভাবেই আমি দৌড় শুরু করি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি। বাহরিনে একটি 600cc সুপারস্টক মিটিংয়ে অংশ নেন ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা আকিল। দৌড়ের সময় বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং পড়ে যান। নিচের দিকে গুরুতর আঘাত পান।

আরও পড়ুন-পুণ্যার্থীদের জন্য বড় খবর, এক টিকিটেই গঙ্গাসাগর

ডাকার র‍্যালি
সেই সময়ে, কোভিড অতিমারি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ঘোষিত হয় লকডাউন। সেই সময় আকিল সুস্থ হওয়ার জন্য জেদ্দায় নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন।
বিশ্রাম নেওয়ার সময় তিনি অফ-রোড এবং র‍্যা লি রেসিংয়ের আবেদন করেন। সৌদি আরব প্রথমবারের মতো ডাকার র‍্যা লিতে স্বাগত জানায়। এই প্রসঙ্গে আখিল বলেন, আমন্ত্রণ পেয়ে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। সামনে ভেসে উঠেছিল আগামী দিনে ঘটতে থাকা মুহূর্তগুলো। সারা পৃথিবী থেকে আসা কত মানুষ। তাঁদের মধ্যে আমিও। আমার জন্য অপেক্ষা করছে অসাধারণ মজার মুহূর্ত।
অন্যতম কঠিন গাড়ি-দৌড় প্রতিযোগিতা ডাকার র‍্যা লি। বিশ্বের দীর্ঘতম। আকিল বলেন, আমি চেয়েছিলাম বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন ভূখণ্ডের মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে। ডাকার সেই সুযোগ দেয়। আমি ভাগ্যবতী।
২০২২-এর ডাকারে তাঁর প্রথম প্রচেষ্টায় আকিল অষ্টম স্থান অর্জন করেছিলেন, তবে এটি আরও ভাল হতে পারত। আকিল বলেন, ষষ্ঠ পজিশনে ছিলাম। কিন্তু সপ্তম দিনে আমার টার্বোতে সমস্যা দেখা দেয় এবং গাড়ির শক্তি কিছুটা কম ছিল। আমি ব্রেক কম ব্যবহার করতে শুরু করি এবং বাঁক দিয়ে ভরবেগ বহন করতে শুরু করি। নিয়ে ফেলি সাংঘাতিক ঝুঁকি। আমার সহ-চালক আমাকে সংযত হতে বলেন। সতর্ক করেন। কিন্তু আমি তাঁর কথা শুনিনি। একটা সময় পাথরে ধাক্কা মারার ফলে আমার গাড়ির সামনের অংশ ভেঙে যায়। এই ভুলের জন্য অনেকটা সময় আমার নষ্ট হয়।

আরও পড়ুন-ফের বৌবাজারে ভেঙে পড়ল পুরনো বাড়ির একাংশ

২০২৩-এর রেসে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই সৌদি নারীর একজন আকিল। ৭৯০ প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র ৩১ জন নারীর একজন।
বিশ্বকাপের সাফল্য
আকিল ক্রস কান্ট্রি বাজাসের হয়ে FIA বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। জয়ী হন। অর্জন করেন অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, আমি যখন ক্রস-কান্ট্রি বাজাস বিশ্বকাপে গিয়েছিলাম, তখন মধ্যপ্রাচ্যে দুটি রাউন্ড এবং ইউরোপে তিনটি রাউন্ড করেছি। সেই জায়গাগুলো গাড়ি চালানো ছিল খুব কষ্টকর। প্রত্যেকটিই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গাড়ি চালানোর উপায়৷ ইতালিতে পথ কর্দমাক্ত ছিল। হাঙ্গেরিতে ছিল প্রচুর নুড়ি এবং জল। মধ্যপ্রাচ্যের পথে ছিল পাথুরে অংশ, বালি, টিলা। এইভাবে মুখোমুখি হয়েছি বৈচিত্র্যের। অর্জন করেছি বিরল অভিজ্ঞতা। এই কঠিন পথ আমার মনকে শক্ত করেছে। কারণ জানি, এই ক্ষেত্রে যে কোনও সময় যা কিছু ঘটে যেতে পারে।
আগামীর লক্ষ্য
এই মুহূর্তে দানিয়া আকিলের বয়স ৩৪। তাঁর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আরও অনেক সাফল্য পাবেন তিনি। আরও লড়াই। সৌদি আরবের মহিলাদের সামনে আজ তিনি রোল মডেল। রোল মডেল পৃথিবীর মেয়েদের কাছেও। তাঁকে দেখে দেশ-বিদেশের অনেক মেয়েই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন গাড়ি-দৌড়ের প্রতি। আজ আকিলের পিছনে রয়েছেন বড় বড় স্পন্সর। আশ্চর্য এই পেশা তাঁকে দিয়েছে পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি। একদিন বুক ঠুকে সাহস করে নেমে পড়েছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন শুধুমাত্র পুরুষরাই নন, এই জগতে সফল হতে পারেন একজন মহিলাও। আকিলের লক্ষ্য আরও আরও দৌড়। স্পিড, স্পিড, স্পিড। টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন সবাইকে।

Latest article