লক্ষ্মী-মঞ্চ

আবৃত্তি এবং থিয়েটার, দুই শিল্প মাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন বিজয়লক্ষ্মী বর্মন। তাঁর অভিনীত নাটক ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ পূর্ণ করল ২৫ বছর। সম্প্রতি সম্মানিত হলেন নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলায়। বিবিধ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ছোটবেলার কথা বলুন…
রংপুরে আমার জন্ম। ৫ বছর বয়স পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। খুব আবছা সেই স্মৃতি। তারপরে চলে আসি রায়গঞ্জে। ওখানেও খুব বেশিদিন থাকিনি। বছর চারেক। সেইসময় বাবা অসুস্থ হন। মা কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতায় আমরা একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। আমি ক্লাস টেনে পড়ার সময় বাবা মারা যান। মহাসংকটে পড়তে হয়। আমার ভাইরা তখন খুব ছোট। সময়টা কেটেছে লড়াই করে। কবিতার সঙ্গে এই যে আমার বন্ধুত্ব, সেটা হয়েছিল বাবার জন্যই।

আরও পড়ুন-রাজ্যের ক্ষতি করছেন বিরোধী দলনেতা

কীভাবে?
বাবা যে প্রকাশ্যে কবিতা পড়তেন, তা নয়। তবে কবিতা ভালবাসতেন। নিজে নিজেই পড়তেন। আমাদের শোনাতেন। সেই সঙ্গে আমাদের কাছেও কবিতা শুনতে চাইতেন। বলতেন কবিতা বা গল্প পাঠ করে শোনাতে। এটাই ছিল ওঁর রিক্রিয়েশন। বাবার সঙ্গেই আমার সম্পর্কটা সব থেকে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। বাবাকে হারিয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম। কবিতা পড়ার অভ্যেস, পাঠের অভ্যেস ইত্যাদি গুণগুলো বাবা আমার মধ্যে প্রোথিত করে দিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে খুব কম বয়সেই আমি দ্রুত কথনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।

আরও পড়ুন-দ্রুত শেষ হবে আবাস যোজনার কাজ

একটু মায়ের কথা জানতে চাই…
মা খুব লড়াই করে আমাদের চার ভাই-বোনকে বড় করেছেন। আমার বিয়ে দিয়েছেন। কলেজে পড়তে পড়তেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। খুব কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জীবন কেটেছে মায়ের। আগেই বলেছি, মায়ের আগ্রহে কলকাতায় আসা। তখন আমার ক্লাস সেভেন। সেই সময় থেকে এই শহরের বাসিন্দা আমি। বিয়েও হয়েছিল কলকাতায়। আমার পড়াশোনার ব্যাপারে শ্বশুরবাড়ির দারুণ আগ্রহ ছিল। ওঁদের জন্যই আমি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। করতে পেরেছি চাকরি এবং আবৃত্তি-নাটকের চর্চা।

আরও পড়ুন-৯ জানুয়ারি থেকে তিনদিনের বৈঠকে প্রাধান্য পাবে বিশ্ব অর্থনীতি, ব্যাঙ্কিং সিস্টেম, জি-২০ অতিথিদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত মহানগরী

কবিতার বীজ মনের মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন বাবা। কীভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন?
কবিতা পড়তাম। আবৃত্তি করতাম। সেই সময় যেতাম বিভিন্ন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়। পুরস্কৃত হয়েছি বহুবার। এইভাবেই চেষ্টা চালিয়ে গেছি।
কোথাও তালিম নিয়েছেন?
না। কারওর কাছে তালিম নেওয়ার সুযোগ হয়নি। বলা যায় এই ক্ষেত্রে আমি স্বশিক্ষিত। শুরুতে যেটুকু হয়েছে নিজের চেষ্টায়। তবে অনেক পরে, আটের দশকে, যাওয়ার সুযোগ হয় শাঁওলি মিত্রর কাছে। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকটির সূত্রে। তখন ওখানে অনেককিছু শেখানো হত। শেখানো হত আবৃত্তিও। শাঁওলি নিজেই শেখাতেন। ওখানেই কিন্তু আমার প্রথম ঠিকঠাক তালিম শুরু। তবে সেটা ছিল আমার আবৃত্তির জীবনে একটা ভাঙচুরের সময়। কারণ আমি নিজেকে একরকম ভাবে শিক্ষিত করেছিলাম। ভাল বা মন্দ যাই হোক, সেটা ছিল একটা ধরন। যখন সেটাকে ভেঙে অন্যরকম করতে গেলাম, দেখা দিল সমস্যা। এইভাবে কেটেছে কয়েক বছর। তারপর একদিন খুঁজে পেলাম নিজের রাস্তা। সেটা ভাল না মন্দ, ঠিক না ভুল, আজও জানি না।

আরও পড়ুন-বাংলার অগ্রগতি তুলে ধরলেন মুখ্যসচিব

থিয়েটারে এলেন কীভাবে?
বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যেতাম, এমন কয়েকজন মিলে একটা গ্রুপ তৈরি করেছিলাম। সপ্তাহে একদিন বসতাম। আলাপ-আলোচনা হত। করেছি কয়েকটা অনুষ্ঠানও। কিন্তু আমার মন চাইছিল আরও কিছু করতে। কিন্তু ঠিক কী করব, সেটা নিজের কাছে স্পষ্ট ছিল না। তখন আমি চাকরি করি। নান্দীকারের সুব্রত পাল ছিলেন আমার অগ্রজ সহকর্মী। প্রথম থেকেই ঘনিষ্ঠ আলাপ। ওঁকে বলতাম আমার ভাবনার কথা। একদিন উনিই আমাকে নিয়ে গেলেন শাঁওলি মিত্রর কাছে। তখন শাঁওলি ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। রিহার্সাল শুনলাম। খুবই ভাল লাগল। বুঝলাম, মনে মনে আমি এটারই খোঁজ করছিলাম। শাঁওলি সাদরে আমাকে দলে জায়গা দিলেন। তখন সারথির ব্যানারে হয়েছিল তিনটি শো। পরে জন্ম নেয় পঞ্চম বৈদিক। এই সংস্থার ব্যানারে মঞ্চস্থ হতে থাকে ‘নাথবতী অনাথবৎ’। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ছিলাম পঞ্চম বৈদিকে। তারপর কিছুদিন অভিনয় জগৎ থেকে প্রায় ছুটি নিয়েছিলাম। যদিও মাঝে দুই-একটা কাজ করেছি। সেগুলোও খুব উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল। কাজ করেছি বেতারেও। তারপর আবার পুরোদমে ফিরে আসি ১৯৯৭ সালে।

আরও পড়ুন-বিধাননগরে প্রকৃতি উৎসবে ফুল, পাখিদের মেলা

‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’র হাত ধরে। তাই তো?
ঠিক তাই। সুব্রতদা এবং আরও কয়েকজন আমাকে সেইসময় বলছিলেন অন্যরকম কিছু করতে। তখন নন্দনে ছিলেন অংশু শূর। ওঁর কাছে আমরা নিয়মিত যেতাম। উনি একদিন আমাকে একক অভিনয়ের পরামর্শ দেন। আমি তো বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার দ্বারা একক অভিনয় সম্ভব। সুব্রতদা সাহস জোগান। উনি কথা বলেন সেই সময়ে নান্দীকারের অভিনেতা-পরিচালক গৌতম হালদারের সঙ্গে। গৌতম বলেন জয় গোস্বামীর লেখা কাব্য-উপন্যাস ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’র কথা। লেখাটা পড়ে আমার খুব ভাল লাগে। দীর্ঘ লেখা। সম্পাদনা করেন গৌতম। যদিও দেওয়া হয়নি নাট্যরূপ। গৌতমের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় আমার অভিনীত একক নাটক ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’। ১৯৯৭-এর ২৫ অক্টোবর। কাজটি উচ্চপ্রশংসিত হয়। সম্প্রতি উদযাপিত হল প্রথম মঞ্চায়নের ২৫ বছর। মধুসূদন মঞ্চ এবং অ্যাকাডেমিতে মঞ্চস্থ হয়েছে দুটি শো। জয় গোস্বামীর বক্তব্য ছিল, ‘‘কাব্যে লেখা উপন্যাস তার ছন্দ, তার চলনের বদল, সবটা নিয়ে কবিতা-কে রাখা হয়েছে।’’ শঙ্খ ঘোষ নাটকটা দেখে বলেছিলেন, ‘‘কবিতাটা বজায় আছে।” ২৫ বছরে দুশোর মতো শো। দেশে এবং বিদেশে। বাংলাদেশ, কুয়েত, কানাডা, আমেরিকায় আমরা এই নাটক মঞ্চস্থ করেছি।

আরও পড়ুন-হলদিয়া-নন্দীগ্রাম সেতু উপহার মুখ্যমন্ত্রীর

শম্ভু মিত্রর সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কীরকম ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
তখন পঞ্চম বৈদিকে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ হচ্ছে। সেই সময় শম্ভু মিত্রকে নিয়ে একটা নাটকের পরিকল্পনা করা হয়। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং ‘কথা অমৃতসমান’-এ আমি ছিলাম জুরির দলে। প্রায় প্রতিটি রিহার্সাল এবং শোয়েই থেকেছি। শিখেছি। সমৃদ্ধ হয়েছি। শম্ভু মিত্রকে নিয়ে মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘দশচক্র’। আমি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম সেই নাটকে। বলা ভাল শাঁওলি আমাকে বেছে নিয়েছিলেন। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। শম্ভু মিত্রর সঙ্গে অভিনয়। রিহার্সালে খুব ভয় পেতাম। কথা বলতাম গলা নামিয়ে। মঞ্চে নামার আগেও ভয় পাচ্ছিলাম খুব। কিন্তু অভিনয়ের পরে পেয়েছিলাম শম্ভু মিত্রর প্রশংসা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘তোমার নামে তো লোকে ধন্যি ধন্যি করছে।” সুব্রতদা আলাদা করে বলেছিলেন, ‘‘এই কাজের ফলে থিয়েটারে একজন ভাল অভিনেত্রী এলেন।” ১৯৮৫ সালের কথা।

আরও পড়ুন-বাংলার দুয়ারে সরকারকে আজ দিল্লির বুকে কেন্দ্রীয় সম্মান, মোদি সরকারের ট্র‍্যাজেডি!

মঞ্চ এবং বেতারে আপনাকে পাওয়া গেছে। পর্দায় সেভাবে পাওয়া গেল না কেন?
ছোট পর্দায় অভিনয় করেছি। যদিও খুব কম। সুযোগ এসেছিল বড় পর্দায়। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবিতে। কিন্তু কাজটা করা হয়নি।
সম্প্রতি ৩৯তম নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলায় সম্মানিত হলেন। কেমন লাগল?
ভাল লেগেছে। পাশাপাশি কিছুটা লজ্জাও পেয়েছি। মনে হয়েছে, এই সম্মানের যোগ্য আমি নই। এক সময় নান্দীকারের জাতীয় নাট্যমেলায় অংশ নিয়েছি। মঞ্চস্থ হয়েছে ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ নাটকটিও। এবারের জাতীয় নাট্যমেলায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আমাকে আশীর্বাদ করলেন। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?

আরও পড়ুন-শাশুড়ি-যশোদাবেন শেষ দেখায় বাধা মোদির পুলিশ

প্রচুর ছাত্রছাত্রী। তাদের নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
আমাদের আবৃত্তি চর্চার দুটি সংস্থা। শিশিক্ষু এবং সঙ্কল্পিতা। ছোটদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে ভাব বিনিময় করি। প্রশিক্ষণ শব্দে আমার আপত্তি আছে। বরং এইভাবে ভাবি, আমি বড়। তাই একটু বেশি জানি। ছোটরাও জানে। আমি তাদের কিছু শেখাই। সেইসঙ্গে ছোটদের কাছেও কিছু শিখি। মোটকথা কবিতা নিয়ে থাকতে ভালবাসি। পড়তে ভালবাসি বিভিন্ন প্রজন্মের কবির কবিতা। যদিও এখন পড়াশোনার খুব একটা সময় পাই না। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কিছু অন্যরকম প্রযোজনার পরিকল্পনা রয়েছে। দেখা যাক কতটা কী করতে পারি।

Latest article