অজানাকে জানার ইচ্ছা, দুর্জয় দুর্গমকে জয় করার নেশা মানুষের চিরন্তন। তার টানেই কিছু কিছু মানুষ বদ্ধ ঘরের আগল সরিয়ে জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বেরিয়ে পড়েন দুঃসাহসিক অভিযানে। এইসব অভিযানে নারী-পুরুষ উভয় সমান কৃতিত্বের অধিকারী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো নারী পুরুষের থেকেও এগিয়ে। এমনই এক দুঃসাহসী ভারতীয় নারী হলেন সুচেতা কাদেঠানকর। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ প্রথম ভারতীয় হিসেবে তিনি গোবি মরুভূমি পার হয়েছেন।
আরও পড়ুন-পেশায় এটিএম টেকনিশিয়ান
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে জন্ম সুচেতার। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। শুধু পড়াশোনার পাশাপাশি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এর ব্যাপারে তাঁর ছিল তীব্র নেশা।
ইতিহাসে প্রথম স্থানাধিকারী হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সুচেতা। ভাল ফল করার জন্য ইউনিভার্সিটিতে পেয়েছিলেন গোল্ড মেডেলও। জার্নালিজম এবং মাসকমিউনিকেশনে দারুণ রেজাল্ট ছিল তাঁর। প্রথমজীবনে নামী সংবাদসংস্থায় কাজ করেন, ছিলেন দক্ষ স্ক্রিপ্ট রাইটারও। কাজ করেছেন আরও নামী সংস্থায়।
আরও পড়ুন-জঙ্গলমহল রক্ষা করবে মাধবীলতা
কাজের হাজার ব্যস্ততার ফাঁকে অ্যাডভেঞ্চার নেশা কিন্তু বজায় ছিল তাঁর। মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়তেন সেই টানে। ট্রেকিং করতে ভালবাসতেন। ২০০৬ সালে তিনি মানালি থেকে লে পর্যন্ত সাইকেলে করে ট্রেকিং করেছেন। মাউন্ট এভারেস্ট ও অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে ট্রেকিং করেছেন। এছাড়া সাহাদ্রি পর্বতমালাতেও বহুবার ট্রেকিং করেছেন তিনি।
এরপরেও সুচেতা ভাবতেন এমন কিছু করতে হবে যা একেবারে আলাদা। আর ঠিক এমন সময়ই একটি সুযোগও এসে যায় তাঁর কাছে। ২০১০-এর নভেম্বরে মাসে globetrooper.com নামক ওয়েবসাইটে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে সুচেতার। যার শিরোনাম ছিল ‘Gobi Crossing 2011!’. যেখানে ছিল গোবি মরুভূমি অভিযানের কথা। বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন রিপ্লে ডেভানপোর্ট।
আরও পড়ুন-নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
যিনি অসংখ্য দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য পরিচিত। আয়ারল্যান্ডের এক্সপ্লোর ফাউন্ডেশন “গোবি ক্রসিং ২০১১”-এর আয়োজন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গোলিয়ান এনজিও এডু রিলিফ-কে সাহায্য করা। আর এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন রিপ্লে ডেভানপোর্ট।
গোবি মরুভূমি হল এশিয়ার বৃহত্তম মরুভূমি এবং পৃথিবীর তৃতীয়। ‘গোবি’ শব্দটি মঙ্গোলিয়ান। এর অর্থ ‘জলহীন জায়গা।’ এর আয়তন ১২ লক্ষ ৯৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে বছরে গড়ে প্রায় ১৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মকালে এর গড় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি। কখনও কখনও তা সর্বাধিক ৮১ ডিগ্রিতেও পৌঁছে যায়। শীতকালে এর গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। এখানকার আর একটি বৈশিষ্ট্য হল চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এখানকার আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। পায়ে হেঁটে এই বিস্তীর্ণ মরুভূমি পার হওয়ার কাজটা মোটেও সহজ নয়।
বিজ্ঞাপনটি দেখে সুচেতা ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করেন। বুঝতে পারেন এই অভিযান কেবল কষ্টকরই নয়, বেশ ঝুঁকিপূর্ণও। কিন্তু আলাদা কিছু করে দেখানোর স্পৃহায় তিনি এই অভিযানে অংশ নেন। আবেদন জানানোর পর এই অভিযানের জন্য নির্বাচিত হন।
আরও পড়ুন-কমিশনের সুপারিশে অযোগ্য হেমন্ত, স্বামীর চেয়ারে কল্পনা
গোবি অভিযানের খরচ কম নয়। আমেরিকান মুদ্রায় ৭০০০ ডলারেরও বেশি। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাঁর কোম্পানি যেখানে তিনি কাজ করতেন তারা তাকে স্পনসর করে। অনুশীলন শুরু করেন সুচেতা। রিপ্লে ডেভানপোর্ট সুচেতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার পিঠে ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে। তিনটে টায়ারকে একসঙ্গে করে কোমরে বেঁধে নিয়মিত টানতে। এ-ছাড়া শারীরিক ফিটনেস বাড়ানোর জন্য যা যা করণীয় সব করতে। সুচেতার বাড়ি থেকে তাঁর অফিসের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। প্রতিদিন পিঠে ন কেজির ভারী বোঝা নিয়ে তিনি এই পথ হেঁটে যাতায়াত করা শুরু করেন। পাশাপাশি অন্যান্য অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এইভাবে প্রায় ছয় মাস কঠোর অনুশীলন শেষ করার পর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
আরও পড়ুন-সুকান্তকে পাল্টা তির ফিরহাদের, বিজেপি চালাচ্ছে সিবিআই-ইডি?
গোবি মরুভূমির যাত্রার দিন স্থির হয় ২৫ মে যা শেষ হবে ২৫ জুলাই। ৬০ দিনে তারা ১৬০০ কিমি পথ পাড়ি দেবেন। এই যাত্রার জন্য নটি দেশের তেরো জন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলের নেতা রিপ্লে ডেভানপোর্ট। যাত্রা শুরু স্থির হয় বুলগান থেকে, শেষ হবে সেনসান-এ।
অনলাইনের মাধ্যমে সামান্য পরিচয় ছাড়া দলের সদস্যরা কেউ কাউকে চিনতেন না। যাত্রা শুরুর কয়েকদিন আগে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলনবাটরে যান সুচেতা। দলের সমস্ত সদস্যরা সেখানে মিলিত হন। সেখানেই প্রথম সকলের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হয়। সেখানে কয়েকদিন কাটানোর পর বিমানে করে তারা খোভদ–এ যান। সেখান থেকে বুলগান পৌঁছান।
এই দলে ১৩ জন সদস্য ছাড়া ছিল একজন ড্রাইভার কাম মেকানিক, রাঁধুনি এবং গাইড। দলের জিনিসপত্র বহনের জন্য বারোটি ব্যাকট্রিয় উট ছিল। সেই উটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও এই দলের মধ্যে ছিলেন। দলের প্রত্যেক সদস্যকে উটের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। উটের আচরণ কেমন, তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে তাকে ওঠাতে, বসাতে হয় কিংবা হাঁটাতে হয় প্রভৃতি। উটের পিঠে ছিল ষাট দিনের খাবার, স্লিপিং ব্যাগ, ষাট লিটার জল ধরে এমন ছয় ব্যারেল জল।
আরও পড়ুন-শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে মাকে গণধর্ষণ করল বিএসএফ
অবশেষে ২৫ মে তাঁদের যাত্রা শুরু হয়। এখানে সূর্য ওঠে সকাল সাড়ে পাঁচটায় আর অস্ত যায় রাত সাড়ে নটায়। দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আটটার সময় যাত্রা শুরু হত। প্রতিদিন আট ঘন্টা করে হাঁটা। তারপর তাঁবু খাটিয়ে রাত্রে বিশ্রাম। পরের দিন আবার একই রুটিন। হাঁটার কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। উটের পিঠে জিনিসপত্র থাকলেও প্রত্যেককে পিঠে প্রায় নয় কেজি ওজনের বোঝা নিয়ে হাঁটতে হত। যার মধ্যে থাকত পাঁচ লিটার জল, কাপড়-চোপড় আর চারশো প্যাকেট ভেজা টিস্যু। গরমে হাঁটার জন্য এই টিস্যু প্রচুর পরিমাণে দরকার হত। কেননা মরুভূমিতে চান করার সুযোগ ছিল না। দীর্ঘ যাত্রাপথে একদিনও চান করেননি সুচেতা-সহ বাকি সবাই।
মরুভূমির দীর্ঘ যাত্রায় বড় শত্রু ছিল একঘেয়েমি। কেননা প্রত্যেকদিন চোখের সামনে ধূ-ধূ বালির প্রান্তর ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না। কখনওসখনও যখন মরূদ্যান চোখে পড়ত তা তাঁদের কাছে ছিল বড় প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন-চিকিৎসকের লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি, টাকা সহ পাকড়াও তিন, সফল কলকাতা পুলিশ
পাশাপাশি, আরও এক বড় শত্রু ছিল, তা হল অনন্ত নীরবতা। যা কারও মনোবল ভেঙে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বিস্তৃত বালির সমুদ্রে সারাদিন শুনশান। হাঁটার সময় নিজেদের মধ্যেও কথা হত না বললেই চলে। আবার রাত্রে যখন ক্যাম্প হত তখনও প্রায় কারও সঙ্গে কথা হত না। ডিনারের সময় সবাই একসঙ্গে জড়ো হত। খাওয়াদাওয়া সেরে আবার যে যাঁর তাঁবুতে আশ্রয় নিতেন। এই দুঃসহ নীরবতা মাঝে মাঝে গ্রাস করত সুচেতাকে। মনকে দুর্বল করে দিত মাঝেমাঝেই।
আরও পড়ুন-সুকান্তকে পাল্টা তির ফিরহাদের, বিজেপি চালাচ্ছে সিবিআই-ইডি?
যাত্রাপথে তিনদিন ফ্লুতে আক্রান্ত হন তিনি। শরীর দুর্বল হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন শারীরিক সমস্যার কারণে অভিযান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে ফিরে যায়। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল সুচেতা হার মানেন না। অভিযানের কুড়িতম দিনে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাঁর। উট থেকে জিনিস নামানোর সময় তার ঊরুতে জোর লাথি মারে। পড়ে যান সুচেতা। ঊরুতে চোট তো লাগেই, তার থেকেও বেশি আঘাত লাগে কাঁধে। যে ব্যথা শেষদিন পর্যন্ত ছিল। ওই আঘাত লাগা কাঁধেই ভারী বোঝা নিয়ে হেঁটেছেন তিনি। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়েছে কিন্তু হার মানেননি। পাশাপাশি তিনদিন মারাত্মক বালি-ঝড়ের মুখেও পড়েন তাঁরা। একবার পড়েন বৃষ্টির মধ্যে। এর মধ্যে একদিন একটি উট হারিয়ে যায়। ভাগ্য ভাল সেটি শেষপর্যন্ত ফিরে আসে। সুচেতা নিরামিষাশী হওয়ায় খাওয়া নিয়ে সমস্যায়ও পড়তে হয় তাঁকে।
আরও পড়ুন-ওয়াঘা-আটারি সীমান্তে ঘুরে সেনা জওয়ানদের স্যালুট জানালেন তৃণমূল বিধায়ক
অবশেষে ১৫ জুলাই তাঁরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছন। নির্ধারিত সময়সীমার নয় দিন আগেই গোবি মরুভূমি জয় করেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেন সুচেতা। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে গোবি মরুভূমি জয় করেন তিনি। তেরো জন যাত্রা শুরু করলেও মাত্র সাতজন অভিযান শেষ করতে পেরেছিলেন। এঁদের মধ্যে তিনজন মহিলা। এই সাতজন হলেন রিপ্লে ডেভানপোর্ট, সুচেতা, লরেন, ক্রিস্টোফার, ফারাজ, পিটার ও ইহুই। এঁদের মধ্যে ক্রিস্টোফার ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। আর সবচেয়ে বেশি বয়সি ছিলেন পিটার। আর্মিতে কাজ করা পিটারের বয়স ছিল বাহান্ন বছর। এই দলে আরও এক ভারতীয় মহিলা ছিলেন। পুনের নালন্দা জোগলকার। কিন্তু ৮০০ কিমি পথ পার হওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাই অভিযান শেষ না করে তিনি ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন-উৎসবে ব্যয় অপব্যয় নয়
অসামান্য কীর্তির জন্য ইতিমধ্যে বেশ কিছু সম্মাননা পেয়েছেন সুচেতা। পেয়েছেন ইন্ডিয়া অ্যাডভেঞ্চার বেস ইনডিউরো অ্যাওয়ার্ড, হিরাকানি অ্যাওয়ার্ড, দ্য অ্যাম্পায়ার ইন্ডিয়া ইয়ং অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড, বাজাজ অ্যালায়েঞ্জ মোস্ট ইনস্পিরেশান্যাল ওয়ার্কিং ওম্যান অ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি। লিমকা বুক অব রেকর্ডেও নাম তুলেছেন তিনি।