নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার

নারীদের সমান অধিকার নিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৪৯টি দেশের মধ্যে ভারত ১০৮ তম দেশ৷ গতকাল আমেরিকায় পালিত হয়েছে নারী সমানাধিকার দিবস। পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বব্যাপী নারীরা গড়ে পুরুষের ৭৫ ভাগ সমান অধিকার ভোগ করে। এটি বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। নারী সমানাধিকার আসলে কোনও দেশকালের সীমানায় আবদ্ধ একটি বিষয় নয়। বহুচর্চিত এই লড়াই যুগ-যুগান্তের। ভারতবর্ষে নারী-পুরুষের এই লিঙ্গবৈষম্য সর্বত্র নজরে আসে। পড়াশুনো, কর্ম, বিবাহ থেকে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে এদেশের মেয়েরা পূর্ণ স্বাধীনতা পান না। যুগ বদলেছে। সত্যি কি নারী- পুরুষ সমানাধিকার আজও ইউটোপিয়ান একটি ধারণা! বিষয়টি নিয়ে বললেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামী ব্যক্তিত্বরা। শুনলেন অংশুমান চক্রবর্তী এবং শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ধারণাটা ইউটোপিয়ান

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

নারী-পুরুষের অধিকার সমান কি না এটা অনেক পরের বিষয়। আমি খুব ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং মনে করি এই দুনিয়াতে যা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর ইচ্ছায়। আমি এটাও মনে করি নারী- পুরুষ দুটি আলাদা অর্থাৎ দু’রকম। তাঁদের প্রকৃতি, শরীর, স্বভাব সবকিছুই আলাদা। সুতরাং সমানাধিকারের প্রশ্ন তখনই ওঠে যখন দু’জন সমান হয়। আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে মানুষে মানুষে কি সমানাধিকার আছে? সেখানেই তো উচ্চ-নীচ, দুর্বল শ্রেণি, সবল শ্রেণি, ধনী, দরিদ্র রয়েছে। এই সমাজের মানুষই সমানাধিকার ভোগ করে না। এখানে স্থান বিশেষে পুরুষে ও পুরুষে সমানাধিকার নেই আবার নারীতে নারীতে সমানাধিকার নেই। এটা একটা ইউটোপিয়ান ধারণা। এটা হয় না। আমাদের প্রয়োজন একরকম নয়। একজন পুরুষের যা প্রয়োজন একজন মহিলার তা নয় আবার একজন মহিলার যা প্রয়োজন একজন পুরুষের তা নয়। দু’জনের চাহিদা আলাদা। আমি মনে করি যার যার নিজের অনুপাতে, বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি অনুযায়ী যা প্রয়োজন তার সমানাধিকার থাকা উচিত। আজকে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা দেখতে অনেক মানুষ যায় না কিন্তু পুরুষের খেলা দেখতে বহু দর্শক ভিড় করে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের ম্যাচে টিকিটের দাম বেশি হয়। দর্শকপ্রিয়তার জায়গাটা এখানে আসল। সিনেমার গল্প বেশি তৈরি হয় পুরুষকে কেন্দ্র করে। নায়কই থাকে আকর্ষণের কেন্দ্রে। তাই ছবিতে পুরুষের পারিশ্রমিক বেশি। অনেক হিরো খুব জনপ্রিয় যাকে দেখতে দর্শক সিনেমায় ছোটেন। আবার পাশাপাশি নারীকেন্দ্রিক ছবিতে যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন নারী, সেখানে তাঁর পারিশ্রমিক বেশি হয়। যে যত দর্শক আকর্ষণ করে তার দর বেশি হয়। এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে পুরুষ নারীর চেয়ে কম পারিশ্রমিক পায়। আমরা যে লিখি সেখানেও যাঁর লেখা বেশি চলে, যাঁর পাঠক বেশি তাঁর চাহিদা, বেশি টাকা বেশি, যাঁর লেখা কম চলে, তাঁর চাহিদা কম, টাকাও কম। সেটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। সুতরাং এটা নিয়ে অভিমানের কারণ নেই। শাশুড়ি-বউমার মধ্যে লড়াই বেশি তাহলে বলব নারীতে-নারীতেও তো সমানাধিকার নেই। সমানাধিকারের দাবিটা কার কাছে? সমাজের কাছে। তাহলে সেই সমাজ তো নারী এবং পুরুষ দ্বারাই গঠিত। মেয়েরা সমাজে বহু সম্মানীয় উচ্চপদে রয়েছে। মহিলা প্রসিডেন্ট রয়েছে বিশ্বে, আমাদের মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, মহিলা ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। কাজেই সমানাধিকার অবশ্যই আছে। আর যেখানে নেই সেখানে কারওরই নেই।

আরও পড়ুন-কমিশনের সুপারিশে অযোগ্য হেমন্ত, স্বামীর চেয়ারে কল্পনা

পুরুষরা নারীদের উপর নির্ভরশীল

গৌতম ঘোষ

নারীরা সৃষ্টি করে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। মা হয়। এর থেকে বড় পরিচয়, বড় সত্যি আর কিছু নেই। কিন্তু আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে চিরকাল অবহেলা করেছে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যায়, পুরুষরা যুদ্ধ করেছে, জমিদারি করেছে, রাজা হয়েছে। সেখানে নারীরা অবহেলিত থেকে গেছে। নারীকে মনে করা হয়েছে দুর্বল। কিন্তু আসলে তা নয়। সমস্ত জায়গায় নারীর একটা সাংঘাতিক ভূমিকা রয়েছে। আমরা নিজেরাও ছোটবেলা থেকে দেখেছি, মায়েদের প্রত্যয়, মমতা, বুদ্ধির কোনও তুলনাই হয় না। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারাও অসম্ভব বুদ্ধি দিয়ে পুরো পরিবারকে আগলে রাখত। বিভিন্ন সময় নারী আন্দোলন হয়েছে। তবে আমাদের সমাজে কুসংস্কার, জাতপাতের বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার কারণে বাস্তব অবস্থা খুব কঠিন হয়ে গেছে। এই মধ্যেও আমরা দেখতে পাচ্ছি সমস্ত ক্ষেত্রেই নারী জাগরণ ঘটেছে। মনে রাখতে হবে নারী-পুরুষের অধিকার সমান। যেটুকু বিভাজন আছে সেটা আমাদেরই তৈরি। নারীকে সম্মান দেওয়া বিরাট কর্তব্য বলে আমি মনে করি। সম্মান দিতে না পারলে আমাদের সমাজের ক্ষতি। আমরা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইকে পেয়েছি, মাতঙ্গিনী হাজরা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, ইন্দিরা গান্ধী, কল্পনা চাওলাকে পেয়েছি। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও একজন নারী। এঁরা তো দৃষ্টান্ত। সাধারণ নারীরাও যথেষ্ট পরিশ্রম করে। মধ্যবিত্ত সমাজে একটি পরিবারে পুরুষ এবং নারী চাকরি করলেও একজন নারীকেই বেশি পরিশ্রম করতে হয়, সংসার সামলাতে হয়। পুরুষরা বহু ক্ষেত্রেই নারীদের উপর নির্ভরশীল। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ঘটাতে হবে চেতনার বিকাশ। শ্রদ্ধা এবং সম্মান যেন নারী জাতির প্রতি থাকে, এটা আমাদের প্রত্যেকের দেখা উচিত। ‌

আরও পড়ুন-সুকান্তকে পাল্টা তির ফিরহাদের, বিজেপি চালাচ্ছে সিবিআই-ইডি?

পুরুষ মানেই সে অগ্রাধিকার পাবে

অর্পিতা ঘোষ

আমাদের সমাজটাই পিতৃতান্ত্রিক। এর ফলে একজন নারী যখন থেকে জন্মগ্রহণ করে তখন থেকেই এই বিভাজন শুরু হয়। যদি কোনও একটা ভাবনা ছোট থেকেই তার মনের মধ্যে প্রোথিত হয় তাহলে বড় হয়ে একদিন সকালে হঠাৎ করেই তার মনে হল আমি একজন পুরুষের সমান আর সে সমান হয়ে গেল তা সম্ভব নয়। বীজটাই অসমানতার পোঁতা হয়ে গেছে। সেই কারণে তো বাড়িতে পুত্রসন্তান জন্মালে বাবা মা, দাদু, ঠাকুমারা খুশি হন। সেই কারণে কন্যাসন্তান বংশধর হয় না অর্থাৎ আপনি প্রথম বিশ্ব বলুন বা তৃতীয় বিশ্ব, এই সমাজ গোড়া থেকেই পিতৃতান্ত্রিক। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বদল হবে কীভাবে! পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মানেই তাঁরা নারীদের অধিকার প্রদান করছে। সেই অধিকারটাও একজন পুরুষ বা পুরুষশাসিত সমাজ উপর থেকে দেয়। তাই আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নেবার প্রশ্ন আসে। আমরা মেয়েরা অধিকার ছিনিয়ে নিই কার কাছ থেকে? সমাজের কাছ থেকে। সমাজ তাহলে কে? সেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। তাহলে আসলে মেয়েরা সেই পুরুষের কাছ থেকেই অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে আর ভাবছে বুঝি সমানাধিকার পেয়ে গেলাম কিন্তু ওইভাবে ছিনিয়ে নেওয়া যায় কি? হাজার হাজার বছর ধরে এটাই সংস্কার যে পুরুষ মানেই সে অগ্রাধিকার পাবে, পুরুষ মানেই সে সংসার চালাবে, সমাজ শাসন করবে। আজকে যদি আমরা পুরুষতান্ত্রিক ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখব সেখানে একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর তো আলাদা সম্মান পাওয়া উচিত ছিল, তা কী হয়। পদে পদে তাঁকে বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। তখন অনেকেই বলবে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী তো কী হয়েছে, নারী-পুরুষ সমান কিন্তু সবক্ষেত্রে সেই সমানতা প্রদর্শন কি করা হয়। পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকারের প্রশ্ন পরে আসে, আমরা মেয়েরা কি নিজেদের সেই সম্মানটা দিই? মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হই বেশি। যেদিন নিজেদের সেই সম্মানটা দেব সেদিন সমানাধিকার পাব।

আরও পড়ুন-রাহুলকে বললেন শিশুসুলভ অযোগ্য, অপদার্থ, অপরিণত, কংগ্রেস ছেড়ে আজাদ গুলাম

মেয়েরা কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই

ইন্দ্রাণী হালদার

নারীদের সমানাধিকার চাইতে হবে কেন? এটাই আমার প্রশ্ন। নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই সমান অধিকার পাওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, মেয়েরা কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই। সমস্ত ফিল্ডেই নারীরা পুরুষদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। পৃথিবী এখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এই সময়ে নারী ও পুরুষের ভেদাভেদ থাকাটা ঠিক নয়। আমি একজন নারী। আমার ফিল্ডে আমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছি। সাফল্য পেয়েছি। তুলনায় কমবেশি হতেই পারে। আমার গুরুত্ব একজন পুরুষ অভিনেতার থেকে কোনও অংশে কম নয়। আর একটা কথা, এই মুহূর্তে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিটা চলছে মূলত নারীদের প্রাধান্য দিয়েই। সিরিয়াল তৈরি হচ্ছে নারীকেন্দ্রিক। পাশাপাশি বহু নারীপ্রধান সিনেমা তৈরি হচ্ছে। যাঁরা নারী-পুরুষের ভেদাভেদ করেন, আমার মনে হয় তাঁরা এখনও বহু বছর পিছিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে আমাদের রাষ্ট্রপতি একজন মহিলা, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মহিলা। এঁদের জন্য আমার গর্ব হয়। তাই নারীকে গুরুত্ব দিতে হবে। দিতে হবে যোগ্য সম্মান, সমান অধিকার। অনেক মহিলা বিয়ের পর নিজের পদবি পরিবর্তন করেন। আমি সেটা করিনি। আমি আমার পুরনো পদবি ব্যবহার করে চলেছি। তার জন্য আমার শ্বশুরবাড়ি কোনওরকম বাধা সৃষ্টি করেনি। আমার ‘কুলের আচার’ ছবিটা এই বিষয়েই। মহিলা বলে কাউকে বাধা দেওয়া বা পিছনে সরিয়ে রাখাকে আমি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি না।

আরও পড়ুন-চিকিৎসকের লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি, টাকা সহ পাকড়াও তিন, সফল কলকাতা পুলিশ

বদল আসতে এখনও দেরি

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

নন্দিতা রায় এবং আমি দু’জন একসঙ্গে সিনেমা করি, পাবলিসিটিতে নাম যায় নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদের। নন্দিতা রায়ের নাম প্রথম যায় আমার নাম তার পরে যায়। কিন্তু এন্টায়ার মিডিয়া যখনই কোনও আমাদের কোনও সিনেমার রিভিউ লেখে, বা কিছু লেখে আমাদের নিয়ে তখন শিবু-নন্দিতা বলেই লেখে। তাহলে সমানাধিকারের জায়গাটা ঠিক কী সেটা নিশ্চই বুঝিয়ে বলতে হবে না। খুব বেশিদূর যেতেই হবে না। আমাদের দিয়েই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আমি আর নন্দিতাদি যে সিনেমা করি আমাদের এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এটাই ভুলে যাচ্ছে যে বিগত এগারো বছর ধরে আমি যদি পঁচিশ শতাংশ পরিচালক হই তাহলে উনি পঁচাত্তর শতাংশ পরিচালক আমাদের যে কোনও সিনেমাতে। সেখানে দাঁড়িয়ে একের পর এক ব্লকবাস্টার দিয়েছেন নন্দিতা রায় যা বোধহয় কোনও মহিলা পরিচালক আজ অবধি দেননি এবং পাশাপাশি একের পর এক তিনি লিখছেন, তিনিই চিত্রনাট্য করেন, তিনি পরিচালনা করেন এবং তিনিই এডিট করেন একটা সিনেমা। তা সত্ত্বেও শিবপ্রসাদের নামটাই আগে আসে বারবার এবং আগে বসে সর্বত্র। এটা বলে বলে আমি নিজে ক্লান্ত হয়ে গেছি। প্রথম কথা, উনি একজন বয়োজ্যেষ্ঠ, তারপর মহিলা, সঙ্গে কৃতিত্বের জায়গাটা তো অবশ্যই রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাকেই আগে রাখা হয়। কাজেই এটা আমাদের একটা সমাজ পরিকাঠামো। সমাজই এর জন্য দায়ী। ফিল্মের উদাহরণ দিলে বলব মানুষ ধরেই নেয় ফিল্ম পরিচালনা বোধহয় একজন ছেলেই পারে, ক্যামেরাম্যান একজন ছেলেই হবে। এডিট বোধহয় একজন ছেলেই ভাল করবে সুতরাং এটা না মানুষের মনে-মননে ঢুকে গেছে।

আরও পড়ুন-শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে মাকে গণধর্ষণ করল বিএসএফ

সাংবাদিক মহল, মিডিয়া মহল এই আধুনিক প্রগতিশীল সমাজের একটা বড় অংশ তা সত্ত্বেও তারাই এটা দিনের পর দিন করে। কাজেই সমানাধিকারের কথা বলি কিন্তু আমরা কেউ কাজে সেটা করি না মুখেই বলি শুধু। বাড়ির একটা নেমপ্লেটে আগে বাড়ির পুরুষের নামটাই থাকে। আমি আমার বাড়ির নেমপ্লেটের ক্ষেত্রে যিনি করবেন তাঁকে বলে দিলাম আমার মা এবং স্ত্রীর নাম দিয়ে শেষে আমার নাম বসবে। সে যখন করে আনল দেখলাম আমার নামটাই সে প্রথমে বসিয়েছে। কাজেই এই বদলটা আসতে এখনও বহু বহু দেরি। মজ্জায় মজ্জায় যেটা ঢুকে রয়েছে তা মন থেকে বের করা খুব মুশকিল।

আরও পড়ুন-ওয়াঘা-আটারি সীমান্তে ঘুরে সেনা জওয়ানদের স্যালুট জানালেন তৃণমূল বিধায়ক

নারী-পুরুষের সমান অধিকার

বিজয়লক্ষ্মী বর্মন

আমি সারা জীবন বিশ্বাস করে এসেছি মানুষ মানে মানুষ। আমৃত্যু এটা আমি বিশ্বাস করে যাব। তাদের ভেদাভেদ কখনওই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিছু দিয়েই হয় না। প্রভেদ একটা বিষয়েই হতে পারে, মানুষ ভাল না মানুষ খারাপ। এখানে এর বাইরে অন্য কোনও ভেদ হতে পারে না। এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্ম, এক বর্ণ থেকে আরেক বর্ণ ভেদ হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। আমরা তো সকলেই পৃথিবীর মানুষ। আমরা পৃথিবীকেই নিজের দেশ এবং দেশমাতৃকা ভাবব। নারী-পুরুষের সমান অধিকার, এটা স্বীকৃত সত্য হওয়া উচিত। প্রত্যেকটা মানুষ যেন এই বিশ্বাসকে, এই সত্যকে নিজের মধ্যে লালন করে, এবং পালন করে। নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রশাসন, সুরক্ষা, ক্রীড়া, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি— সব ক্ষেত্রেই। তাই নারীদের কোনও ভাবেই অবজ্ঞা করা উচিত নয়।

আরও পড়ুন-উৎসবে ব্যয় অপব্যয় নয়

অনেক মেয়ে সমানাধিকার বোঝে না

লোপামুদ্রা মিত্র

এর ভিতরে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এদেশেই যেখানে মহিলাভিত্তিক সমাজ রয়েছে সেখানে মহিলারা কাজ করেন, পুরুষেরা বাড়িতে থাকেন। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে ওখানে নারী-পুরুষ সমান বা সেই নারীরা তাঁদের পরিবারের, সমাজের পুরুষের ঊর্ধ্বে। সেখানেও একজন পুরুষকেই ঊর্ধ্বেও রাখা হয়েছে এই বলে যে মেয়েরা সব কাজ করে পুরুষদের প্রতিপালন করতে। ওখানেও পুরুষরাই সুপ্রিম। আমাদের সাধারণ সমাজে পুরুষেরা কাজ করে মহিলারা বাড়িতে থাকলেও সেটার মধ্যে আবার যে মহিলা বাড়িতে থাকেন তাকে হীন চোখে বা অবজ্ঞার চোখেই দেখে সেই সমাজ বা তার বাড়ির পুরুষ সদস্যরাই। যদিও সব পরিবারে বা সবার মানসিকতা এক নয় তবে বেশিরভাগেরই তাই। আবার অনেক মেয়েই সমানাধিকার বোঝে না। যারা পর্দানসীন তারা আজীবন তাই থেকে যায় আবার যারা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে তারা নিজেকে পুরুষের সমান প্রমাণ করতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আমার মনে ছোট থেকেই অনেক প্রশ্ন জাগত। ভাবতাম বলি আবার চুপ করে যেতাম। আমাকে আমার বাবা-মা ছেলের মতো করে মানুষ করেছেন কারণ তাঁদের কোনও ছেলে ছিল না কিন্তু কেন? আমাকে ছেলের মতো করে কেন মানুষ করতে হল তাঁদের। কেন আমাকে মানুষের মতো করে মানুষ করলেন না তাঁরা। আমার মেয়ে চারটে ছেলের সমান এই কথাটা কেন বলেন বাবা- মায়েরা। আমি সবকিছুই পেয়েছি কোনও অভাব রাখেননি আমার বাবা- মা কিন্তু আমার বাড়ির সবক’টা ডাকনাম ছেলেদের নামে। তাঁরা আমাকে ছেলে হিসেবে ভাবতে চাইতেন। লোপামুদ্রাই একমাত্র মেয়ের নাম। কেন এমনটা করেছিলেন তাঁরা কারণ ছেলে সন্তান নিয়ে বা-মার মধ্যে অপূর্ণতা ছিল নিশ্চয়ই। আমার বাবা আমাকে গান গাইতে দিতে চাননি কেননা মেয়ে গান শিখলে বা গানের পেশায় গেলে নিরাপত্তার অভাব ঘটতে পারে। কেন? এখনও পর্যন্ত কোনও কো-মিউজিশিয়ান যিনি আর্টিস্টের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যান তিনি একজন ছেলেই হন। কোনও মেয়েকে কো-মিউজিশিয়ান হিসেবে দেখা যায় না। কারণ রাতবিরেতে ফেরার একটা ব্যাপার থাকে। এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই ভাবেন। একই পেশায় মহিলা শিল্পী একজন পুরুষ শিল্পীর চেয়ে কম পারিশ্রমিক পায়। আসলে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নেই এর থেকেই তো বোঝা যায়।

আরও পড়ুন-কেন্দ্র অসহযোগিতা করছে, বলল কোর্ট

আরও বেশি সচেতন
হতে হবে

রজতাভ দত্ত

আমাদের যে এখনও নারী-পুরুষের সমানাধিকার বিষয়ে কথা বলতে হয়, এটাই দুঃখের। মানুষ হিসেবে সবার সমান অধিকার প্রাপ্য। কিন্তু আমাদের সমাজে সমানাধিকার দেখা যায় না। কোথাও যেন বঞ্চিত করা হয় নারীদের। সারা পৃথিবী জুড়েই বিয়ের পরে নারীদের পদবি চেঞ্জ হয়ে যায়। এর মধ্যেই হয়তো একটা বঞ্চনার বীজ বুনে দেওয়া হয়। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাই নারী-পুরুষের সমানাধিকার নেই। প্রত্যেকটা সুস্থ মানুষ মনে করেন, এই বৈষম্য দূর হয়ে যাওয়া উচিত। কেউ যেন কারও ব্যাগেজ বহন না করে। সন্তানরা যেন মা-বাবার মধ্যে যেকোনও একজনের পদবি ব্যবহার করার সুযোগ পায়। আমরা পেয়েছি নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী রাষ্ট্রপতি। আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একজন নারী। বহু লড়াই করে তাঁরা এই জায়গায় পৌঁছেছেন। যদিও যাঁরা এই জায়গায় পৌঁছন, তাঁদের নারী বা পুরুষ আলাদাভাবে বিচার করা যায় না। বৈষম্যটা প্রকট হয়ে ওঠে সাধারণ জীবনে। দেখা যায় সংসারে একজন নারীকে পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। সন্তান ধারণ করতে। একটু উপরতলায় বৈষম্যটা অপেক্ষাকৃত কম চোখে পড়ে। আসলে এর পিছনে কাজ করে ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক কারণ। কবে যে এই বিভাজন দূর হবে, আমাদের জানা নেই। প্রত্যেককে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

Latest article