ছাতা ব্যাপারটা কিন্তু ভীষণ রোম্যান্টিক, ধরা যাক প্রেমিকযুগল রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, হঠাৎ করে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল আর তখন প্রেমিকা গেয়ে উঠল—
‘ছাতা ধরো হে দেওরা, হেসান সুন্দর খোঁপা আমার ভিগ গিলাই না’…। কী দারুন ব্যাপার তাই না! এছাড়া শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যখনি ভিক্টোরিয়া যান না কেন, যুগলের সঙ্গে ছাতা চোখে পড়বেই পড়বে। যেন রংবেরঙের প্রজাপতিরা ডানা মেলে বসে আছে। অবশ্য শুধু ভিক্টোরিয়াই নয়, প্রেমের শহর কলকাতার আনাচে-কানাচে চোখ রাখলেই প্রেমিকযুগলের সঙ্গে ছাতা আপনি পাবেনই পাবেন। রোদ হোক কিংবা বৃষ্টি, এক ছাতার নিচে প্রেমিকের হাত ধরে হাঁটতে ভালই লাগে। তবে শুধু প্রেমিক বা প্রেমিকারাই ছাতা নিয়ে হাঁটে, সেটা কিন্তু ঠিক না, তীব্র রোদ থেকে ত্বককে বাঁচাতে কিংবা ঝরঝর বৃষ্টির হাত থেকে একঢাল চুল রক্ষা করতে সৌন্দর্য সচেতনরাও চলার পথে ছাতাকে সঙ্গী করেন।
আরও পড়ুন-এক বাঙালি উদ্যোগপতি ও বাংলার প্রথম সাহিত্য পুরস্কার
কিন্তু যে ছাতা নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ছাতার জন্মবৃত্তান্ত কিন্তু আমাদের অনেকেরই অজানা। আজ আমরা ফিরে যাব ছাতার সেই জন্মলগ্নে।
ইতিহাস ঘেঁটে যা জানা যায়, সেটা হল, প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে মানুষের মধ্যে ছাতা ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তবে সেসময় শুধুমাত্র রোদ থেকে বাঁচার জন্যই ছাতার ব্যবহার করা হত। ছাতার ইংরেজি শব্দ হচ্ছে আমব্রেলা । আমব্রেলা শব্দটি লাতিন শব্দ আমব্রা থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ছায়া। আর ছাতা শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ টগইজা থেকে, এর অর্থও ছায়া।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় ছাতার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেসময়কার ফারাওরা ছাতা ব্যবহার করত আর সেই ছাতা তৈরি করা হত তালগাছের পাতা, পালক আর কাঠ দিয়ে। এ-ছাড়াও ২৫০০ থেকে ২৪০০ অব্দের দিকে রাজা এবং দেবতাদের জন্য চারকোনা সমতল ছাতা ব্যবহার করা হত। আর এই চারকোনা ছাতা ব্যবহারে নিদর্শন মিশরীয় চিত্রলিপি এবং মন্দির বা সমাধিতে আঁকা ছবি থেকে পাওয়া গিয়েছে।
এগারোশো খ্রিস্টপূর্বের সময় থেকে চিনারা তাদের নিজস্ব ডিজাইনের ছাতা তৈরি করতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ছাতা তৈরি করতে এরা গাছের পাতা এবং শাখা-প্রশাখা ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ছাতা তৈরি করার জন্য কাপড়, চামড়া, কাগজ, সিল্ক, পশুর হাড় ইত্যাদি ব্যবহার হতে শুরু করে। ছাতার বাঁট তৈরিতে এরা মূলত হাড় ব্যবহার করত। তবে সেই সময় চিনে ছাতার ব্যবহার করত শুধুমাত্র সমাজের অভিজাত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং মহিলারা। তখন ছাতা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। চিন দেশে অভিজাত মহিলারা সাধারণত ত্বকের সুরক্ষার জন্যই ছাতার ব্যবহার বেশি করে থাকত।
আরও পড়ুন-রজনীকান্ত সেন-এর কান্তি ওকালতি থেকে সাহিত্যকৃতী
রোদ ছাড়াও যে বৃষ্টির হাত থেকে ছাতা বাঁচাতে পারে সেটা কিন্তু চিনারাই প্রথম আবিষ্কার করেছিল। সেই সময় তারা কাগজ দিয়ে ছাতা বানিয়ে তাতে মোমের প্রলেপ দিয়ে সেটাকে বৃষ্টিরোধক করে নিত।
প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে ছাতার ব্যবহার একহাজার অব্দে শুরু হয়েছিল। তখন মহিলারা ছাতাকে মূলত ত্বকের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করত। এই সময়ই প্রথম ছাতা বন্ধ করে রাখার কৌশল আবিষ্কার হয়। বাড়ির চাকররা তার মনিবের মাথার ওপর ছাতা ধরে হাঁটত এবং ব্যবহারের পর সেটাকে বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিত। আমাদের দেশে জমিদারদের মাথায় এভাবেই ছাতা ধরার জন্য আলাদা লোক বহাল করা হত। ভারতবর্ষের ইতিহাসেও ছাতার ব্যবহার অনেক প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব তিনশো অব্দে রচিত বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে এই ছাতার ব্যবহার সম্বন্ধে জানা যায়। সেসময় রাজাদের মধ্যে রাজছত্র ব্যবহার ছিল ঐতিহ্যের অংশ। ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান সমস্ত শাসকেরাই রাজছত্রকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-‘তারাশঙ্করের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলাম’
একটা সময় চিনেও যে শুধুমাত্র অভিজাত বংশের লোকেরাই ছাতা ব্যবহার করত এটার প্রমাণ ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দেই পেয়েছিলেন পরিব্রাজক মার্কো পোলো। তিনি কুবলাই খানের দরবারে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে রাজদরবারে আঁকা অসংখ্য ছাতার ছবি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, আর সেই ছবিতে তিনি দেখেছিলেন সেনাপতির মাথায় সম্মানসূচক ছাতা মেলে ধরা হয়েছে। মনে করা হয় চিন থেকেই জাপান এবং কোরিয়ায় রাজছত্রের ব্যবহার চালু হয়েছিল। কোরিয়া এবং জাপানে কয়েকশো বছর ধরে শুধুমাত্র রাজারাই ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন, যাকে রাজছত্র বলা হত। আর এই ছাতা ছিল রাজকীয় প্রতীক। রাজছত্রের প্রচলন আফ্রিকা মহাদেশেও ছিল। আফ্রিকায় রাজকীয় ছাতা ব্যবহারের উল্লেখ পরিব্রাজক ইবন বতুতার লেখা থেকে আমরা জানতে পারি।
আরও পড়ুন-নতুন বই
আজ আমরা যে ধরনের ছাতা দেখতে পাই সেটা প্রথম তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব চারশো অব্দে। মহিলারা যেহেতু নিজের প্রসাধনী হিসেবে ছাতা বেশি ব্যবহার করত, সেহেতু অভিজাত শ্রেণির মহিলাদের পাশাপাশি সাধারণ শ্রেণির মহিলারাও ছাতার ব্যবহার করতে শুরু করে। ষোলোশো থেকে সতেরোশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছাতা প্রসাধনী থেকে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। যেহেতু তখন ছাতা শুধুমাত্র রোদ নয় বৃষ্টিতেও ব্যবহার করা যেত, সেহেতু ইউরোপিয়ানদের মধ্যেও ছাতা ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সেসময় শুধুমাত্র লন্ডন নয়, যে-সমস্ত জায়গায় বৃষ্টির প্রকোপ বেশি ছিল সে-সমস্ত জায়গাতে ছাতার ব্যবহার লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়তে থাকে। এ-সময় ছাতা সিল্কের কাপড় দিয়ে তৈরি হত এবং হ্যান্ডেলটা তিমি মাছের হাড় বা কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। বৃষ্টির জল যাতে গায়ে না পড়ে, সেইজন্যে তার ওপরে তেল ও মোমের প্রলেপ দেওয়া হত।
আরও পড়ুন-দেশের চার কোটি মানুষ করোনার প্রথম ডোজই নেয়নি, বলল কেন্দ্র
আগে শুধুমাত্র মহিলারাই ছাতার ব্যবহার করত। পুরুষরা ছাতা ব্যবহার করলে তাকে নিয়ে সবাই পরিহাস করত। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে এর কিছু পরে ইংরেজ পরিব্রাজক জোনাস হ্যানওয়ে ইংল্যান্ডের রাস্তায় প্রথম ছাতা নিয়ে বের হলে সবাই তাকে নিয়ে তুমুল হাসিঠাট্টা শুরু করে। দীর্ঘ ৩০ বছর এ-সমস্ত সহ্য করেও ছাতার ব্যবহার চালিয়ে যান আর তার পরেই সাধারণ মানুষের চোখ খুলে যায় এবং তারা বুঝতে পারে যে কেবলমাত্র ফ্যাশন নয়, নিজেকে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্যও ছাতা অত্যন্ত আবশ্যিক একটি বস্তু। এই পরিবর্তিত ধারণার ফলে ১৭০০ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলের কাছেই ছাতা প্রয়োজনীয় সঙ্গী হয়ে ওঠে।
১৮৫০ সালে ইংরেজ শিল্পপতি স্যামুয়েল ফক্স ছাতায় স্টিলের ব্যবহার শুরু করেন ফলে ছাতা আগের থেকে হালকা ও মজবুত হয়ে যায়। এহেন পরিবর্তনের পর স্যামুয়েল ফক্স গড়ে তোলেন ফক্স আমব্রেলাস লিমিটেড আর এটাই ছাতা প্রস্তুতকারী প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, যা আজও ইংল্যান্ডে অবস্থিত।
আরও পড়ুন-দেশের চার কোটি মানুষ করোনার প্রথম ডোজই নেয়নি, বলল কেন্দ্র
তবে ছাতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানেই থেমে থাকেনি। ১৯২৮ সালে হ্যান্স হপ্ট তৈরি করেন পকেট ছাতা। হপ্ট একজন সৈনিক ছিলেন, যুদ্ধেক্ষেত্রে একবার তিনি পায়ে চোট পেয়েছিলেন তখন থেকে তাঁকে লাঠি ধরে হাঁটতে হত। ছাতা আর লাঠি দুটোকে একসঙ্গে হাতে ধরে হাঁটতে তাঁর বেশ অসুবিধা হত, সেই কারণে তিনি ছাতা এমনভাবে তৈরি করেন যা অনায়াসে পকেটে করে নেওয়া যায়। তবে ছাতা উল্টোদিকে মুড়িয়ে রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন জিনান কাযিম। আর এর ফলে বৃষ্টিতে ভেজা ছাতার গায়ের জল ছাতার মধ্যেই থেকে যায়। সেসময় এটি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছিল।
১৯৬০ সাল থেকে ছাতাতে পলিয়েস্টারের কাপড়ের ব্যবহার শুরু হয় আর ছাতার ইতিহাসে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। এরপর একে একে ছাতায় এসেছে নানা ধরনের বৈচিত্র্য। এখন ছাতার কাপড়ের রং রঙিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে আঁকা থাকছে নানা ধরনের নকশা আর এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নানান প্রযুক্তিগত সুবিধা।
আরও পড়ুন-হাইওয়ে সম্প্রসারণ নিয়ে কেন্দ্রের নীতি পরিবর্তন
বর্তমানে ছাতা শুধুমাত্র রোদ বা বৃষ্টি নয়, সিনেমার রোম্যান্টিক দৃশ্যও ছাতা ছাড়া বেমানান। তাই হয়তো প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রাস্তায় একছাতার তলায় দাঁড়িয়ে রাজ কাপুর আর নার্গিসের সেই বিখ্যাত গান— ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’ আজও আমাদের হৃদয়ে দোলা দেয়।