ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
আরও পড়ুন-শহরবাসীর হয়রানি কমাতে পুরভবনেই ঠিকা দফতর
সরস্বতী পুজোর দিনটা এলেই মানসচোখে দেখতে পাই ক্লাস ফাইভের একটা মেয়ে মায়ের লালছাপা শাড়ি, টেপ ফ্রকের ওপরে লাল ব্লাউজ, সেপটিপিন দিয়ে চারদিকে টাঁকা, নিচে উঁচু করে পরা সাদা শায়া, পায়ে সাদা জুতো পরে দৌড়াচ্ছে। স্কুলের উঁচু ক্লাসের দিদিরা জানিয়ে দিয়েছে ঠাকুর আনতে যেতে হবে। ভ্যানটানার শক্তির প্রমাণ তারা নিয়ে নিয়েছে আগের দিন-ই, যখন মেয়েটির বয়ে আনা ইট দিয়ে মন্দির পর্যন্ত সাজানো হচ্ছে পথের মতো করে, শুধু কী তাই! মায়ের গাছবাগান থেকে বড়ো বড়ো টবে পোঁতা চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, ডালিয়া ফুল গাছ নিয়ে এসেছে সাজানোর জন্য।
আরও পড়ুন-এবার ষষ্ঠ সমন, ১৯শে ইডির তলব কেজরিকে
মেয়েটিও ভোর থাকতেই উঠে পড়েছে। সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে স্কুলে। বিদ্যার দেবী সরস্বতী আসবেন ধরাভূমিতে, তার টানা ভ্যানে। এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর হয় না। কে না জানে তাঁর কৃপা হলে অঙ্কে সবচেয়ে কম নাম্বার পাওয়া ছাত্রীটির ভাগ্যও বদলে যেতে পারে। কাজেই তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে শ্বেতবরণা, বীণারঞ্জিতা এই দেবীকে প্রসন্ন করার উপর। সে মনে মনে আউড়াচ্ছে— ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে/ বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহী নমোহস্তুতে।’
সরস্বতী পুজো মানে শাড়ি পরে একদিনের জন্য বড় দিদিদের সমকক্ষ হবার লাইসেন্স। বন্ধুদের সঙ্গে দেদার আড্ডা, স্কুলে স্কুলে ঘুরে আড়চোখে ছেলে দেখা, নিজেদের স্কুলে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে লাজুক হাসি, ভীরু প্রেম (যার স্থায়িত্ব হয়তো ওই একদিনই) অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ আর বিসর্জনের পর একদিন মহাভোজ। পরোক্ষে প্রেমদিবসও বটে।
আরও পড়ুন-আজ বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী
তখন দেবীর কবে কীভাবে কেন মর্ত্যে প্রতিষ্ঠা পেলেন তা নিয়ে আগ্রহ ছিল না। মনে হত আমরাই তো তাঁকে কুমোরটুলি থেকে নিয়ে এলাম স্কুলে। ইতিহাসবিদ বাবার মুখেই প্রথম শুনলাম বিদ্যার, শিল্প-সংস্কৃতির দেবী সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে ঋগ্বেদে। সরস্বতী সাধারণত দ্বিভুজা বা চতুর্ভুজা মূর্তিতে পূজিতা হন। দ্বিভুজা মূর্তিতে তাঁর হাতে থাকে বীণা ও পুস্তক অথবা লেখনী, কলম ও পুস্তক; চতুর্ভুজা মূর্তিতে থাকে পুস্তক, অক্ষমালা, সুধাকলস ও বীণা; দুটি শ্বেতপদ্ম। এই প্রত্যেকটি বস্তুরই প্রতীকী অর্থ রয়েছে।
বৈদিক যুগে গুরুকুলে, তারপর পাঠশালার চল হলে শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াত-কলম রেখে পুজো করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে পুঁথি— প্রিন্টিং মেশিন আবিষ্কার হলে গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পুজো করত। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অবশ্য প্রতিমা নির্মাণ করে পুজো করতেন। এ-বিষয়ে অগ্রণী বর্ধমানের রাজ পরিবার। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই পুজো দেখতে আসত। ভোগের পাশাপাশি দু’ঘণ্টা আতশবাজিও পোড়ানো হত।
আরও পড়ুন-প্রেমদিবসে নিজের বিশ্বরেকর্ড করা ৩২৭ ফুট লম্বা চিঠির সংরক্ষণ চান অনুপম
আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। স্কুল গড়ে উঠলে বিদ্যার দেবী রূপে তখন থেকে তিনি সর্বজনীন। তখনই প্রথম জেনেছিলাম, বাঙালিরা এই দিনটা বিশেষভাবে পালন করলেও দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ও মধ্য ভারতে হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধরাও সরস্বতীর পুজো করেন। কালক্রমে সরস্বতী ছড়িয়ে পড়েন জ্ঞানের দেবী রূপে চিন-জাপান, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, মায়নামার ও ভিয়েতনামেও।
শোনা যায়, কবি আমির খসরু বসন্ত কালে হলুদ পোশাক পরা একদল মহিলাকে একটি মন্দিরে হলুদ ফুল নিয়ে যেতে দেখেছিলেন। এই দৃশ্য দেখে তাঁর মধ্যে অদ্ভুত এক ভাবের উদয় হয়। তিনি খোঁজ নিয়ে জানেন সেদিন মাঘী পূর্ণিমা, মেয়েরা বসন্ত উৎসব পালন করতে চলেছেন মন্দিরে, আরও আশ্চর্য হন জেনে যে সুফি সাধকরাও এই দিনটি পালন করেন নিজস্ব সাধনার অঙ্গ বলে। মকবুল ফিদা হুসেনের সরস্বতীসাধনা তো সর্বজনবিদিত।
‘যে দেবী পুষ্করিণী, হ্রদ ও সরোবরের অধিকারিণী’ বা ‘যে দেবী বাক্যের অধিকারিণী’ তিনিই সরস্বতী। ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে সরস্বতী শ্রেষ্ঠ মাতা, শ্রেষ্ঠ নদী ও শ্রেষ্ঠ দেবী। উপনিষদে ‘পবিত্রতাদানকারী জল’। বিবর্তিত হতে হতে তা এমন এক দেবীর রূপ গ্রহণ করেন, যিনি জ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, সুর, কাব্য-প্রতিভা, ভাষা, অলংকার, বাগ্মিতা, সৃজনশীল কর্ম এবং যা কিছু একজন মানুষের অন্তস্তল বা আত্মাকে পবিত্রতা দান করে তার প্রতিভূ।
আরও পড়ুন-আজ বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী
অথর্ব-বেদে তিনি রোগ নিরাময়, সন্তানসন্ততি, সম্পদ এবং অন্যান্য আকাঙ্ক্ষা প্রদানের দেবী, যজুর্বেদে তিনি চিকিত্সক। স্কন্ধপুরাণ বলছে, জগতে শুধু তাঁর তীর্থ নেই— একথা ভেবে ব্রহ্মা নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলে সেটি চমৎকারপুর যা আজকের পুষ্কর— সেখানে এসে পড়ল। তাঁর নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলে ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, ‘তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।’ তারপর তিনি সরস্বতীর জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। পুষ্করে সরস্বতীর এই মন্দির সবচেয়ে প্রাচীন। দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মাই প্রথম তাঁকে দেবী হিসেবে পূজা করেন। আর কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পুজো প্রবর্তন করেন। এবং বিদ্যার দেবী— এই রূপে আখ্যায়িত করেন।
আরও পড়ুন-সন্দেশখালিকে অশান্ত করতে ফাঁস বিজেপির চক্রান্ত, প্রকাশ্যে অগ্নিমিত্রার ষড়যন্ত্রের অডিও টেপ
অর্থাৎ মাঘী পূর্ণিমায় স্কুলে স্কুলে জ্যান্ত সরস্বতীর পাশাপাশি বীণা হাতে হাঁসকে বাহন করে যিনি বিরাজিত থাকেন তিনি হঠাৎ করে একদিন হলুদ শাড়ি বা হলুদ পাঞ্জাবি-পরা ছাত্র-ছাত্রীদের বা শিল্পীদের কাছে এসে আবির্ভূতা হননি। সেই পৌরাণিক যুগ থেকে স্বর্গ থেকে মর্ত্য— সর্বত্র তিনি সমানভাবে আদৃত নানা রূপে নানা নামে। সেই মেয়েটি যে বহু বছর আগে তাঁকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্ত্যে এনেছিল বলে ভেবেছিল, সে আজও পুজোর দিন সকাল থেকে অজস্র ছাত্রীদের মাঝে নিজেকেও একই ভাবে দেখতে পায়। শুধু তার বয়সটা বেড়ে গেছে, সরস্বতী আজও ইয়ং। যে কোনও কিশোরের হার্ট থ্রব।