বাঙালি মানেই ঘুরতে ভালবাসেন। আর এই ঘোরার টানেই কেউ যাচ্ছেন সমুদ্রের কাছে, কেউ যাচ্ছেন পাহাড়ি এলাকায়। আবার কারও পছন্দ মাটির গন্ধমাখা অনন্য শিল্প। আজ সন্ধান দেব তেমনই এক মৃৎশিল্পের। হ্যাঁ, টেরাকোটা। যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিষ্ণুপুরের নাম। এখানকার ঐতিহ্য, গর্বের সংস্কৃতি, এখানকার স্থাপত্য— সবকিছু মিলিয়ে মানুষকে মাটির কাছে টেনে আনে টেরাকোটা শিল্পের খনি বিষ্ণুপুরে। মৃত্যুঞ্জয় লোক্ষণ-এর প্রতিবেদনে তারই একঝলক।
বিষ্ণুপুর। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার মন্দিরশহরটি আপনাকে তার দুর্দান্ত ঐতিহ্য, গর্বিত সংস্কৃতি, উজ্জ্বল স্থাপত্য এবং পোড়ামাটির গল্পগুলি দ্বারা স্বাগত জানায়। এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিল মল্ল রাজবংশ। দশম মল্ল রাজা জগৎ মল্ল তাঁর রাজ্য বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। একদিন এখান থেকেই শুরু হয়েছিল বাংলা টপ্পা-খেয়ালের পথচলা। পশ্চিমবঙ্গের সেই লোভনীয় পর্যটনস্থল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে ঘুরে আসতে পারেন মাত্র এক সপ্তাহের ছুটি হাতে নিয়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের লালমাটি যতই আগুন ঝরাক না কেন, তবুও এই সময়টা কিন্তু ভ্রমণার্থীরা বেছে নিতেই পারেন বিষ্ণুপুরকে।
আরও পড়ুন-আম্বেদকরের আদর্শ রূপায়িত হচ্ছে এখানেই
কীভাবে যাবেন
শহর কলকাতা থেকে মাত্র ১৩২ কিলোমিটার দূরে লাল পোড়ামাটির স্বর্গরাজ্য এই বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর। কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস পেয়ে যাবেন বিষ্ণুপুর যাওয়ার জন্য। ভাড়া ১৫০ টাকার মধ্যেই। এ-ছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকেও এক্সপ্রেস ট্রেনে চলে আসতে পারেন বিষ্ণুপুর।
কোথায় থাকবেন?
ছোট-বড় অজস্র হোটেল রয়েছে বিষ্ণুপুর জুড়ে। অত্যন্ত কম খরচেই আপনি ভাল হোটেল পেয়ে যাবেন। এ-ছাড়া কম খরচে থাকার জন্য রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ট্যুরিজমের লজ যা কলকাতা থেকে যাওয়ার আগেই বুকিং করে যাওয়া ভাল। খাওয়াদাওয়ার খরচ প্রায় কলকাতার মতোই। বেড়ানোর জন্য আপনি টোটো-রিকশা-অটো পেয়ে যাবেন একদম কম খরচেই।
বিষ্ণুপুরে যা দেখবেন
১. রাসমঞ্চ
রাসমঞ্চ, ইটের তৈরি এই প্রাচীনতম মন্দিরটি রাজা হাম্বির ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাসমঞ্চ গর্বের সঙ্গে একটি ল্যাটারাইট স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে এবং এর সঙ্গে আছে দীর্ঘতর একটি টাওয়ারের পাশাপাশি একটি একক কক্ষের কুঁড়েঘর আকৃতির। দিনের বেলায় আপনি যখন গ্যালারিগুলির মধ্যে দিয়ে হাঁটবেন, তখন আপনি ছায়ার ভাষা দ্বারা আপনার কানে কানে ফিসফিস করে ইতিহাস অনুভব করবেন। অন্ধকারে, স্মৃতিস্তম্ভ থেকে উজ্জ্বল আলো একটি রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করে।
আরও পড়ুন-ব্যাঙ্ক বন্ধ চারদিন
২. মৃন্ময়ী মন্দির
মৃন্ময়ী মন্দির, বিষ্ণুপুরের প্রাচীনতম মন্দিরটি রাজা জগৎ মল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্থানীয় ইতিহাস অনুসারে, মা মৃন্ময়ী তাঁর স্বপ্নে রাজাকে মন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেবী দুর্গা এখানে মা মৃন্ময়ী হিসাবে পূজিত হন।
৩. জোড়বাংলা মন্দির
জোড়বাংলা মন্দিরটি মল্ল রাজা রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পোড়ামাটির শিল্পের অন্যতম ব্যতিক্রমী উদাহরণ এবং একটি অনন্য স্থাপত্য কাঠামোর মালিক। মন্দিরটির বিশেষ “দো-চালা” আকারের কারণে “জোড়বাংলা” নামকরণ করা হয়েছে। মহাভারত, রামায়ণ, কৃষ্ণের বাল্যকালের একাধিক দৃশ্য চিত্রিত আছে মন্দিরগাত্রে।
৪. শ্যামরায় মন্দির
মন্দিরটি ১৬৪৩ সালে রাজা রঘুনাথ সিংহ তৈরি করেন। এটি পাঁচটি চূড়ার মালিক হিসাবে “পাঁচ-চুড়া” মন্দির নামে পরিচিত। এই মন্দিরের আর একটি আকর্ষণ হল দৈত্যাকার রাশচক্র যা ‘গোপিনীদের মাঝে রাধাকৃষ্ণ লীলা’র বিভিন্ন রূপকে চিত্রিত করে।
আরও পড়ুন-স্পাইসজেটের ৯০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা
৫. গড় দরজা
বিষ্ণুপুরে দুর্গের দু’টি গর্বিত প্রবেশদ্বার রয়েছে। স্থানীয় লোকেরা তাদেরকে ‘গড় দরজা’ বলেন। ‘মুরচা পাহাড়’-এর পাশে আপনি পাথরের তৈরি একটি ছোট ঢিবি দেখতে পাবেন। ছোট গেটটি অতিক্রম করার পরে একটি বিশাল গেট আসে যা ছিল বিষ্ণুপুর রাজত্বের প্রবেশদ্বার। ‘গড় দরজা’ শয়তান শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
৬. মদনমোহন মন্দির
আপনি যখন বিষ্ণুপুরে রয়েছেন, তখন এই ‘বিষ্ণু’ মন্দিরটি অবশ্যই দেখতে হবে। অবশ্যই, মন্দিরটি তার দেহের মধ্যে সেরা পোড়ামাটির শিল্পের বার্তা বহনকারী অন্যতম প্রধান কাঠামোগত রূপ। মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ দেব ১৬৯৪ সালে ভগবান মদনমোহন-এর নামে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি আজ অবধি একটি সক্রিয় মন্দির।
আরও পড়ুন-রুশ কবজায় মারিউপোল, ইউক্রেন সেনার প্রতিরোধ ভাঙছে
৭. প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর
‘আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন’ বিষ্ণুপুরের স্থানীয় জাদুঘর এবং প্রত্নতত্ত্ব, শিল্প এবং ইতিহাসকে ভালবাসেন এমন লোকদের অবশ্যই এটি দেখতে হবে। আপনি দশম-দ্বাদশ শতাব্দী থেকে প্রায় ১০০টি ভাস্কর্য দেখতে পাবেন, প্রায় ৫০০০ পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন ধরনের লোককলা, ফটোগ্রাফ, টেক্সটাইলগুলির অপূরণীয় নমুনা এবং আরও অনেক প্রাচীন জিনিস।
৮. লালবাঁধ
বীর সিংহ ১৬৫৮ সালে পোকাবাঁধ, শ্যামবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ, যমুনাবাঁধ, গণতাতবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ এবং লালবাঁধ নামে সাতটি হ্রদ তৈরি করেছিলেন। পানীয় জল এবং শহরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য হ্রদ তৈরি করা হয়েছিল।
৯. দলমাদল কামান
বিষ্ণুপুরের ট্যুরিস্ট লজের পেছনে ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় তৈরি ‘দলমাদল’ কামানটি কিংবদন্তি হয়ে আজও রয়েছে। কথিত আছে, কুলদেবতা মদনমোহন স্বয়ং এই কামান দেগে বর্গিহানা দমন করেছিলেন। বর্গির দল আর মর্দনকারী কামান। তাই কামানের নাম দেওয়া হয় ‘দলমর্দন’, যা কালে কালে অপভ্রংশ হতে হতে নাম হয়েছে ‘দলমাদল’।
আরও পড়ুন-বন্দিমুক্তির বিনিময়ে
কী কেনাকাটা করবেন বিষ্ণুপুরে?
আপনি যদি মহিলা হন তা হলে বিষ্ণুপুর গেলে আপনাকে হ্যান্ডলুম শাড়ি কিনতেই হবে। বিষ্ণুপুরের বালুচরি শাড়ি বিখ্যাত। এখানকার মন্দিরগুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শাড়িগুলি টেরাকোটার প্রতিরূপে বোনা হয়ে থাকে, যা মহাকাব্য, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গ্রন্থগুলির গল্প ফুটিয়ে তোলে। এ-ছাড়াও বিষ্ণুপুরের অন্যতম আর এক সম্পদ স্বর্ণচুরি শাড়ি। এটাও আপনি না কিনে পারবেন না। এ-ছাড়াও পোড়ামাটির হরেকরকমের মূর্তি, গৃহসজ্জার জিনিস পেয়ে যাবেন সস্তাতেই।