নববর্ষের নবরবিকিরণে

বসন্তের রঙিন রাগিণী শেষ হবে চৈত্রের দীর্ঘশ্বাসে। আসে নতুন বছর। নতুন স্বপ্ন, নতুন আনন্দ, নতুন সংকল্প।

Must read

অধ্যাপক অভীক মজুমদার, বিশিষ্ট সদস্য, নয়া রাজ্য শিক্ষানীতি কমিটি
বসন্তের রঙিন রাগিণী শেষ হবে চৈত্রের দীর্ঘশ্বাসে। আসে নতুন বছর। নতুন স্বপ্ন, নতুন আনন্দ, নতুন সংকল্প। ‘পুরাতন বৎসরের জীর্ণ, ক্লান্ত, রাত্রি’ থেকে নবপ্রভাতের নবপ্রত্যয় জেগে ওঠা। ক্যালেন্ডারের পাতায় আসবে ১৪২৯। আসবে পয়লা বৈশাখ। বাঙালিদের এক অতুলনীয় পার্বণ। যা ছিল বেদনা, যা ছিল অপ্রসন্নতা— সবই হল গত। সবই স্মৃতি। এবার নতুন আশায়, নতুন বছরে, নবরবিকিরণে, নতুন বর্ণালিতে জেগে ওঠা। বাংলার এই নিজস্ব উৎসবে এক নতুন চাঞ্চল্য দেখা দেয় জনজীবনে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে পয়লা বৈশাখ সমগ্র বাংলার আর বাঙালির জেগে ওঠার শুভমুহূর্ত। কত স্মৃতি, কত উদযাপন, কত শ্রদ্ধেয়-প্রিয় মানুষের এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। পয়লা বৈশাখ একদিকে সেই স্মৃতি তর্পণের দিন, পয়লা বৈশাখ অন্যদিকে ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে ওঠার দিন।

আরও পড়ুন-টেরাকোটার আঁতুড়ঘর বিষ্ণুপুর

বাংলার ঋতুচক্রের মধ্যেও কিন্তু এই নবীন বছরবরণের ইঙ্গিত আছে। বসন্তে বাংলার ধরণী রূপে-বর্ণে-ছন্দে অপরূপ, নীল দিগন্তে ফুলের আগুন আর কোকিলের মন-উদাস-করা তান। সেই রূপময়, ঐশর্য্যময় সজ্জায় বছর সমাপ্ত হয়। আসে বৈশাখ। তার রিক্ততা, তার অগ্নিদহনে যেন শুষ্কতার সাধনা। সেই সাধনায় ত্যাগী প্রধান। হয়তো সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকৃতি-পর্যায়ের গানে গ্রীষ্ম এবং বৈশাখকে বারংবার তাপস, বৈরাগী, তপস্বিনী প্রভৃতি নাম ভূষিত করেছেন। বৈশাখের সন্ন্যাসীরূপে যার শুরু, চৈত্রের বসন্তে রাজবেশের জৌলুসে তার শেষ।
হয়তো, এই জন্যেই চৈত্র-সংক্রান্তিতে পালিত হয় চড়ক উৎসব, গাজনের মেলা। তখন গ্রীষ্মের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, আকাশে-বাতাসে সেই তপ্ত নিঃশ্বাসবায়ু স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতি যেন এই সাধক। ঋতুচক্ররের সূত্রপাতে, বছর যেন সাধনা শুরু করে নিঃস্বতায়। বসন্তে, তার সিদ্ধির উৎসব। প্রাপ্তির সমৃদ্ধি, পূর্ণতার সম্ভার।

আরও পড়ুন-আম্বেদকরের আদর্শ রূপায়িত হচ্ছে এখানেই

আমি কলকাতায় যে অঞ্চলে জন্মেছি, তার ঐতিহ্য বহুযুগের। আমাদের বাড়ির পাশেই ছাতুবাবুর বাজার। চৈত্র সংক্রান্তি আসার আগে থেকেই পাড়ায়-পাড়ায় ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘোরেন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা। ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে/মহাদেব’। এই ধ্বনির, এই সুরের মধ্যে এক আশ্চর্য উদাস করার আহ্বান আছে। পথের হাতছানি আছে। বাজারে বসানো হয় বিশাল চড়কগাছ। তাতে ঘোরেন এই তাপসেরা। পুরো বিডন স্ট্রিট জুড়ে সেদিন দুপুর থেকে শুরু হয় মেলা। শহুরে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সন্ধে থেকে লোক-লোকারণ্য। একেবারে অচেনা সেই বিকিকিনির আয়োজন। কত মানুষের হাজার পশরায় সেজে ওঠে পথের দু-ধার। কত ক্রেতা কত জিনিসের খোঁজে আসেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কলরবে মুখর হয়ে ওঠে নগরচৌহদ্দি। পরদিন এই মেলা বিকেল পর্যন্ত হয়ে যায় পয়লা বৈশাখের মেলা। বিগত চৈত্র আর আগত বৈশাখ এই মেলায় সমবেত হয় যেন। মেলা শব্দটির সঙ্গেই আছে মিলন। মানুষে মানুষে, ঋতুতে ঋতুতে মিলন।

আরও পড়ুন-ব্যাঙ্ক বন্ধ চারদিন

সেই কবে, ১৮৬১ সালে প্রকাশিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় একেবারেই শুরুর কথিকায় তৎকালীন ‘কলিকাতায় চড়ক পার্ব্বণ’-এর চমৎকার বর্ণনা আছে। দেড়শো বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। তবু সেই বর্ণনা চমকপ্রদভাবে জীবন্ত। সেখানে একটি-দুটি বাক্যে লিখেছেন হুতোম, বাঙালি জীবনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় ইংরেজদের থেকে আলাদা। ‘ইংরেজরা নিউইয়ারের বড় আদর করেন। আগামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান— নেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন। বাঙালীরা বছরটি ভাল রকমেই যাক, আর খারাপের শেষ হোক, সজনেখাঁড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে, পুরাণকে বিদায় দেন। …’

আরও পড়ুন-রুশ কবজায় মারিউপোল, ইউক্রেন সেনার প্রতিরোধ ভাঙছে

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই উনিশ শতকের গোড়া থেকেই চড়ক এবং গাজন বেশ ধুমধাম করেই পালিত হত। ১৯২২ সালে ইংল্যান্ড থেকে কলকাতা ভ্রমণে আসেন শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে ওই বছরেই কালীঘাট মন্দির যাবার পথে এক বিরাট চড়কের মেলা দেখার বিবরণ দিয়েছেন। সুতরাং নববর্ষে এসে মিশেছে এক উদার, সম্প্রীতির, মানবমিলনের আহ্বান।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, বাঙালির নিজস্বতা, বাঙালির মেধা, বাঙালির সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য, বাঙালির সাহিত্য-সংগীত সৃষ্টিশীলতা, বাঙালির বিজ্ঞান-যুক্তি-চিন্তাচর্চার গরিমাকে বিশেষ রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠী হেয় করার, অপমান করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা, বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের বাহিনী বাংলার দীপ্তিকে কালিমালিপ্ত করছে। তারা সংসদে, সভায়, নির্বাচনী প্রচারে, এমনকী জনপরিসরে বাংলার বিরুদ্ধে অসম্মানজনক মন্তব্য করছে। মনে রাখতে হবে, এই বৈশাখ একদিকে বর্ষসূচনার, এই বৈশাখ অন্যদিকে ২৫ তারিখে রবীন্দ্র জন্মোৎসবে প্রণতি জানবার মাস। পয়লা বৈশাখে সেজন্য বাঙালির ঘরে-ঘরে এই হীন-ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে শপথ নিতে হবে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাকে বিশ্বের অঙ্গনে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল মূর্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এসেছেন। ‘বিশ্ববাংলা’ সেই স্বপ্নের আলোকদীপ্ত রূপ। পয়লা বৈশাখে, বাঙালির নিজস্ব পার্বণে, বাংলা আর বাঙালি-বিরোধী ঘৃণ্য চক্রান্তকারীদের সম্পূর্ণভাবে পর্যদুস্ত করার অঙ্গীকার বুকে বুকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-স্পাইসজেটের ৯০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা

পয়লা বৈশাখে কলেজ স্ট্রিট নব আনন্দে জেগে ওঠে। এটিও বাঙালির নিজস্ব পরম্পরা। নিজস্ব অহংকার। অন্য কোনও জাতির এমন ঐতিহ্য নেই। এইদিন প্রকাশকের আমন্ত্রণে লেখক-পাঠক এসে হাজির হন বইপাড়ায়। চলে সর্বত্র মিষ্টিমুখ-আড্ডা-হইচই আর অফুরন্ত প্রীতি বিনিময়। প্রবীণ-নবীন লেখকদের আপ্যায়ন আর অভ্যর্থনায় মুখরিত হয়ে থাকে পুরো গ্রন্থভূমি। কত নতুন বই এদিন প্রকাশিত হয়, কত নতুন চিন্তা আর সৃষ্টিশীলতার উন্মোচিত হয় সেইসব সদয় প্রকাশিত পুস্তকমালার মাধ্যমে। তার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের আকর্ষণে পাঠকও ছুটে যান ওখানে। প্রকাশকদের ঘরে-ঘরে লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সেও এক মেলা। সাহিত্যের অক্ষরের, গ্রন্থের, চিন্তার, নব উদ্যমের।
বছর শেষের চড়কের মেলা থেকে বছর শুরু প্রকাশনার মেলা— এই হল বাঙালির চিরাচরিত বর্ষযাপন। ঘৃণায় দূরে ঠেলে দেওয়া নয়, আমরা বিশ্বাসী ভালবাসা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, শ্রদ্ধা দিয়ে পারস্পরিক মিলনে হাতে-হাত রেখে বাঁচায়। বাংলা আর বাঙালির জয় হোক। বাংলা নবর্ষের জয় হোক। স্বদেশে-বিদেশে যে-যেখানে আছেন সবাইকে আগাম নববর্ষের শুভেচ্ছা। সকলে সারাবছর সপরিবারে ভাল থাকবেন।

Latest article