প্রথম কয়েকটা ওভার দেখেই বোঝা যায়, ম্যাচ কোন দিকে গড়াবে। ক্রিকেটের মতো কথাটা খাটে যে কোনও মেলার ক্ষেত্রেও। সেটা আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা হলে তো কথাই নেই। এবার শুরু থেকেই কলকাতা বইমেলায় নেমেছে মানুষের ঢল। নানা বয়সি বইপ্রেমী। কেউ একা, কেউ দোকা, কেউ-বা সদলবলে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। নেচেচেড়ে দেখছেন পুরনো এবং নতুন বই। পছন্দ হলে কিনছেন।
গতকাল, শনিবার প্রায় দুপুর থেকেই ভিড় উপচে পড়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। ভিড় ছিল শেষ পর্যন্ত। কেনাবেচা হয়েছে ফাটিয়ে। আজ, রবিবার উন্মাদনা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে আন্দাজ করাই যায়। বাকি থাকছে আরও সাতদিন।
আরও পড়ুন-প্রার্থী দিতে না পারলে বিরোধীরা এক ডাকে অভিষেকে ফোন করুন
পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি সুধাংশুশেখর দে জানালেন, শুরুর কয়েকটা দিন দেখে মনে হচ্ছে, জনসমাগম এবং বই বিক্রির ক্ষেত্রে ২০২৩-এর আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা নজির সৃষ্টি করতে চলেছে। রাত ৯-৩০ পর্যন্ত চলছে বিভিন্ন রুটের বাস। শিয়ালদহ থেকে সেক্টর ফাইভ, চলছে মেট্রো। করুণাময়ী মেট্রো স্টেশনের লাগোয়া বইমেলা প্রাঙ্গণ। ফলে যাতায়াতের কোনও সমস্যা নেই। মেলায় সবাইকে স্বাগত। আসুন, দেখুন, বই কিনুন।
প্রায় ২০টি দেশ অংশ নিয়েছে। এবারের ফোকাল থিম কান্ট্রি স্পেন। তৈরি হয়েছে স্পেনের সুদৃশ্য প্যাভেলিয়ন। ভিতরটাও সুসজ্জিত। একটি অংশে শোভা পাচ্ছে ধ্রুপদী স্প্যানিশ সাহিত্য। বিভিন্ন সময়ের লেখকদের বই। কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধ। পাশাপাশি আছে চারুকলা, চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, রন্ধনশিল্প সংক্রান্ত বইও। ভালই চাহিদা। বহু পাঠক নেড়েচেড়ে দেখছেন। স্প্যানিশ শিখতে চাইলে আছে বিশেষ ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে এই প্যাভেলিয়ন ঘুরে দেখা এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন-সিপিএম-কংগ্রেস নেতাদের চিটফান্ড সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, কিউবা, পেরু, অস্ট্রেলিয়া, ইরান প্রভৃতি স্টলেও উঁকিঝুঁকি মারছেন অনেকেই। বিদেশি স্টলগুলোর কোথাও আছে বই বিক্রির ব্যবস্থা, কোথাও শুধুই ছুঁয়ে দেখার সুযোগ। ভাষাগত সমস্যার কারণে কোনও কোনও দেশ নিয়েছে অনুবাদের আশ্রয়। পাওয়া যাচ্ছে বিদেশি বইয়ের বাংলা অনুবাদও। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক ক্রিস্তিনা পিজারোর লেখা অনুবাদ করেছেন শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়। সুব্রত গুহর অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে খাবিয়ের পায়েরাসের বই। দারুণ চাহিদা। অশেষ রায়ের ভাষান্তরে প্রকাশিত হয়েছে পেরুর অলৌকিক গল্প, রিকারদো পালমার পরম্পরায় পেরুর কাহিনি। সংগ্রহের ব্যাপারে উৎসাহী হচ্ছেন অনেকেই।
প্রথমবার অংশ নিচ্ছে থাইল্যান্ড। স্টলে শোভা পাচ্ছে নানা বিষয়ের বই। থাই-ফুডের খ্যাতি সর্বত্র। বিষয়টি মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে স্টলটি, রাখা হয়েছে খাবার-সংক্রান্ত বইও। এ ছাড়াও আছে ছোটদের মনোরঞ্জনের বিশেষ ব্যবস্থা। বলা যায়, থাইল্যান্ড প্রথমবার এসেই মন জয় করেছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং প্যারীচরণ সরকার নামাঙ্কিত দুটি হলেও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি প্রকাশন সংস্থার বই। দারুণ বিক্রি। বাঙালি পাঠকরা অন্য ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে বন্ধুতা পাতাচ্ছেন। দিনে দিনে বাড়ছে বিদেশি বইয়ের কদর।
আরও পড়ুন-আমেরিকার আকাশে ফের গুপ্তচর বেলুন, সতর্ক পেন্টাগন
আছে বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ন। প্রায় ৭০টি প্রকাশন সংস্থা অংশগ্রহণ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভাষা আন্দোলন-সংক্রান্ত বইয়ের দারুণ চাহিদা। পাশাপাশি হইহই করে বিক্রি হচ্ছে নামী কবি-সাহিত্যিকদের বই। প্রসঙ্গত, গতকাল পালিত হয়েছে বাংলাদেশ দিবস। আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা।
বইমেলা উপলক্ষে এবার প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু নতুন বই। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের ‘বই-ই জীবন বই-ই জগৎ’, শংকরের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চ্যাটার্জি’, সমরেশ মজুমদারের ‘উল্টো পথ’, বাণী বসুর ‘আদি সংবাদ’, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লেডি ম্যাকবেথ’, জয় গোস্বামীর ‘কবিতা অনির্বাণ’, আবুল বাশারের ‘চন্দ্রভানু রুইদাস ও নতুন মনসা মঙ্গল’, নবকুমার বসুর ‘অলীক উড়ান’, সুবোধ সরকারের ‘উদ্দাম রজনীর কাব্য’, প্রচেত গুপ্তর ‘একটি সম্পূর্ণ হত্যারহস্য’, জয়ন্ত দে-র ‘অন্নপূর্ণা’, কুণাল ঘোষের ‘সাংবাদিকের ডায়েরি থেকে’, সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথম প্রবাহ’, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘আলোর মানুষ’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত হয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রকাশিত হয়েছে তাঁরও নতুন বই। প্রতিটি বই রয়েছে পাঠকদের পছন্দের তালিকায়। বিভিন্ন স্টলে উপস্থিত থাকছেন লেখকরা। বই কেনামাত্র পাঠকরা পাচ্ছেন অটোগ্রাফ এবং ফটোগ্রাফের সুবর্ণ সুযোগ।
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা ধৈর্য রাখুন: স্টিফেন
প্রবল উন্মাদনা দে’জ পাবলিশিং হাউস, পত্রভারতী, আনন্দ পাবলিশার্স, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন প্রভৃতি স্টলে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে লম্বা লাইন। মিত্র ও ঘোষ-এর নুর ইসলাম জানালেন, আমাদের ক্লাসিকগুলোর চাহিদা সারাবছর। এখানেও অনেকেই সংগ্রহ করছেন। পাশাপাশি বহু পাঠক কিনছেন নতুন বইগুলো।
কৌরব, সপ্তর্ষি প্রকাশন, কিশলয় প্রকাশন, অরিয়ল পাবলিকেশন, আনন্দ প্রকাশন, এডুকেশন ফোরাম, বার্তা প্রকাশন, ছোটদের কচিপাতা, চারুপত্র প্রকাশন, উদার আকাশ, সপ্তধা, যুগ সাগ্নিক, অঙ্কুরোদগম, কবিতা আশ্রম, আদম প্রভৃতি স্টলেও হচ্ছে ভালই ভিড়। বিজল্প-র প্রসূন ভৌমিক জানালেন, কবিতার পাশাপাশি নানা বিষয়ের বই পাওয়া যাচ্ছে আমাদের স্টলে। বহু মানুষ আসছেন, কিনছেন।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও ‘জাগো বাংলা’ স্টলে নেমেছে জনজোয়ার। দুর্গা মণ্ডপের আদলে তৈরি হয়েছে স্টলটি। বিষয় ‘বাংলার সর্বজনীন উৎসব এখন বিশ্বজনীন’। পাওয়া যাচ্ছে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন বই, সংকলন। স্টলে প্রতিদিন আয়োজিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকছেন বিশিষ্টরা।
আরও পড়ুন-পাটনার যাত্রীকে উদয়পুরে নিয়ে গেল ইন্ডিগোর বিমান!
পাঠকদের আগ্রহ থাকে পশ্চিমবঙ্গ মণ্ডপটি ঘিরে। এখানে পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত বিভিন্ন আকাদেমির বই। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কয়েকটি প্রকাশন সংস্থা অংশ নিয়েছে এবারের মেলায়। আছে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টলও।
সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশের শতবর্ষ চলছে। বিষয়টি মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে ছোটদের প্যাভেলিয়ন। কচিকাঁচাদের ভিড় জমছে সেখানে। আজ বইমেলায় পালিত হবে শিশুদিবস। আয়োজিত হবে কিশোর ভারতী-র বিশেষ অনুষ্ঠান।
লিটল ম্যাগাজিনের সম্ভার নিয়ে বসেছেন বিভিন্ন জেলার সম্পাদকরা। প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। ইসক্রা, আরাত্রিক, সাহিত্য রংবেরং, আমি আমার মতো, লুব্ধক, ক্লেদজ কুসুম, মনছবি, আনন্দকানন, ছোটদের রূপকথা, পুরবৈয়াঁ প্রভৃতি পত্রিকার টেবিল ঘিরে জমে ওঠে আড্ডা। পাশাপাশি হয় বিক্রিও।
আরও পড়ুন-বিরাট-নির্ভর দল ভারত: গ্রেগ
মেলায় আছে কয়েকটি মঞ্চ। এসবিআই অডিটোরিয়াম, তরুণ মজুমদার মুক্তমঞ্চ, মৃণাল সেন মুক্তমঞ্চ এবং প্রেস কর্নার। কবি-সাহিত্যিকরা মেতে উঠছেন বই-পত্রিকা প্রকাশ, আলোচনা, কবিতাপাঠে। সঙ্গে থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ভিড় চোখে পড়ছে বিভিন্ন খাবারের স্টলেও। পেটপুজোর পরেই গরম চা-কফিতে চুমুক মেলার চেনা ছবি। একপাশে বসেছেন কয়েকজন চিত্র ও হস্তশিল্পী। উঁকি মারছেন অনেকেই। কিনছেন কোনোকিছু পছন্দ হলে।
মাঠে ঘুরে ঘুরে বই-পত্রিকা বিক্রি করছেন কেউ, কেউ উৎসাহিত করছেন বই কেনার জন্য। বহু মানুষ আছেন, প্রতিদিন মেলায় আসেন শুধুমাত্র প্রাণভরে নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়ার জন্য। বিক্রেতা-ক্রেতার পাশাপাশি এঁরাও বইয়ের বন্ধু।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় উঠবে কেন্দ্রের বঞ্চনা প্রসঙ্গ
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সঙ্গে মিশে রয়েছে মানুষের আবেগ, ভালবাসা। তাই প্রতিদিন মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে উঠছে সরগরম। আছে বিনোদনের নানা উপাদান। তবু কমেনি বইয়ের চাহিদা। বরং দিন দিন বাড়ছে। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে। সারা বছর নানান মেলা। তবে সব মেলার সেরা কলকাতা বইমেলা। এটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত, স্বীকৃত। ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মহানগর বুঁদ হয়ে থাকবে এই মেলাকে ঘিরে।