গিরগিটি

খুব তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে পৌঁছে বুকিং কাউন্টারের টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে সজল দেখলেন তিনি প্রায় সাত-আটজনের পিছনে আছেন

Must read

তুষার সরদার: খুব তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে পৌঁছে বুকিং কাউন্টারের টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে সজল দেখলেন তিনি প্রায় সাত-আটজনের পিছনে আছেন। শিয়ালদা দক্ষিণ শাখার একটা স্টেশন এটা। ট্রেনটা আসতে যতটুকু সময় বাকি আছে তাতে মনে হচ্ছে টিকিট কেটে শিয়ালদা যাবার ট্রেনটা হয়তো পেয়ে যেতে পারেন তিনি। একটু হাঁপ সামলে তিনি দেখলেন লাইনে তাঁর সামনে চারজন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আগে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি সজলের একজন চেনা লোক, অচ্যুত সরখেল।

আরও পড়ুন-অতিরিক্ত ওষুধ আর নয়

অচ্যুতকে বলে শিয়ালদার টিকিটটা কাটাতে পারলে ট্রেন ধরার জন্য হাতে একটু বেশি সময় পাওয়া যেত। কিন্তু ওঁকে সেই অনুরোধ করে কোনও লাভ হবে না। শোনা যায় উনি কখনও কোনওরকম অন্যায় কাজ করেন না বা করতে দেন না। লাইনে ঠিকমতো না দাঁড়িয়ে এইভাবে অন্যকে টপকে টিকিট কাটাটা খুব অন্যায় কাজ বলে উনি মনে করেন। সেজন্য অচ্যুত এইভাবে কারও সাহায্য নিয়ে লাইন টপকানো বা টিকিট কাটানোর ঘোরতর বিরোধী।
দেখতে দেখতে অচ্যুত টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে গেলেন। শিয়ালদার একটা টিকিট কেটে নিলেন। সজলও শিয়ালদা যাবার টিকিট কাটবেন। হঠাৎ অচ্যুত একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। সকলের চোখের সামনেই সদ্য-কাটা শিয়ালদার টিকিটটা দু’হাতে উঁচু করে ধরে ধীরেসুস্থে ভাল করে কুচি-কুচি করে ছিঁড়লেন। তারপর টিকিটের কুচিগুলো একপাশে ফেলে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেলেন। অন্য সবার মতো সজলও এই কাণ্ড দেখে খুব বিস্মিত হয়ে গেলেন।

আরও পড়ুন-মেডিসিন অ্যাডহেয়ারেন্স, সাইড এফেক্ট দূর করুন

সজলের টিকিট কাটা হয়ে যাবার পর টিকিটটা সাবধানে পকেটে রেখে তিনি প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখলেন একটু ওপাশে অচ্যুত দাঁড়িয়ে আছেন। সজল তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে অবাকভাবে বললেন—
‘অচ্যুতবাবু, আপনি টিকিটটা কাটার পর ওভাবে ছিঁড়ে ফেললেন কেন? শিয়ালদা যাবেন কী করে?’
‘আমি এখানে অন্য কাজে এসেছি। আমি আজ শিয়ালদা যাব না।’
সজল আরও অবাক হয়ে গিয়ে বললেন, ‘যাবেন না! তাহলে আপনি শিয়ালদার টিকিট কাটলেন কেন? আর কাটার পর টিকিটটা ওভাবে ছিঁড়ে ফেললেনই বা কেন?’
‘আমি গত সপ্তাহে একদিন শিয়ালদা গিয়েছিলাম। সেদিন টিকিট কাটা হয়নি। সেজন্য আজ কিছু বাড়তি টাকা পেয়েই একটা শিয়ালদার টিকিট কেটে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। রেলের প্রাপ্য টাকা রেলকে মিটিয়ে দিলাম। এখন আমার ন্যায়বোধের কাছে আমি সম্পূর্ণ ক্লিয়ার অ্যান্ড ক্লিন হতে পারলাম। এরকম আমি মাঝেমধ্যেই টিকিট কিনে ছিঁড়ে ফেলে থাকি।’

আরও পড়ুন-বুমেরাং সমালোচনা, দুরবস্থা ডবল ইঞ্জিন বিজেপি রাজ্যের শিক্ষায় শীর্ষে বাংলা

ট্রেনটা ততক্ষণে এসে পড়েছিল। অচ্যুত সরখেলের এইরকম খুঁতহীন বিবেক বা মজবুত সততায় মুগ্ধ সজল ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে অচ্যুতকে প্রশংসাসূচক তেমন বেশি কিছু বলতে না পেরে ট্রেনে উঠে পড়তে বাধ্য হলেন। এইরকম যথার্থ বিবেকবান লোক তো আজকাল দেখাই যায় না।
তবে একটা কথা সজল ঠিকমতো বুঝতেই পারলেন না যে, অচ্যুত ট্রেনে ওঠার আগেই টিকিটটা কেটে নিয়ে তারপর কেন ওঠেন না ট্রেনে! আগে ভাড়া চুকিয়ে তারপর ট্রেনে ওঠাই তো নিয়ম। সবাই তো তাই করে। পরে দেখা হলে অচ্যুতকে জিগ্যেস করে ওই ব্যাপারটাও জেনে নেবেন বলে ভেবে রাখলেন। কিন্তু উনি বললেন, এরকম আমি মাঝেমধ্যেই টিকিট কিনে ছিঁড়ে থাকি। তাহলে কি বিনাটিকিটে ট্রেনে গিয়ে প্রতিবারে টিকিট কিনে ছেঁড়েন, নাকি সব বারে টিকিট কিনে ছেঁড়েন না?

আরও পড়ুন-গ্রামবাসীরা নিশীথকে তাড়ালেন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে, সুকান্তও বিপাকে

এহেন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ অচ্যুত একদিন শিয়ালদায় বিনাটিকিটের যাত্রী হিসেবে ধরা পড়ে গেলেন। বিশ্রী কালো রঙের কোটপরা এক নিতান্ত অসভ্য টিকিট চেকার তাঁর কাছে আড়াইশো টাকা জরিমানা আর সতেরো টাকা টিকিটের দাম, দুয়ে মিলে দু’শো সাতষট্টি টাকা দাবি করে বসল। অচ্যুত সেই অন্যায়কারী টিকিট চেকারকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে বললেন—
‘দেখুন ভাই, আমি সময়ের অভাবে আজ টিকিট কাটতে পারিনি।’
‘সব বিনা টিকিটের প্যাসেঞ্জার ধরা পড়লে ওই এক কথাই বলে। টাকাটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন।’
‘বিশ্বাস করুন, বিনা টিকিটের প্যাসেঞ্জার বলতে যা বোঝায় আমি ঠিক সেরকম নই।’
‘হা হা হা— বিনা টকিটের প্যাসেঞ্জার আবার দু-তিন রকম হয় নাকি? টিকিট ছাড়া ট্রেনে চড়লেই তো বিনা টিকিটের প্যাসেঞ্জার হয়ে গেল! তার আবার ঠিক-বেঠিক কী? এখন ঝটপট দু’শো সাতষট্টি টাকা বের করুন তো দেখি।’
‘আমার স্টেশন থেকে শিয়ালদহ আট টাকা ভাড়া। এক্ষুনি এই স্টেশনের বাইরের কাউন্টারে গিয়ে একটা আট টাকার টিকিট কিনে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।’

আরও পড়ুন-গ্রামবাসীরা নিশীথকে তাড়ালেন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে, সুকান্তও বিপাকে

‘ওসব টিকিটফিকিট কিনে ছিঁড়ে ফেলার ফালতু কথা বলে এখানে লাভ কিস্যু হবে না। তা ছাড়া ভাড়াটা দিতে হবে আমার কাছে, আর আট টাকা নয়, সতেরো টাকা। একেবারে শেষ যে স্টেশন থেকে ট্রেনটা আসছে নিয়মমতো সেখান থেকেই ভাড়াটা ধরা হবে। তা ছাড়া শুধু ভাড়া দিলেই হবে না, তার সঙ্গে আরও আড়াইশো টাকা জরিমানাও দিতে হবে।’
‘এ তো অত্যন্ত অন্যায়।’
‘এটা সরকারি আইন। আপনি যেটা করেছেন সেইটাই অত্যন্ত অন্যায়। আর কথা না বাড়িয়ে দুশো সাতষট্টি টাকা বের করুন।’
‘আমি সততার সঙ্গে রেলের ন্যায্য ভাড়া কখনও ফাঁকি দিই না।’
‘এই তো আজই সততার সঙ্গে আপনি রেলের ন্যায্য ভাড়া ফাঁকি দিয়েছিলেন। তবে ধরা পড়ে গেছেন। কপালজোরে এর আগে হয়তো ধরা পড়েননি। এখন ভালয় ভালয় চটপট টাকাটা বের করুন। নাহলে কিন্তু আপনাকে হাজতে ভরে দেবার জন্য জিআরপি-র হাতে এক্ষুনি হ্যান্ডওভার করে দেব।’

আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যে প্রিন্সিপালকে পুড়িয়ে মারল ছাত্র

অত্যন্ত অপমানে এবং প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দুশো সাতষট্টি টাকা বের করে দিতে বাধ্য হলেন নিরুপায় অচ্যুত। তাঁর অতবড়ো বিবেকের কি কোনও দাম এরা দেবেই না? এই কি ন্যায্যবিচার? তাঁর মতো ন্যায়বান ভদ্রলোককে একজন সাধারণ অপরাধীর মতো জিআরপি মানে পুলিশের হাতে তুলে দেবার হুমকি দেওয়া হল?
কিন্তু এর পরেও তাঁর দীর্ঘদিনের পুরনো অভ্যাসবশত মাঝেমধ্যেই বিনাটিকিটে ট্রেনে উঠে পড়তেন। তখন শিয়ালদা স্টেশনে নেমে নানা কৌশলে, নানা ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে জঘন্য কালো কোটপরা সমস্ত দুর্বিনীত টিকিট চেকারকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণাসহকারে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেন। সেসব করতে গিয়ে তাঁকে নানারকম বাজে ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতে হত।
একবার ওইরকম এক পরিস্থিতিতে পড়ে তাড়াহুড়ো করে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ভাবে উঁচু করে বানানো রেলের লোহার ফেন্সিং টপকে যেতে গিয়ে তাঁর একটা দামি জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আর একবার আরও খারাপ ঘটনা ঘটেছিল।
চেকার এড়াতে প্ল্যাটফর্মের বদলে রেললাইনের উপর দিয়ে দৌড়ে চলে যাবার সময় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে জোর চোট লেগেছিল। সেজন্য তাঁকে অর্থব্যয় করে ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল এবং এক্স-রে করাতেও হয়েছিল। এই সমস্ত ঘটনার জন্য রেলের ওইসব কুৎসিত কালো কোটপরা টিকিট চেকার ছাড়া অন্য কাউকেই দায়ী করা যায় না।

আরও পড়ুন-গ্রামবাসীরা নিশীথকে তাড়ালেন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে, সুকান্তও বিপাকে

এইসব নিতান্ত অপ্রিয় ব্যাপার ভালভাবে এড়াতে অচ্যুত এখন শিয়ালদহের ঠিক আগের স্টেশনে নেমে গিয়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত একটা টিকিট কেটে নেন। দেখা গেছে এই স্টেশনে কালো কোটপরা জঘন্য টিকিট চেকারের অভদ্র উপদ্রব তেমন নেই।
টিকিট কেটে পরের ট্রেন ধরে শিয়ালদহ নেমে সগর্বে টিকিট চেকারকে ডেকে টিকিটটা দেখিয়ে অথবা মাথা উঁচু রেখে টিকিট চেকারের একেবারে গা ঘেঁষে গটগটিয়ে গেট পেরিয়ে যাওয়া শুরু করেছেন।
তবে বিনা টিকিটে ট্রেনে কোথাও যাওয়া বা ফিরে আসাটা মোটামুটি নিরাপদে ঘটে যাবার পরে তাঁর হাতে বাড়তি টাকা এসে গেলেও চেকারের অত্যাচারের ফলে প্রচণ্ড মনোকষ্টে পড়ে আগের মতো মাঝেমধ্যে একটা টিকিট কিনে সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলার কাজটা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন অচ্যুত সরখেল।
কুশ্রী কালো কোটপরা রেলের অশিষ্ট বেয়াদব টিকিট চেকার বিনা কারণে তাঁকে যে ভাবে ধরেছিল বিশেষত তাঁর বিবেক, তাঁর সততা, তাঁর ন্যায়বোধকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যেরকম অপমানিত করে জরিমানা করেছিল এবং পুলিশে ধরিয়ে দেবার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল তা কখনও ভোলার নয় এবং রেলকোম্পানির ঘৃণ্য টিকিট চেকারদের সেসব অপরাধ ক্ষমার সম্পূর্ণ অযোগ্য বলে সেদিন মনে করেছিলেন এবং এখনও তাই মনে করে চলেছেন— চলবেনও।
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article