পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রশাসনকে পরিকল্পিত ভাবে অচল করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাপক জয়ের পর এই হীন অপচেষ্টা আরও জোরদার হয়েছে। ২০১১-তে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বহু নতুন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন-ঘরেই বাড়ুক গাছ
প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা স্নাতকোত্তরস্তরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলতে পারি বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও ডায়মন্ড হারবারে যদি বিশ্ববিদ্যালয় না হত, তাহলে ওই জেলার দূরবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে স্নাতকোত্তর শিক্ষালাভ সম্ভব ছিল না। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার ছাত্রছাত্রীদের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হত অর্থাৎ বর্ধমান শহর বা কাছাকাছি এলাকাতে থাকতে হত, যেটা আর্থিকভাবে তারা সক্ষম নয়। দেখেছি, ডায়মন্ত হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশের বেশি ছাত্রী কাকদ্বীপ এবং সুন্দরবন এলাকার বাসিন্দা। তাদের অনেকেই সংখ্যালঘু, আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবার থেকে এসেছে। কলকাতায় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তাদের কাছে স্বপ্নের মতো।
আরও পড়ুন-জবাব দিচ্ছে জনস্রোত, প্ররোচনা-গন্ডগোলে জড়াবেন না
এই সমস্ত ছেলেমেয়ের বিশেষ করে ছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সরলতা এবং সর্বোপরি পরিবারের বাধা সত্ত্বেও স্বাবলম্বী হওয়ার দৃঢ় মানসিকতা দেখে আশ্চর্য হয়েছি। একটাই সমস্যা। ইংরেজি ভাষার উপর তেমন দখল নেই। এদের দোষ নেই। বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে ভ্রান্ত ভাষানীতির ফল। রাজ্যের অন্যান্য মফসসল শহরভিত্তিক বা গ্রামভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও একইভাবে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার ফলে অনুন্নত বা দূরবর্তী অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার অভাবনীয় প্রসার হয়েছে। অথচ এই শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত বা দিশাহীন করে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। বেছে নেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষায় সংকট সৃষ্ট করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা হলে তার প্রভাব কলেজগুলির উপর পড়তে বাধ্য, কারণ কলেজগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল। ফলে সার্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হবে।
আরও পড়ুন-১৩ জুন সর্বদল, নিরাপত্তায় কড়া ব্যবস্থা
এই অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল রাজ্যের পূর্বতন মাননীয় রাজ্যপাল ধনকড় সাহেবের সময়। রাজ্য সরকার অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপাচার্য নিয়োগের নিয়ম হচ্ছে, এই উদ্দেশ্যে গঠিত সার্চ বা সন্ধান কমিটি মেধাভিত্তিক ন্যূনতম তিনজনের নামের প্যানেল তৈরি করে উচ্চশিক্ষা বিভাগের মারফত আচার্যের কাছে পাঠিয়ে থাকে। আচার্য একটি নাম বেছে নেন। এই ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের মতামতের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেন, অথবা না-ও হতে পারেন। আচার্যের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তবে প্যানেলের বাইরে থেকে কাউকে নিয়োগ করা যাবে না। বামফ্রন্টের আমলে নিয়ম ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সিনেট) যে নাম পাঠাবে, আচার্য তাঁকেই উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করবেন। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট (বা সিনেট) প্রার্থীদের নামের তালিকা পাঠাত। কিন্তু আচার্য-রাজ্যপাল এ পি শর্মা রাজ্য সরকারের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন। ফলে রাজ্যপালের সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর থেকে কোর্ট বা সিনেট একটি নাম পাঠাতে আরম্ভ করল, যাতে আচার্যের অনুমোদন দেওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু থাকে না। তৎকালীন অতিবিশিষ্ট বিরোধী নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় এই পদক্ষেপকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-বিরোধী আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। তখন ‘জনস্বার্থ’ মামলার তেমন প্রচলন হয়নি। হয়ে থাকলে কী হত বলা যায় না।
আরও পড়ুন-বিরাট-রাহানের ব্যাটে বেঁচে স্বপ্ন
বামফ্রন্ট আমলে উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত ‘সার্চ’ কমিটি ছিল না। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হওয়ার পর উপাচার্য নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার জন্য আইন সংশোধন করে বর্তমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যা-ই হোক, বাঁকুড়া, বর্ধমান-সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বা নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের জন্য আইন অনুসারে সার্চ কমিটি গঠন করে কমিটির সুপারিশ করা প্যানেলে মাননীয় আচার্য-রাজ্যপাল ধনকড় সাহেবের কাছে পাঠানো হল। কিন্তু তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নিলেন না। মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। মাসের পর মাস চলে গেল। ফাইল আটকে রইল। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সিদ্ধান্তহীনতাই হল সিদ্ধান্ত, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে এবং সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। জনগণের নির্বাচিত সরকার তো লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বুঝেও নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হল।
আরও পড়ুন-প্রস্তুতি ম্যাচে জয় ডায়মন্ড হারবারের
উপায়ান্তর না দেখে মেধাভিত্তিক প্যানেলের প্রথম প্রার্থীকে রাজ্য সরকার উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করল। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা। যুক্তি, উপাচার্যদের নিয়োগ নিয়মবহির্ভূত, কারণ তাঁরা আচার্য কর্তৃক নিযুক্ত হননি। উপাচার্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা উপাচার্য থাকতে পারবেন তো? অনেকেই হাল ছেড়ে হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষায় বসে রইলেন। নীতিগত, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। পুরোটাই যেন চিত্রনাট্যের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মতো। একই সঙ্গে আরও একটি সমস্যার সৃষ্টি হল। রাজভবন থেকে আচার্যের প্রতিনিধি না পাঠানোর ফলে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের শূন্যপদ পূরণ এবং শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া আরম্ভ করা সম্ভব হল না। ফলে প্রচণ্ড অসন্তোষ সৃষ্টি হল। এই অবস্থায় ড. আনন্দ বোস পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের দায়িত্ব নিলেন। অনুমান করা যায়, হাইকোর্টের রায়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের ইতিবাচক বোঝাপড়া হল।
আরও পড়ুন-মোদির রাজ্যে দলিত যুবককে পিটিয়ে খুন
২৮ ফেব্রুয়ারি এবং ১ মার্চ (২০২৩) সমস্ত উপাচার্যকে রাজভবনে ডাকা হল। সকলেই পদত্যাগ করলেন এবং সকলকেই তিন মাসের জন্য পুনরায় নিয়োগ করা হল। রাজভবনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, এই সময়-সীমার মধ্যে নতুন উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। অনিবার্য কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। প্রাপ্ত সংবাদ অনুসারে, শিক্ষাদফতর প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, শিক্ষা-প্রশাসনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার জন্য উপাচার্যদের মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানো হোক। কিন্তু মাননীয় আচার্য-রাজ্যপাল সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে নিজেই উপাচার্য নিয়োগ করলেন। সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। নিযু্ক্ত উপাচার্যদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা কি আদৌ উপাচার্য? কারণ নির্দেশে শুধুমাত্র বলা হয়েছে, তাঁরা উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁদের আর্থিক ক্ষমতা কোথায়? ফলে নৈরাজ্য চলছে।