‘এই বাংলা গ্রামে গাথা দেশ’, যা ছিল রবীন্দ্রনাথের বড় প্রিয়। সেই বাংলার প্রাচীন মহামিলনের তীর্থভূমি গ্রামীণ উৎসবকে ঘিরে গড়ে ওঠা মেলাগুলি। শুধু শিশুদের জন্যই নয়, বড়দের কাছেও এই গ্রামীণ মেলার আকর্ষণের এক গুরুত্ব রয়েছে। শিশুদের নানান ধরনের খেলনা পাওয়া যায়, এই মেলায়। যেমন— পুতুল, বাঁশি, বল, লাটিম, মার্বেল ইত্যাদি। তাই তাদের কাছে মেলা প্রিয় এবং আকর্ষণেরও। মেয়েদের কাছেও মেলা প্রিয়। তাদের প্রসাধন উপকরণের মধ্যে ফিতে, চুড়ি, ক্লিপ, স্নো-পাউডার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য জিনিস মেলাতে পাওয়া যায়। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মুড়ি-মুড়কি, খই, খাজা, কদমা, চিনি বাতাসা, জিলাপি, নিমকি, রসগোল্লা, তেলেভাজা, পিঠাপুলি, নারকেলের নাড়ু, ঘুগনি, চা-সহ নানারকমের খাবার মেলে বাংলার মেলায়-মেলায়। ভাবের আদান-প্রদান হয় মেলাকে ঘিরে। আর গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্বকীয় ভূমিকা নেয় এই সব মেলা। গ্রামের মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দিনযাপন করে যা তাঁদের জীবনের ছন্দপতন ঘটায় মাঝে মাঝে। আর এই গ্রামীণ মেলা তখন তাঁদের কাছে অনাবিল শান্তি ও আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে। গ্রামের অনেক দরিদ্র, অবহেলিত মানুষ আছে যাঁরা এই মেলা উপলক্ষে আয়-উপার্জন করতেও পারে। যেমন কামার, কুমোর, তাঁতি, দোকানদার, ছুতোর তাদের জিনিসগুলো মেলাতে বিক্রি করে কিছু আয় করতে পারে। সুতরাং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই মেলার তাৎপর্য রয়েছে গভীরভাবে।
আরও পড়ুন-এক ডজন পিকনিক স্পট
মেলা আবহমানকাল ধরে বাংলার লোক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে গ্রাম বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি এখন বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ সংস্কৃতি ধারক, বাহক গ্রাম্যমেলাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
অতীতের মেলায় কৃষিকাজ, ঘর-গেরস্থালির জন্য নানারকম জিনিসপত্র আসত। কুমোররা মাটির হাঁড়ি, কলসি, কুঁজো, ঘট, সরা, মালসার সঙ্গে মাটির পুতুল, হাতি-ঘোড়া ইত্যাদির পশরা সাজিয়ে বসত। কামাররা নিয়ে আসত দা, কাটারি, হাঁসুয়া, ছেনি, বাটালি, কাস্তে, কুড়ুল, বঁটি, চাটু, খুন্তি, হাতা ইত্যাদি। আসত ডোমেদের তৈরি ঝুড়ি, কুলো, চালুনি, ধুচুনি, আরও অনেককিছু। যেসব এলাকায় অনেক দূরে হাট-বাজার, সেখানে মেলায় কপি, আলু ইত্যাদি সবজিও বিক্রি হত। আর শীতের মেলায় বিক্রি হত শাঁকআলু। বড় বড় গৃহস্থঘরের লোকেরা বস্তা ভরে শাঁকআলু কিনতেন, কলা কিনতেন নবান্নের জন্য। বীরভূমের কেন্দুলীর মেলায় এখনও কলা বিক্রি হয়। মেলার কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে যেত গরুর গাড়ির ছই বানানোর কাজ। গরুকে ভাল করে স্নান করিয়ে তাদের শিং-এ তেল মাখিয়ে দেওয়া হত। মেলার আগের রাতে উত্তেজনায় বাচ্চারা ঘুমোত না। তাদের সঙ্গে বড়রাও একজন যেতেন, গরুর গাড়ির গাড়োয়ান হিসেবে। তিনি ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস তো কিনতেনই, সেইসঙ্গে শাঁকআলু, মুড়কি, গুড়, চিনির সুটি বা কাঠিগজা, তিলের খাজা, গুড়ের লবাত (পাটালি), গজা, খাজা, জিলিপি, সন্দেশ ইতাদি অনেক পরিমাণে কিনতেন। মেলা থেকে এইসমস্ত মণ্ডা-মিঠাই শুধু যে নিজেরা খাওয়ার জন্য কিনতেন তা নয়।
আরও পড়ুন-সম্মান সব ধর্মকে, নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী, কাল সংহতি মিছিল, বাংলায় প্রস্তুতি তুঙ্গে
আত্মীয়স্বজনদের ঘরে, মেয়ের শ্বশুরঘরে পাঠানোও হত। এটা অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী নদীতীরবর্তী গ্রাম অঞ্চলের রীতি বলা যায়। জামাইকে মেলা দেখার জন্য শ্বশুরমশাই টাকা দিতেনও বর্ধমানের গ্রামে গ্রামে।
সে-কালের রাঢ়ের মেলায় রসগোল্লা, পান্তুয়া, লেডিকেনি, বোঁদে আর মস্ত বড় বড় কদমা বিক্রি হত। আজও হয়। মেলার দোকানের পাটাতনে বড় থেকে ছোট কদমা সাজানো থাকত। মেলায় কেউ বেলুন, কেউ বাঁশি, কেউ ছোলা-মটর ভাজা বিক্রি করত। কোনও কোনও মেলায় সাঁওতালি নাচ, তরজা, বাউলগান, কবিগান, যাত্রাপালা হত। আজও হয়। তখন গ্রামের মানুষের কাছে এইগুলোই ছিল বিনোদনের একমাত্র বিষয়। অতীতের মহরমের মেলায় যেমন লাঠি, মশাল, তরবারি নিয়ে মানুষ নানারকম কসরত দেখাত, তেমন চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলায় শিবের ভোক্তারা আগুন ঝাঁপ, পিঠফোঁড়া, কাঁটায় চলার মতো ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সব খেলা দেখায় এখনও।
আরও পড়ুন-ধান কেনাতেও কেন্দ্রের বঞ্চনা, তবু স্বনির্ভর প্রকল্পে ৩০ হাজার কোটি
গ্রামের কামার, কুমোর, হাড়ি থেকে নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষেরা বছরের এই দিনগুলোর জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। বড় থেকে ছোট, সবাই পায়ে হেঁটে দূর দূর গ্রামে মেলা দেখতে যেত কুলির ধুলো উড়িয়ে। শীতের বাংলার অখ্যাত কিছু প্রাচীন মেলা তুলে ধরা হল—
কালীদহের ছোট কেন্দুলীর মেলা
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের বেরেণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের কালিদাস মাঠের কাঁদর পাড়ে হয় মেলা। ৭ মাঘ থেকে ১৬ মাঘ পর্যন্ত হয় গ্রামীণ এই মেলাটি। স্থানীয়রা বলেন, এটি ছোট কেন্দুলীর মেলা। পূর্বে এই মেলাটি শুরু হয় বেলুটি গ্রামের জমিদার মজুমদারদের উদ্যোগে, ১২৬৮ বঙ্গাব্দে কালীদহের মেলার সূচনা হয়েছিল। মূলত রাধাবল্লভ আর রসিকনাগরের পুজোকে কেন্দ্র করেই এই মেলা। রসিকনাগরকে আনা হত আউশগ্রামের গলিগ্রাম থেকে। তবে মেলা হলেও ঠাকুরটিকে আর আনা হয় না। রাধাবল্লভকে আনা হয় মেলাতে পাশের নবগ্রাম থেকে।
আরও পড়ুন-নাসার ডাকে সাড়া বিক্রমের
খটিলা বিবির মেলা
বাবুরবাঁধ নামের একটি গ্রাম রয়েছে আউশগ্রামের বসন্তপুর গ্রামের পাশে। আউশগ্রামের বেরেণ্ডা অঞ্চলের কুনুর নদী তীরের এই বাবুরবাঁধেই হয় একটি গ্রামীণ মেলা। সেই মেলার নাম ‘খটিলা বিবির মেলা’। মেলাটি হয় প্রত্যেক বছর ১৭ পৌষ থেকে ২৭ পৌষ পর্যন্ত চলে। ‘খটিলা বিবি’ নামের এক পিরের আস্তানা রয়েছে গ্রামে। সেখানেই মেলা হয় বলে এমন নাম মেলার।
১৯৯৯-এ শুরু হয় মেলাটি। বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা ডাঃ আয়নাল হক মণ্ডলের উদ্যোগে এই মেলাটি শুরু হয়।
খণ্ডঘোষের কুমিরকোলার মেলা
বর্ধমানের খণ্ডঘোষ। বর্ধমান থেকে বিষ্ণুপুর, ভায়া খণ্ডঘোষ বাসে যেতে হয়। বেশ বড়, প্রাচীন এই গ্রামেই রয়েছে হিন্দু, মুসলমানদের বসবাস। এই গ্রামে রেবতী বলরামের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন, গ্রামের নন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিবারের পূর্বপুরুষরা বংশানুক্রমে ছিলেন জমিদার। নন্দরাম প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দের ফাল্গুন মাসে বাৎসরিক পুজোর সময়, চারদিনের উৎসব হয়। চারদিনই মেলা বসে এখানে। বন্দ্যোপাধ্যায়রাই এই মেলাটি পরিচালনা করেন।
আরও পড়ুন-অভিষেকের সেঞ্চুরি, চারশোর কাছে বাংলা
চব্বিশ প্রহর মেলা
চারদিনের মেলা চব্বিশ প্রহরকে ঘিরে, বীরভূমের রায়পুরে। শুরু হয় ১৯২০ সালে, দুর্গাপদ চক্রবর্তী তাঁর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি বছর ৭ জ্যৈষ্ঠ মেলা শুরু হয়, শেষ হয় চব্বিশ প্রহরের শেষ দিন ১০ জ্যৈষ্ঠ।
দেউলির মেলা
বীরভূমের অজয়-তীরের দেউলি গ্রামে হয় একটি অখ্যাত পৌষসংক্রান্তির প্রাচীন মেলা। একদিনের মকরস্নানের মেলা হলেও, মেলাটিতে আজও লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। আজও বীরভূম ও বর্ধমানের বহু গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি নিয়ে এই দেউলির মেলায় পিকনিক করতে যায়। সারাদিন মেলায় কাটিয়ে ফিরে আসে সন্ধেবেলা। এই গ্রামীণ মেলাটিকে ঘিরে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির পশরা বসে। হাতা, খুন্তি, হাঁড়ি, হোলা-সহ নানান মাটির জিনিসের পাশাপাশি মিষ্টি এবং খাবারের দোকান বসে। অনেক দূর থেকে আসে বাচ্চাদের খেলনাপাতির দোকানও। পৌষসংক্রান্তির এই দিনে বহু মানুষ অজয়ের জলে সকালের পুণ্যস্নান সেরে, দেউলির দেউলেশ্বর শিব এবং খাদা পার্বতীর মন্দিরে পুজো দেয়।
ব্রহ্মদৈত্য মেলা
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে রামনগর গ্রামে হয় একদিনের ব্রহ্মদৈত্য মেলা। খাবারের দোকানের পাশাপাশি মাটির জিনিস, পুতুল, হাতি, ঘোড়া আর বাচ্চাদের খেলনাপাতির দোকান বসে। প্রতি বছর পয়লা মাঘ, বিকেলে শুরু হয় মেলা। শেষ হয় অধিক রাতে। গ্রামীণ এই মেলাটি হয় ব্রহ্মদৈত্য ঠাকুরের পুজোকে ঘিরে।
আরও পড়ুন-নির্বাচনের আগে এজেন্সি-রাজনীতি, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ইডি
ভেদিয়ার মেলা
বত্রিশ ফুঁকোর স্নানের মেলাটি হয় পৌষপার্বণকে কেন্দ্র করে। পৌষসংক্রান্তির দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে মেলা। অনেকেই এদিন অজয়ের চরে বক্স বাজিয়ে করে চড়ুইভাতি। এখানে প্রথম জানুয়ারির দিনও মেলা বসে। সারাদিনই পিকনিক ও মেলা হয়। পূর্ব বর্ধমানের ভেদিয়াতে অজয়-তীরের মেলাটি কয়েক বছর ধরে হচ্ছে। খুব প্রাচীন নয়। ১৯৯৯-এর কাছাকাছি সময়ের মেলা এটি।
রঘুনাথগঞ্জের মেলা
মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের সাগরদিঘির এই মেলাটি বেশ প্রাচীন। সাগরদিঘির অনুপপুরে হয় গ্রামীণ এই শীতমেলা। পৌষপার্বণকে ঘিরে বসে এই মেলাটি।
নিউ টাউন সবলা মেলা
শীতের আমেজে সাড়ম্বরে হয় প্রতি বছরই সবলা মেলা। গ্রামীণ মেয়েদের স্বনির্ভর করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের কোনও এক সময় থেকে শুরু হওয়া এই সবলা মেলা চলে সাত দিন পর্যন্ত। নিউ টাউন মেলা প্রাঙ্গণে শুরু হয় এই মেলা। প্রতিদিন বেলা দুটো থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত চলে মেলা। মেলায় রয়েছে রকমারি শিল্প ও খাবারের সন্ধানও।
বিষ্ণুপুর মেলা
শীতের মরশুম শুরু হতেই গোটা বাংলার মানুষ মেতে ওঠেন উৎসবের আনন্দে। এই সময় আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই উৎসবমুখর হয়ে ওঠেন। ঠিক তেমনই পর্যটন, হস্তশিল্প, কুটিরশিল্প প্রভৃতিকে মাথায় রেখে বাঁকুড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নগরীতে সাড়ম্বরে শুরু হয় বিষ্ণুপুর মেলা। বিষ্ণুপুর মেলা হয় ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। হস্তশিল্প, সংস্কৃতি এবং পর্যটনকে তুলে ধরতেই বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন এই মেলার আয়োজন করেছে। প্রত্যেক জেলায় হয় এমন মেলা। জেলা বইমেলাগুলিও চলছে এই সময়ে।
আরও পড়ুন-পণে অনিচ্ছা, যোগীরাজ্যে স্ত্রীকে তিন তালাক দিলেন ব্যক্তি
জামালপুরের মেলা
বর্ধমান জেলার জামালপুরে বুড়োরাজের মন্দির। বৈশাখী পূর্ণিমা যা বুদ্ধপূর্ণিমা বলেও পরিচিত সেদিনের বর্ধমান জেলার সবুজে ঘেরা ছোট গ্রাম জামালপুরে বুড়োরাজের মহামেলা বসে আজও। বৈশাখের দাবদাহকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। কেউ অস্ত্র দিয়ে দেবতার উদ্দেশে বলি দিতে আসে, তো কেউ আবার দলবদ্ধ হয়ে অস্ত্র প্রদর্শন করে বীরত্বে। এখানে মন্দির বলতে একটি খড়ের চালাঘর। মেঝেটি আজও মাটির। শিব, যম-ধর্মরাজের এক মিলিত রূপ এই বুড়োরাজ। বাংলায় বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের ফলেই ধর্মরাজের পুজোর প্রচলন ঘটেছিল।
কোচবিহারের রাসমেলা
কোচবিহারের এই রাসমেলা সব মেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী। প্রতি বছর নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে হয় এই মেলা। রাস পূর্ণিমাতে। পুজোর পট কোচবিহারের লোকেরা শ্রীমদনমোহন ঠাকুরের রাসযাত্রা উদযাপন করতে প্রস্তুতি নেয়। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে কার্তিক মাসে পূর্ণিমার শুভ দিন থেকে রাস মেলা উদযাপন শুরু হয়। মেলার সূচনা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। উৎসটি ১৭৮৩-১৮৩৯ সালের মধ্যে ধরা হয়। কোচবিহারের ১৭তম রাজা অর্থাৎ মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণের শাসনের সময় খুঁজে পাওয়া যায় এই উৎসব। এই রাসের উৎপত্তির কারণের প্রমাণ পাওয়া যায় জৈনাথ মুন্সির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাজ্যোপাখ্যান’-এ। এই রাসমেলাটি প্রথমে ভেটাগুড়িতে, তারপর বৈরাগী দিঘি সংলগ্ন কোচবিহার শহরের মদনমোহন মন্দিরে এবং পরে প্যারেড গ্রাউন্ড বা বর্তমান রাসমেলা গ্রাউন্ডে ১৯১২ সাল থেকে উদযাপিত হচ্ছে।
মেদিনীপুরের রাস
রাস উৎসবকে ঘিরে আজকাল মেতে ওঠে গোটা রাজ্য। আর রাস উৎসবের কথা বললে পঁচেটগড় রাজবাড়ির কথা না বললেই নয়। প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থানা এলাকার পঁচেটগড় একটি প্রসিদ্ধ স্থান। পঁচেটগড় রাজবাড়ি রাস উৎসবের জন্যই সকলের কাছে এক ডাকে ইতিহাস। একসময় এই রাস উৎসবের জাঁকজমক দুর্গোৎসবের চেয়েও কোনও অংশে কম ছিল না। রাজ পরিবারের দাবি, ওড়িশার কটকের আটঘর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন আদি পুরুষ কালুমুরারিমোহন দাস মহাপাত্র। এই দুঃসাহসিক যুবক সম্রাট আকবরের রাজ কর্মচারী ছিলেন। ওড়িশার রাজা মুকুন্দদেব আকবরের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে উভয়ে যৌথ শত্রু গৌড়েশ্বর সুলেমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাতে তাঁরা জয়ী হন। এখানে কালুমুরারির অসামান্য কৃতিত্ব প্রকাশ পায়।
আরও পড়ুন-মৃত অগ্নিবীরের প্রাপ্য সম্মান চান শোকার্ত বাবা
মেদিনীপুরের তাঁতমেলা
জেলা শহর মেদিনীপুরের পুজোর আগেই বসে ঐতিহ্যের তাঁতমেলা! শহরের জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এই ‘তাঁতবস্ত্র প্রদর্শনী ও মেলা’। জেলার তাঁত শিল্পীদের কথা ভেবেই এই মেলা হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে সাড়ম্বরে হয় এই তাঁতমেলা। রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনী এবং মেলায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁতশিল্পীরা উপস্থিত হন। বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁত, খাদি, সুতি বা হ্যান্ডলুমের শাড়ি, জামাকাপড়ের পশরা সাজিয়ে বসেন শিল্পীরা। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে হয় মেলা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়। প্রতি বছরই হয় মেলাটি।
চৈত্রগাজনের শিব মেলা
চৈত্রগাজনের সংক্রান্তির দিন থেকে ৪ বৈশাখ পর্যন্ত শিবের গাজন মেলা হয়, জেলায় জেলায়। দুই বর্ধমান ও বীরভূমে এই রকম অজস্র মেলা হয়। তার মধ্যে প্রাচীন মেলাটি বসে বর্ধমানের আউশগ্রামের ধনকোড়াতে। মেলায় রাত গাজনের দিন বহু লোকের সমাগম হয়।
কলকাতায় রথের মেলা
আজ থেকে ৫৫০ বছর আগে ওড়িয়া-গৌড়ীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন রচনা করেছিলেন প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। তাঁর অনুপ্রেরণায় গুপ্তিপাড়ায় বাংলার প্রাচীন রথযাত্রার সূচনা হয়। বাংলায় মেলা সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন রথের মেলা। শ্রীক্ষেত্রে রথে চড়েন জগন্নাথ, তাতে কী! রথের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় ধারে পাঁপড় ভাজা, জিলিপি, বেলুন, তালপাতার ভেঁপু, কাচের চুড়ির বাহার দেখতে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। ছোটদের হাতে হাতে কাঠের রথে মাটির জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা ঘুরে বেড়ান পথে পথে।
হুগলির শ্রীরামপুরে মাহেশের রথ, কলকাতায় ইসকন মন্দিরের রথ, পরেশনাথ মন্দিরে জৈনদের রথযাত্রা, শহর আর শহরতলির সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন রথযাত্রার তালিকায় রয়েছে দীর্ঘ। এছাড়াও বিভিন্ন জেলায় ঐতিহ্য, পরম্পরা মেনে রথযাত্রার প্রচলন রয়েছে। রথটানার পর বাড়ির কচিকাঁচাদের দ্বিগুণ আনন্দ দিতে কলকাতা, আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অসংখ্য রথের মেলা হয়।
আরও পড়ুন-প্রকাশ্য দিবালোকে নয়ডায় জিম থেকে ফেরার পথে গুলি.বিদ্ধ যুবক
মানভূমের প্রাচীন মেলা
কংসাবতী নদীর তীরে পুঞ্চা থানার বুধপুর গ্রামে মাকুড়ি মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। ফি-বছর সরস্বতী পুজোর একদিন পরে নদীর চরে মেলা বসে। প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা জু়ড়ে মেলা বসে। প্রায় চল্লিশ হাজার লোক সমাগম হয় মেলায়। মাকুড়ি মেলার চরিত্র পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা মেলার মতোই। প্রচুর খাবার দোকান, সস্তার মনোহারি, সংসারের প্রয়োজনে লাগে এই রকম বহু দোকান বসে। মেলার মেয়াদ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। মানভূমের প্রাচীন মেলা এটি। কংসাবতী নদীর এই ঘাটে সিজানোর পরদিন স্নান করানোর রীতি ছিল। অনেকেই এই রীতি এখনও মানেন।
মাহেশের মেলা
মাহেশের রথযাত্রা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ধরা হয়। বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব এটি। এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর শহরের মাহেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। রথযাত্রার সময় মাহেশের স্নানপিড়ি ময়দানে এক মাস ধরে মেলা চলে। বহু মানুষ আসে এই মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে।
জয়চণ্ডীর কোলে মেলা
শীতের জমজমাটে এখানে হয় উৎসব। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে জয়চণ্ডী পাহাড়ের মাথায় উঠে মেলা দেখার আকর্ষণ। কনকনে হিমেল হাওয়ায় নীল আকাশের কাছাকাছি বসে মেলা। একটু উঁকি দিয়ে মেলার হরেক রং উপভোগ করা। অন্য স্বাদ এই মেলার। পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়। প্রতি বছর শীতে যেখানে পর্যটন উৎসবে হাজির হন ভ্রমণপাগল মানুষ। প্রকৃতির সঙ্গে মেলার রং মেশে এখানে। ১৫ বছরে পা রাখল এই মেলা। জয়চণ্ডীর পর্যটন উৎসবে এসে পর্যটকেরা সটান উঠে পড়ছেন পাহাড়ে। উপর থেকে দেখছেন মেলা। সত্যজিৎ রায়ের হীরকরাজার দেশে এই মেলার জাঁকজমকই আলাদা ছিল। রঘুনাথপুর শহরের গা-ঘেঁষে থাকা জয়চণ্ডী পাহাড়ে হীরকরাজার দেশে ছবির শ্যুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তবে তার আগে ১৯৬৯ সালে তৈরি হয়েছিল গুপি গাইন বাঘা বাইন। শিরশিরে বাতাসে মাঠ জুড়ে আর পাঁচটা মেলার মতো বিনোদনের পশরা বসে। তিনদিনের মেলা বসে জানুয়ারিতে।