এবার খেলা হবে

৪০০ দূর অস্ত্, ২০০ পেরোতে হিমশিম খাবে বিজেপি। বাংলাতেও তাদের আসন আগের বারের চেয়ে অর্ধেক হবে কিনা সন্দেহ। বিশ্লেষণ করে বোঝাচ্ছেন ড. কল্যাণ গোস্বামী

Must read

সাত দফা লোকসভা নির্বাচন ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে। ভোটের ফলাফল জানা যাবে ৪ জুন তারিখে। এবারে নির্বাচনের দিন ঘোষণার বহু আগেই লোকসভায় নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন, ‘বিজেপি একাই জিতবে ৩৭০ আসন। আর এনডিএ জোট ৪০০ পার করবে।’ সেদিন থেকেই গোদি মিডিয়া এবং বিজেপির প্রচারের বদান্যতায় যে কেউ এ-মুহূর্তে ভেবে বসতেই পারে যে নির্বাচনটা হয়ত হয়েই গেছে। ৪ জুন তারিখে ভোটের ফলাফল যেন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই তাই?

আরও পড়ুন-স্বপনের চাটাইয়ে চমক

বোধ হয় তা নয়। আসুন, একটু তলিয়ে দেখা যাক।
এবারের নির্বাচনে পুলওয়ামা এবং বালাকোটের মতো ইস্যু নেই। রামমন্দির নির্মাণের প্রভাব হিন্দি বলয়ে যতটা ভাবা গেছিল তার ভগ্নাংশও বাস্তবে দেখা যায়নি। অপরদিকে এ-মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি তলানিতে। বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতের অবস্থা সঙ্গীন। মোদির জনসভায় লোকসমাগম ২০১৯-এর ধারেকাছেও নেই। পাশাপাশি এটা পরিষ্কার যে বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থান এবার লোকসভা নির্বাচনে মূল ইস্যু হতে চলেছে। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি CSSD-এর সার্ভে’তেও। CSDS-লোকনিতি প্রাক-নির্বাচন যে সমীক্ষা প্রকাশ করেছে তাতে উত্তরদাতাদের অর্ধেকেরও বেশি দেশে মূল্যবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রায় ৬২% উত্তরদাতারা দাবি করেছেন যে চাকরি পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রায় ৭১% ভোটার বলেছেন যে পণ্যের দাম বেড়েছে। মোদিজি ফলাও করে স্বচ্ছ প্রশাসনের কথা বললেও ৫৫ শতাংশ লোক বলেছেন যে গত পাঁচ বছরে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে!
এরই সমান্তরালে ভোটের ঠিক আগে আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত বুমেরাং হতে পারে। সিএএ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে বাংলা ও আসাম থেকে। সিএএ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছে। তাঁরা এই ভেবে আতঙ্কিত যে ৪-৫ দশক ধরে দেশের নাগরিক হিসেবে বাস করে হঠাৎ করে নিজেদের শরণার্থী ঘোষণা করে অনর্থক বিপদের মধ্যে পড়তে হবে। পাশাপাশি হাজার হাজার আধার কার্ড ক্যানসেল হওয়ার ঘটনাটিও আতঙ্কের বিস্তার ঘটিয়েছে। সব মিলিয়ে সিএএ ইস্যু বিজেপি পক্ষ থেকে সমর্থন সরিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরদিকে জনগণকে স্বস্তি দিতে লোকসভা ভোটের আগে রান্নার গ্যাসের দাম কমানোর কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আম জনতার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। ওঁর কাজকর্ম ওঁর গ্যারান্টিগুলোকে জুমলায় পরিণত করেছে। লোকসভার পর আবার নিশ্চিতভাবে গ্যাসের দাম বাড়বে, তাই এটা যে গিমিক ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটা ধীরে ফেলেছে সাধারণ মানুষ।

আরও পড়ুন-প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে সোজাসাপটা কীর্তি

পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু মিডিয়া গোষ্ঠী এবং মার্কেট সার্ভে সংস্থা বিজেপির হয়ে বকলমে প্রচারের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিজেপির ভুল প্রার্থী চয়ন, দলীয় কোন্দল, পুরোনো বিজেপি নেতাদের ছেঁটে ফেলার প্রয়াস, এই তিনটি বিষয়ের নেতিবাচক প্রভাবে বঙ্গ বিজেপি সর্বনাশের মুখোমুখি। রাজ্যে সংগঠন মজবুত না করে শুধুমাত্র মতুয়া রাজবংশী আদিবাসী বা নেপালি ভোট ব্যাঙ্কের ভরসায় থাকার কারণে বিজেপি বেশ কয়েকটি জেতা আসন হারাতে চলেছে। যে আসনগুলোতে বিজেপি কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি, সেগুলোর মধ্যে আছে হুগলি, বিষ্ণুপুর, ব্যারাকপুর, রানাঘাট, মালদা (উত্তর), বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি! ফলত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আগের বারের তুলনায় অর্ধেক আসন পাবে।
এমতাবস্থায় সংখ্যার হিসাবটা বুঝে নেওয়া যাক।
হিন্দি বলয়ের দশ রাজ্যে মোট ২২৫ আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি জিতেছিল ১৭৭ আসনে। হিন্দি বলয় মানে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, দিল্লি আর রাজস্থান। এর মধ্যে হরিয়ানার দশটি আসনের সব ক’টিতেই জিতেছিল বিজেপি। স্ট্রাইক রেট একেবারে ১০০ শতাংশ। যেমন জিতেছিল দিল্লির ৭টি, হিমাচলের ৪টি এবং উত্তরাখণ্ডের ৫টি আসনের সব ক’টিতে। রাজস্থানে ২৫-এর মধ্যে পেয়েছিল ২৪টি আসন। মধ্যপ্রদেশে ৩৯-এর মধ্যে ২৮। ছত্তিশগড়ে ১১-র মধ্যে ৯। ঝাড়খণ্ডে ১৪-র মধ্যে ১১। বিহারে ৪০-এর মধ্যে ১৭। এবং উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৬২টি আসন! এবারে হিন্দি বলয়ে এর চেয়ে ভাল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বরঞ্চ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় হিমাচল বিহার এবং রাজস্থানে বিজেপি ৪২-৪৪টি আসন হারাবেই হারাবে!

আরও পড়ুন-স্বপনের চাটাইয়ে চমক

হিন্দি বলয়ের বাইরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পাঞ্জাব, অসম, পশ্চিমবঙ্গ এবং কর্নাটকের মতো ছয় রাজ্যে ১৯২টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১১১টি আসন। এই ছ’টি রাজ্যে বিজেপি ৩০-৩২টি আসন হারাবে। শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটকেই হারাবে ২২টির মতো আসন। সংক্ষেপে, হিন্দি বলয় এবং তার বাইরে এই রাজ্যগুলি মিলিয়ে ৪১৭টি আসনে বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ২৮৮। রইল বাকি দক্ষিণ ভারত। কর্নাটক বাদে দক্ষিণের চার রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ (২৫), তেলেঙ্গানা (১৭), তামিলনাডু (৩৮) এবং কেরালা (২০) মিলিয়ে মোট আসন ১০০। গতবার দক্ষিণ ভারতের এই চার রাজ্যে একশো আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল মাত্র ৪টি আসনে। এবার সেটা বেড়ে খুব বেশি হলে ৬-৭টি হতে পারে। মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে বাকি রইল ২৪টি। সেখান থেকে বিজেপি খুব বেশি হলে কয়েকটি মাত্র সিট জিততে পারে। সুতরাং এবার বিজেপির নিজের প্রাপ্ত আসন ২১০-২২০ মধ্যেই থাকবে! তার বেশি নয়।

আরও পড়ুন-প্রার্থী অরূপের হয়ে প্রচারে ঝাঁপাল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ

তাই, যতই মিডিয়ার পক্ষ থেকে ‘আয়েগা তো মোদি-হি’র ঢাক বাজানো হোক, ভোটারের মন পড়ে আছে বেকারত্ব আর মুদ্রাস্ফীতিতে। জনগণের এই মেজাজ যদি ইভিএম-এ প্রতিফলিত হয়, তবে বিজেপির দশা হতে পারে ঠিক ২০ বছর আগের (২০০৪) ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র বিপর্যয়ের মতো। যদিও জেতার জন্য বিজেপি সবরকমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, মোদি-শাহের সভা হচ্ছে ঘন ঘন। ইভিএম-এর কেরামতি বলে যদি কিছু না থাকে তবে নরেন্দ্র মোদিজির তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিশ্চিতভাবে চুরমার হতে চলেছে। অন্যদিকে, অত্যধিক মোদি ন্যারেটিভের কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছে আরএসএস এবং দল হিসেবে বিজেপি।

Latest article