“আমি কবিয়াল
ঈশা খাঁর বাড়িতে আছি বহুকাল
আমার কথা রাইখ্যা দিলাম
আসল কথায় ফিরি
চন্দ্রাবতীর দুঃখের পালা অহন শুরু করি
কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারি গ্রামের আসল ঘটনা
ঐতিহাসিক সত্যপালা আছে সবার জানা
দ্বিজবংশী ঠাহুর গাইও মনুসার ভাসান
ইতিহাসের পাতায় বংশীর আছেন অবদান
বংশীদাশের প্রাণের কইন্যা কবি চন্দ্রাবতী
কিশোরগঞ্জের মাটির গন্ধে পাই তাঁর গীতি।”
এটুকু পড়ে বোঝা যাচ্ছে এটি একটি পালা গানের গৌরচন্দ্রিকার প্রথম অংশ। পালাকার এখানে বংশীদাসের প্রাণের কন্যা কবি চন্দ্রাবতীর কথা বলছেন। ইতিহাস বলছে, ঈশা খাঁ ছিলেন ১৬ শতকের বারো ভুঁইয়ার একজন অন্যতম ভুঁইয়া। তাঁর আধিপত্য ছিল অবিভক্ত ভারতের খিজিরপুরে, যা বর্তমানে সোনারগাঁও নামে পরিচিত। অর্থাৎ গীতিকার বা পালাকার সেই সময় এই পালাটি রচনা করেছিলেন, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে চন্দ্রাবতী নাম্নী এক কবি।
অবিভক্ত বাংলায় নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকতাকে ভেদ করে হাতে গোনা যে তিনজন নারীর স্বর শোনা গেছে,তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই চন্দ্রাবতী, বাংলার প্রথম নারী কবি। বাকি দুজন হলেন, চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামতারা বা রামী এবং শ্রীচৈতন্যের কৃপাপাত্রী মাধবী।
ষোড়শ শতকের মনসামঙ্গল-এর কবি দ্বিজ বংশীদাস আর সুলোচনা দেবীর কন্যা তিনি। জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারি গ্রাম। যে যুগে নারীর জন্য বিদ্যাচর্চা কিংবা কাব্যচর্চা খুব সহজ ঘটনা ছিল না, সে যুগে তিনি স্বীয় প্রতিভা আর সৃজনশীল শক্তিতে রচনা করে গেছেন মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান)-এর মতো লোকগীতিকা, পালাকাব্য, গান ও রামায়ণকাহিনি। তাঁর প্রতিটি গীতিকাই ছিল কথ্য ভাষায় লেখা, অতিরিক্ত বিশেষণ বর্জিত ও সহজ সরল, সাধারণ মানুষের বোঝার মতো।
চন্দ্রাবতীর সৃজনপ্রতিভার বাইরে অবশ্য ব্যক্তি চন্দ্রাবতীর জীবন এবং তাঁর প্রেমশোকগাথা লোক-সাহিত্যে বেশি প্রচলিত। কবির মৃত্যুর পর ‘চন্দ্রাবতী’ পালা রচনা করেছিলেন নয়নচাঁদ। শুরুতেই পালাটির বন্দনা অংশে গায়ক-পালাকার বিজয়কান্তি দাশ-এর পরিবেশনটি তার-ই চিহ্ন বহন করে।
‘চন্দ্রাবতী’ পালা থেকে জানা যায়, চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ ছেলেবেলা থেকেই একত্রে বেড়ে ওঠেন, বড় হয়ে তাঁরা একে অপরের প্রেমে আবদ্ধ হন। অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ে ঠিক করা হল। আর সেদিনই সংবাদ এল, আশমানি নামে মুসলিম এক নারীর প্রতি আসক্ত জয়ানন্দ। কাজি সাহেব তা জেনে আশমানি ও জয়ানন্দের বিয়ে দিয়ে দেন। এই বিয়ের জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জয়ানন্দ হলেন জয়নাল। ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রাবতী নিদারুণ আঘাত পান। তাঁর পিতা তখন তাঁকে শিবপুজো আর ‘রামায়ণ’ রচনার উপদেশ দেন। এর পর জয়ানন্দ প্রেমিকার কাছে ক্ষমা চাইতে আসেন। কিন্তু পিতার আদেশে তাঁকে দেখা দেন না চন্দ্রাবতী। ফিরে গিয়ে জয়ানন্দ স্থানীয় নদী ফুলেশ্বরীতে আত্মহত্যা করেন।
আরও পড়ুন: সৌরমণ্ডলে প্রোবা-৩
এদিকে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী দ্বার পরিষ্কার করার জন্য কলসী কাঁখে জল আনতে ঘাটে পৌঁছে দেখলেন জয়চন্দ্রের প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে৷ তখন তিনিও পরলোকে চিরমিলনের কামনায় জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।
তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় (ফাল্গুন ১৩২০ বঙ্গাব্দ/ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ) চন্দ্রকুমার দে তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ “মহিলা কবি চন্দ্রাবতী”-তে লিখেছিলেন, “বনে অনেক সময় এমন ফুল ফুটে, রাজোদ্যানেও তাহার তুলনা মিলে না, বনের ফুল বনে ফুটে, বনেই শুকায়। চন্দ্রাবতী এইরূপ একটি বনফুল, ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে, একসময় এই সুরভী কুসুম ফুটিয়াছিল।”
‘বসুমতি কয়, মাগো আইস আমার কোলে
দুঃখিনী কন্যারে লয়্যাগো
আমি যাইব পাতালে
সুখে থাউক রাজা রামগো রাইজ্য প্রজা লয়্যা
আমার কন্যা সীতারে আমিগো
লয়্যা যাই চলিয়া’
সাত কাণ্ড রামায়ণের বদলে তাঁর ‘রামায়ণ’ তিন খণ্ডে বিভক্ত। চন্দ্রাবতী এর সমাপ্তি টেনেছেন বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক নির্মমতা থেকে নিপীড়িত-অপমানিত সীতাকে পৃথিবী-প্রকৃতির বুকে টেনে নেওয়ার দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে। তিনি সীতার কাহিনিকে নারীজীবনের আনন্দ–বেদনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করে একে নারীর রামায়ণী গানে পরিণত করে নিজের মতো লেখেন। এখানে রাম নয়, রাবণ প্রধান, সীতা বাদে আর দুটি মুখ্য চরিত্র ঊর্মিলা ও রামের বোন কুকুয়া। মহাকবি বাল্মীকি যে অনুক্রমে রামায়ণ লিখেছিলেন, তখনকার দিনে কোনও কবিই সেই অনুক্রম ভাঙতে সাহস দেখাননি। ব্যতিক্রমী তিনিই। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার পাতাল প্রবেশ ঘটে এবং তাঁর দুঃখ শোক অপমান চাপা পড়ে যায় পুরুষের বয়ানে, কোনও প্রতিবাদ আসে না সমাজ থেকে, তখন চন্দ্রাবতীর রামায়ণে সীতার যন্ত্রণা ক্ষোভ যেন চ্যালেঞ্জ জানায় গোটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকেই। একই সাথে মধ্যযুগে নারীর পৃথক ক্ষমতায়নের মুখও হয়ে ওঠে তাঁর কলম।
চন্দ্রাবতী ৬৮৪ লাইনে রামায়ণ লিখেছেন। ঐ শতাব্দীতেই তেলুগু ভাষায় কুম্ভকার কন্যা মোল্লা রচনা করেছিলেন, “রামায়ণ-সুধামাধুরী”। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তা পাঠ করতে চাননি, কারণ মোল্লা শূদ্র এবং নারী। এর প্রায় চারশো বছরের কিছুদিন পরে তেলুগু ভাষাতেই রঙ্গনায়কাম্মা “রামায়ণ বিষবৃক্ষম” রচনা করলেন।
অবশ্য সাহিত্য-দরবারে চন্দ্রাবতীর স্বতন্ত্র রামায়ণপালাটি স্থান পায়নি কখনও, কিন্তু সমাজের বৃহত্তর নিম্নবর্গের পরিসরে, বিশেষত পল্লিসমাজের নারীর ঘরোয়া রামায়ণী আচার-অনুষ্ঠানে আজও আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত এই লোক-রামায়ণ পালাগান পরিবেশিত হয়। চন্দ্রকুমারের ভাষায়, “… চন্দ্রাবতী পূর্ব ময়মনসিংহের সর্বসাধারণের প্রাণের কবি ছিলেন। বহুদিন হইতে শুনিয়া আসিতেছি— মাঠে কৃষকের, শিশুর মুখে মুখে, আঙ্গিনায় কুলকামিনীদের মুখে, ঘাটে-বাটে, মন্দিরে, প্রান্তরে, বিজনে, নদীর পুলিনে সেই সঙ্গীত; বিবাহে, উপনয়নে, অন্নপ্রাশনে, ব্রতে, পূজায় সেই সঙ্গীত ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া কানে আসিয়া বাজে, … “সর্বসাধারণের কবি চন্দ্রাবতীর লেখনী তাই নিঃসন্দেহে আপামর নারীর তথা সাধারণ মানুষের নিজস্ব যন্ত্রণা, সুখ দুঃখ, আনন্দের ব্যক্তিগত স্বর।