”সরফরোশী কী তমন্না”

ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ভগৎ সিং। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

Must read

ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ভগৎ সিং। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁর ফাঁসি হয় ২৩ মার্চ— অভাবনীয়ভাবে নির্ধারিত দিনের ৬ দিন আগেই। বীর শহিদকে স্মরণ করলেন ড. অন্বেষা আচার্য

১৯১৯ সালের ১৪ এপ্রিল। স্কুল যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল একটি বারো বছরের ছেলে। ছেলেটি পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে, লাহোরের দয়ানন্দ আঙ্গলো বিদ্যালয়ে। কিন্তু তার ফেরার সময় অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরেও সে যখন বাড়ি ফিরল না তখন পরিবারের প্রত্যেকে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অনেক দেরিতে ছেলেটি বাড়ি ফিরল। বোন অমর কাউরের প্রশ্নের উত্তরে বিষণ্ণ ছেলেটি বলল, ‘খাবার কথা বোলো না আমাকে। এস তোমাকে একটা পবিত্র জিনিস দেখাই। দেখ ইংরেজরা আমাদের কত মানুষকে হত্যা করেছে। দেখ তাদেরই রক্তমাখা মাটি। এ পবিত্র মাটি।’ বলে উঁচু করে দেখাল তার হাতের একটি শিশি, যার মধ্যে রয়েছে রক্তে-ভেজা মাটি, জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি। তার ঠিক একদিন আগে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে সংঘটিত হয়েছিল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। লাহোর থেকে অমৃতসর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটারের পথ। ছেলেটি এই দীর্ঘ পথ নানা ভাবে একা অতিক্রম করেছিল শুধু মাত্র শহিদদের রক্তে-ভেজা মাটিকে স্পর্শ করার জন্য। তার সমস্ত অন্তরাত্মায় সেদিন একটাই প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারিত হয়েছিল, ‘বলিদান চাই, বলিদান।’ ভারতবাসী হিসেবে এই নৃশংস ঘটনা সে কোনওদিন ভোলেনি। এই মুহূর্তে থেকেই জন্ম হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দলনের এক মহৎ বিপ্লবী শহিদ ভগৎ সিংয়ের।

আরও পড়ুন-করোনা : মহা সংক্রামক নয়া ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে সতর্ক করল হু

পরিচয় ও শিক্ষা
ভগৎ সিংয়ের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর (কারও কারও মতে ৫ অক্টোবর) পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বাঙা গ্রামে। বাবা কিষণ সিং। মা বিদ্যাবতী দেবী। তাঁর আরও চার ভাই ও তিন বোন ছিল। কাকা অজিত সিং ও স্বর্ণ সিং দুজনেই ছিলেন বিপ্লবী। তাঁর জন্মের আগে তাঁর বাবা ও দুই কাকাই ছিলেন জেলে। কিন্তু তাঁর জন্মের দু’একদিন আগে তিনজনেই অপ্রত্যাশিতভাবে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। ঠাকুমা খুশি হয়ে নবজাতকের নাম রাখলেন ভগনওয়ালা অর্থাৎ বংশের ভাগ্যবান সন্তান। এই ভাগ্যবান সন্তানটি যে অল্পদিনের মধ্যেই দেশের জন্য ফাঁসিকাঠে প্রাণ দেবে, তা তাঁর ঠাকুমা সেদিন কল্পনা করেননি। কিন্তু ভগতের জন্মই যে বিপ্লবের আঁতুড় ঘরে! তাঁর পরিবারকে বলা যায় গদর পার্টির ক্যাম্প অফিস। ছোট থেকেই তাঁর স্বপ্ন, সে বিয়ে করবে না, ইংরেজকে দেশ থেকে তাড়াবে।

আরও পড়ুন-রহস্য! আচমকাই মৃত্যু হল আরিয়ান মামলার সাক্ষীর

পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক। কিন্তু দেশের প্রবহমান রাজনৈতিক ঘাত-সংঘাত ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ন্যাশনাল কলেজের ছাত্র। এখানে এসেই তাঁর নিজস্ব স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটতে থাকে। শুরু হয় নিজস্ব পড়াশোনা যা তাঁর সিলেবাসের বাইরের। তরুণ বয়সেই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন হিন্দি, ইংরেজি, সরফরোশী-কী-তমন্নাউর্দু ও সংস্কৃত ভাষা। তাঁর পড়াশোনার পরিধির মধ্যে ছিল তলস্তয়, ভিক্টর হুগো, আনাতোল ফ্রাঁশ, আপটন সিনক্লেয়ার, ডিকেন্স, ভল্টেয়ার, তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি, গোর্কি ও বার্নার্ড শ। এ-ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের রচনার সঙ্গেও পরিচয় ছিল তাঁর। এ-সময় তাঁর দিন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে, কিন্তু তাঁর পকেটে সবসময় থাকত কোনও না কোনও একটা বই।

আরও পড়ুন-যান্ত্রিক ত্রুটি ইন্ডিগোর বিমানে, পাইলটের তৎপরতায় রক্ষা

রাজনীতিতে যোগদান
১৯২১-এ গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সারা দেশের তরুণ চরমপন্থীরা খুব হতাশ হন। তাঁদের মনে হল সশস্ত্র বিপ্লবের পথেই স্বাধীনতা আসবে। যতীন দাস, যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, শিব ভার্মা প্রমুখ বিপ্লবীরা ছিলেন এই ভাবনার শরিক। এই সশস্ত্র আন্দোলনের দুটি ধারা ছিল, একটি বাংলার ও অন্যটি উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও বিহারের সম্মিলিত ধারা। আর এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল নিবিড়।

আরও পড়ুন-কলেজ ছাত্রদের রাজনীতির পাঠ

১৯২৩ সাল পর্যন্ত তরুণ বিপ্লবীরা অহিংসা নীতিতে পুরোপুরি অনাস্থা প্রকাশ না করলেও ১৯২৪ সালে কানপুরে ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হবার পর তাঁরা এক নতুন দিশার সন্ধান পান। ওই সালেই ভগৎ ‘অর্জুন’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। পরে কানপুরে এসে তিনি ‘প্রতাপ’ পত্রিকায় যোগ দেন। এখানেই তাঁর পরিচয় ঘটে বটুকেশ্বর দত্ত ও চন্দ্রশেখর আজাদের সঙ্গে। এরপর ১৯২৫ সালে ভগত সিং ও শুকদেব মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নওজোয়ান ভারত সভা’ যার উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবের বাণী দেশের মানুষের ও শ্রমিক কৃষকদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া। লায়ালপুরে নওজোয়ান ভারত সভার অধিবেশনে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পেয়ে প্রথমে কানপুরে ও পরে অমৃতসরে ফিরে আসেন। এখানে ফিরে তিনি ‘কীর্তি’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। এর পাশাপাশি চলত তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। তার এই কর্মকাণ্ড পুলিশের নজর এড়ালো না। অচিরেই গ্রেফতার হলেন তিনি। একবছরের কারাবাস কাটিয়ে তিনি চলে আসেন লাহোরে, শুরু করেন দুধের ব্যবসা। আড়ালে চলতে থাকে ভারত সভার কাজ। এতে তাঁর প্রতি পুলিশের নেকনজর এতটাই বেড়ে যায় যে তিনি আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন-স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক হল মোদি, বললেন শত্রুঘ্ন

দশেরা বোমা মামলা
১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসে লাহোরের দশেরার মেলায় একটি বোমা নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনায় ১৯২৭ সালের মে মাসে সন্দেহের বসে ভগৎ সিংকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে তাঁর বিপ্লবী দলের গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে বিবৃতি দেবার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করে বলা হয়, যদি তিনি পুলিশের দাবি না মানেন, তবে কাকোরি ডাকাতি কেস, দশেরা মেলার বোমা মামলা ইত্যাদি দুষ্কর্মের জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আসামি হিসেবে তাঁকে দাঁড় করানো হবে, যার পরিণতি অবধারিত ফাঁসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট হয়রানি করার পর পুলিশ কেস তুলে নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও মামলা দায়ের করতে না পারলেও তাঁকে গ্রেফতার করে রাখে।
লাজপত রায়ের মৃত্যু ও স্যান্ডার্স হত্যা

আরও পড়ুন-স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক হল মোদি, বললেন শত্রুঘ্ন

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাইমন কমিশনের সদস্যরা বোম্বাই শহরে আসায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। লাহোরে এই কমিশন-বিরোধী গণ-আন্দোলনের দায়িত্বে ছিল ভারত সভা। লাহোরের পথে পথে প্রবল গণ-বিক্ষোভ শুরু হল। পথে নামলেন বৃদ্ধ পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপত রায়। ডেপুটি সুপার স্যান্ডার্স নিজের হাতে লাঠি নিয়ে পুলিশ-সহ আক্রমণ করলেন লালা লাজপত রায়কে ঘিরে থাকা জমায়েতের ওপর। এই আক্রমণে লালাজির মাথায় ধরে রাখা ছাতা ফেটে গেল, আর তাঁর মাথায়, কাঁধে পড়তে থাকল অবিরাম লাঠির আঘাত। স্তম্ভিত আহত লালাজি পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে ঘৃণার সঙ্গে বললেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে আমাকে আঘাত করার অর্থ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা।’ ১৯২৮-এর ১০ নভেম্বর মৃত্যু হয় লালাজির।

আরও পড়ুন-চা-শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক, মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাস শ্রমমন্ত্রীর

বিপ্লবীদের প্রতিশোধ
১৯২৮-এর ২০ ডিসেম্বর লাহোরের ‘মজংগ’ মহল্লার এক বাড়িতে হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আসোসিয়েশনের একটি গোপন সভায় সিদ্ধান্ত হয় পুলিশ এসপি স্কট ও ডেপুটি সুপার স্যান্ডার্সকে হত্যা করা হবে। তবে স্কটই হবে মূল লক্ষ্য। এদের গতিবিধি লক্ষ্য করার কাজে নিযুক্ত জয়গোপাল স্কটকে চিনতেন না, তাই স্কট ও স্যান্ডার্স-এর মধ্যে তিনি গুলিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত নিহত হলেন স্যান্ডার্স। ভুলের কারণে বেঁচে গেলেন স্কট। রাজভক্ত সিপাই চন্দন সিং চন্দ্রশেখর আজাদকে তাড়া করলে তিনি বাধ্য হয়েই গুলি চালান ও চন্দন সিং মারা পড়েন।
দিল্লির আইন সভায় বোমা নিক্ষেপ :
১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল। দিল্লির আইন সভার অ্যাসেম্বলি হল। সেদিন পাশ হবে ‘পাবলিক সেফটি বিল’ যার উদ্দেশ্য এ দেশে সংগঠন ও প্রচারের কাজে আসা বিদেশি নেতা ও সংগঠকদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা ও ট্রেড ডিসপিউট বিল, যার উদ্দেশ্য দেশের শ্রমিক আন্দোলনকে ধ্বংস করা। দিল্লির কেন্দ্রীয় আইন সভার সব সদস্য, সংবাদপত্র ও জনমত এর বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও এটি আইন সভায় পাশ করবার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার।

আরও পড়ুন-দুধের সহায়ক মূল্য বাড়াল রাজ্য সরকার

ভগৎ ও বটুকেশ্বর দত্ত সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে ওইদিন হলের মধ্যে আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটি স্থানে এসে বসলেন। ঠিক হয়েছিল বোমাটি ফেলা হবে জন স্যুস্টারের চেয়ারের পিছন দিকে, যাতে ক্ষতির সম্ভাবনা কম হয়। ভিড়ে ঠাসা অধিবেশন কক্ষে বিলগুলির আলোচনার শেষ মুহূর্তে সরকারি পক্ষের পিছনের বেঞ্চ থেকে প্রবল জোরে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল। অধিবেশন কক্ষ ধোঁয়ায় ভরে গেল। ভগৎ ও বটুকেশ্বর নিজের সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন আগেই। প্রথম বোমাটি ছুঁড়েছেন ভগৎ নিজেই। পরক্ষণেই বটুক ঠিক সেই একই জায়গা লক্ষ্য করে দ্বিতীয় বোমাটি ছুঁড়লেন। সভায় হুলুস্থুল পড়ে গেল। যে-যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে গেল। ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁরা উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিলেন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন স্লোগানের জন্ম হল, যা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অমোঘ মন্ত্র হয়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন-শুরু রমজান, শুভেচ্ছা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের

জেল-জীবন
গ্রেপ্তারের পর বিস্ফোরক আইন ভঙ্গ ও হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রহসন করে ব্রিটিশ সরকার। জেলে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর ভারতীয় রাজনৈতিক জেলবন্দিদের সঙ্গে নোংরা আচরণের বিরুদ্ধে ও রাজবন্দির অধিকারের দাবিতে এক ঐতিহাসিক অনশনের উদ্যোগ নেন এবং তাদের জন্য কিছু অধিকার আদায়ে সক্ষম হন। ৬৩ দিন অনশন করার পর যতীন দাস জেলেই মৃত্যু বরণ করেন।
ফাঁসি
বিচারের প্রহসনের শেষে ঠিক হয় ২৯ মার্চ, ১৯৩১-এ ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হবে। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে নির্ধারিত দিনের ৬ দিন আগে, ২৩ মার্চ বিকেল চারটে থেকেই সব বন্দিকে সেলে পুরে দেওয়া হয়। সকলের কাছে গোপনে খবর পৌঁছে যায়, সেদিনই সন্ধে সাতটায় ফাঁসি হবে তিনজনের। গভীর আক্ষেপের সঙ্গে সকলে সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে।
ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে জেলের অফিসার ভগৎ সিংকে ডাকতে এসে দেখেন, তিনি পড়ছেন লেনিনের জীবনী। তিনি বললেন, ‘সর্দারজি, ফাঁসি লাগানে কা হুকুম আ গয়া হ্যায়। আপ তৈয়ার হো যাইয়ে।’

আরও পড়ুন-স্থগিত জেলা আদালত আন্দোলন

ভগৎ সিংয়ের ডান হাতে বইটি ধরা ছিল, তিনি বাঁ হাতে তাঁকে থামিয়ে বলেন, ‘দাঁড়ান, একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আর এক বিপ্লবীর সাক্ষাৎকার চলছে।’ অফিসার একটু থতমত খেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। খানিক পরে ভগৎ সিং উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন’।
জেলের ঘড়িতে সন্ধ্যা ছ’টার ঘণ্টা বাজতেই সমস্ত সেলের বন্দিরা কান খাড়া করে অপেক্ষা করতে লাগলেন সেই চরম ক্ষণের। ভারী বুটের আওয়াজের সঙ্গে প্রথমে তাঁদের কানে ভেসে এল সেই পরিচিত গান— “সরফরোশী কী তামান্না আব হামারা দিল মে হ্যায়…।” এরপরেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জোর আওয়াজ উঠল, ‘‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’’ এবং “হিন্দুস্তান আজাদ হো’’। সারা জেলের সমস্ত বন্দি সমবেত কণ্ঠে গান ধরল, “মোহে রং দে মেরা বাসন্তী চোলা…”।
তিন বন্দিকে যখন ফাঁসির মঞ্চে তোলা হল তখন তাঁরা স্থির ও অচঞ্চল। তিনজন আলাদা আলাদা কাঠের তক্তায় দাঁড়ালেন পাশাপাশি। ভগৎ সিং ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এবার তাঁর মায়ের শেষ ইচ্ছামতো জীবনের শেষ স্লোগান তুললেন, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”। সারা জেল জুড়ে তাঁদের তিনজনের নামে জয়ধ্বনি উঠল। ফাঁসুড়ে একে একে তিনজনের গলায় ফাঁসির দড়ি পরাল। তাঁরা ফাঁসির দড়িকে চুম্বন করলেন। ফাঁসুড়ে তাঁদের জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মধ্যে আগে কে যেতে চাও? শুকদেব বললেন যে তিনিই আগে যেতে চান। এরপর ফাঁসুড়ে একে একে তিনজনের গলার ফাঁসির দড়িতে টান দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পায়ের তলায় কাঠের পাটাতনটিকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল। পরপর পাশাপাশি তিনজন শহিদ বহুক্ষণ ধরে দড়িতে ঝুলতে লাগলেন।

আরও পড়ুন-

জেল কর্তৃপক্ষ সেই রাতেই গোপনে ফিরোজপুরের কাছে শতদ্রু নদীর ধারে তিনজনকে কোনওরকমে দাহ করে তাঁদের আধপোড়া দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিল। রাতের অন্ধকারে কয়েকজন গ্রামবাসী রমণী তাঁদের দেহাস্থি গোপনে সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন। পরদিন তাঁদের স্টিকার সম্পন্ন হল।
পাঞ্জাবের ফিরোজপুরের ৬ মাইল দূরে শতদ্রু নদীর ধারের এই পবিত্র এলাকাটা ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তির ফলে ভারতের ভৌগোলিক সীমায় চলে আসে। ভগৎ সিংয়ের সমাধির পুণ্যতীর্থে আজও প্রতিবছর ২৩ মার্চ শহিদ দিবসে শহিদি মেলা হয় এই অমর শহিদের স্মরণে।
তথ্যসূত্র : ভগৎ সিং : ফিরে দেখা—সুরেশ কুণ্ডু।
ভগৎ সিং জেল ডায়েরি : তপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্তর্জাল।

Latest article