কথামুখ—
ভাগনি মিনুর হয়েছে মরণদশা। শ্যাম রাখি না কুল রাখি। মামার দিকে গেলে মামী অগ্নিশর্মা। মামির দিকে গেলে মামা কেমন চুপ মেরে যান। মামা-মামির নিত্য ঝগড়ার মধ্যে মিনু সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সারাক্ষণ। মামির বাক্যবাণ তাকে সহ্য করতে হয় কারণ অধিকাংশ সময় মিনু মামার পক্ষ অবলম্বন করে। এমন সময় গৃহশিক্ষকের কাজ নিয়ে মামা বিশ্বাসবাবু চলে এলেন পুরীতে। মামির সঙ্গে কলকাতাতেই মিনু। মেসবাড়ির ছোকরা পানুর গান শুনে মুগ্ধ হয় মিনু। স্বামীকে চোখের আড়াল রাখবেন না বলে মামি মিনুকে নিয়ে চলে এলেন পুরীতে। পুরীতে পৌঁছতেই দত্তবাবু নামের এক ভদ্রলোক তাদের নিয়ে এলেন নিজের হোটেল “সিন্ধুতটে”। বিশ্বাস গিন্নি ভাবেন এ দেশের লোক খুব ভাল। এরকম আতিথেয়তা তো কলকাতায় নেই। কিন্তু হোটেল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় দত্তবাবুর দেওয়া বিল দেখে বিশ্বাসগিন্নি বুঝতে পারলেন আতিথেয়তার রূপ। তখনই সংকল্প করলেন দত্তবাবুর নাকের ডগায় পুরীতে হোটেল খুলবেন। খুললেনও তিনি। “সাগরবেলায়”। হোটেল যাত্রী যারা আসেন তাদের সবাইকে ছল করে তাঁর হোটেলে নিয়ে গিয়ে তোলেন দত্তবাবু। মিনু কোনও কূলকিনারা খুঁজে পায় না। হঠাৎ সমুদ্রের ধারে পানুর সঙ্গে মিনুর দেখা। জানতে পারে দত্তবাবুর ছেলেই হল পানু। দত্তবাবুরর সঙ্গে বিশ্বাসগিন্নির যুদ্ধ যখন চরম পর্যায় তখন বলির পাঁঠা হয়ে উঠেছে এই মিনু। যে ছবির গল্প নিয়ে প্রস্তাবনা তার নাম “শেষ পর্যন্ত”। পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়। তিনি ইতিমধ্যে আমাদের শাপমোচন, পাশের বাড়ির মতো প্রচুর হিট ছবি উপহার দিয়েছেন। “শেষ পর্যন্ত” ছবিতে প্রচুর শিল্পী। ছবি বিশ্বাস, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুভা গুপ্ত, বিশ্বজিৎ, তরুণকুমার প্রমুখ। অসাধারণ অভিনেতা এঁরা। কিন্তু দর্শকদের নজর কাড়লেন মিনু চরিত্রের শিল্পী সুলতা চৌধুরি। অসহায় বিড়ম্বিত মিনুকে বাস্তবায়িত করে তুলেছিলেন সুলতা চৌধুরি।
আরও পড়ুন-মরুবিজয়িনী সুচেতা
জন্মকথা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ—
সুলতা চৌধুরির জন্ম ১৯৪৫ সালে কলকাতায়। পিতৃদত্ত নাম মায়া রায়চৌধুরি। বাবা অটলচন্দ্র রায়চৌধুরি। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে (নর্থ) পড়াশুনা করেছেন। নাচ-গানের প্রতি আকর্ষণের জন্য পড়াশুনায় বেশিদূর এগোতে পারেননি। ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন বাকসিদ্ধ, দেবর্ষি নারদের সংসার প্রভৃতি ছবিতে। ইতিমধ্যে পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তীর ভাই সদানন্দ চক্রবর্তীর সঙ্গে সংসার পাতলেন। এঁদের একটি কন্যা সন্তান আছে। সুলতার যোগাযোগ হল রূপমঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক চলচ্চিত্রে প্রভাবশালী সাংবাদিক কালীশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়ের কাছে সুপারিশ করে পাঠালেন সুলতাকে। সুলতা গেলেন। স্ক্রিন টেস্ট দিলেন। সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন। সুধীর মুখোপাধ্যায় নির্মীয়মাণ “শেষ পর্যন্ত” ছবিতে নায়িকা চরিত্রের জন্য তাঁকে নির্বাচন করলেন এবং মায়া নাম বদলে সুলতা নাম দিলেন। সুধীর মুখোপাধ্যায় তাঁকে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করলেন। পরিচালক-এর অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য কোনও ছবিতে কাজ করতে পারবেন না সুলতা। সময়সীমা হল ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত।
আরও পড়ুন-পেশায় এটিএম টেকনিশিয়ান
সত্যজিৎ রায়ের অফার ফিরিয়ে দিলেন সুলতা—
সত্যজিৎ রায় তাঁর তখনকার সময়ে নির্মিত “মহানগর” ছবির জন্য সুলতা চৌধুরিকে অফার দিয়েছিলেন। কিন্তু সুধীর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকায় সে কাজটি সুলতা করতে পারলেন না। তবে ওই সময়সীমার মধ্যে সুধীর মুখোপাধ্যায় যেসব পরিচালকের ছবিতে সুলতাকে কাজ করার জন্য ছাড় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মৃণাল সেন (অবশেষে), অগ্রগামী (কান্না ), কনক মুখোপাধ্যায় (মায়ার সংসার) প্রমুখ।
বিশ্বজিৎ-সুলতা জুটি—
“শেষ পর্যন্ত” ছবিতে রোম্যান্টিক জুটি হিসেবে বিশ্বজিৎ-সুলতা দর্শকদের যে ভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন, তার ব্যপ্তি ঘটল “মায়ার সংসার” ছবিতে। “মায়ার সংসার” ছবির রোম্যান্টিক নায়ক-নায়িকা বিশ্বজিৎ ও সুলতা। এ ছবিতে সুলতার লিপে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “বন্ধু তোমার হৃদয় দোলানো গানে” মুগ্ধ হলেন সবাই। সুধীর মুখোপাধ্যায়ের আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে এই নায়ক-নায়িকা জুটি বাঁধলেন। এর মধ্যে রয়েছে ত্রিধারা, দাদাঠাকুর, দুই ভাই। “দাদাঠাকুর” ছবিতে সুলতার লিপে “কণ্ঠে আমার কাঁটার মালা ফুলের মালা নয়” (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়) আজও জনপ্রিয়। দ্বৈত চরিত্রে একবারই অভিনয় করেছিলেন সুলতা। ছবির নাম হল “নতুন তীর্থ”। দুই বোন নয়না ও তনুজা যমজ। জন্মসূত্রে বিচ্ছিন্ন। পরে মিলন হচ্ছে। সুলতার বিপরীতে নায়ক উত্তমকুমার। নায়িকা পরিচালকের এই কেমিস্ট্রি পরিচালক-গিন্নি নীলিমা মুখোপাধ্যায় বরদাস্ত করতে পারেননি। ফলে “নতুন তীর্থ” ছবির পর সুধীর মুখোপাধ্যায়ের কোনও ছবিতে সুলতা কাজ করতে পারেননি। এরপর তিনি আরও দুটি ছবিতে নায়িকা হয়েছিলেন। কনক মুখোপাধ্যায়ের “মায়াবিনী লেন” ও অজিত গাঙ্গুলির “মুখুজ্যে পরিবার”। “মুখুজ্যে পরিবার” ছবিতে সুলতা ও লিলি দুই বোনের লিপে গানটি হল “আবিরে রাঙাল কে আমায়” (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সদ্যপ্রয়াত নির্মলা মিশ্র)।
আরও পড়ুন-নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ—
ষাটের দশকের শেষ থেকে শুরু হল সুলতার অভিনেত্রীর জীবন। সেখানে অধিকাংশ ছবিতেই তিনি খলচরিত্রে। দর্শকদের সেখানেও তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন ষোলআনা। “বাঘবন্দী খেলা”র কথাই ধরা যাক। লম্পট ভবেশ (উত্তমকুমার) মদ্যপান করে নিষিদ্ধপল্লির মেয়েকে (সুলতা) সোহাগে ভরিয়ে গাইছেন “আয় আয় আসমানী কবুতর” (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)। সতী-সাধ্বী স্ত্রী (শমিতা বিশ্বাস) চোখের জল ফেলছেন। “সন্ন্যাসী রাজা” ছবিতে রাজা সূর্যকিশোর (উত্তমকুমার)-কে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে ডাক্তারের (রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়) সাগরেদ হয়েছিলেন সুলতা। রৌদ্রছায়া, আলোর ঠিকানা, স্বয়ংসিদ্ধা, কায়াহীনের কাহিনি, মৌচাক, সেই চোখ ছবিগুলিতে নষ্টনারীর চরিত্রে নানারূপ তিনি তুলে ধরেছেন সাবলীলভাবে। তরুণ মজুমদারের সংসার সীমান্তে এবং ফুলেশ্বরীতে এমন চরিত্রে তিনি নজর কাড়েন বইকি। নষ্টনারী হওয়া সত্ত্বেও দর্শকের সম্ভ্রম আদায় করে নেন “জীবন-জিজ্ঞাসা” ছবিতে। সেখানে রাধাকে (সুপ্রিয়া দেবী) বাঁচাতে অ্যাডভোকেট ইন্দ্রনীলকে (উত্তমকুমার) সবরকম সাহায্য করেছেন সুলতা। এ-ছাড়াও নানান ধরনের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। সে তালিকায় আছে রূপসী, অগ্নিযুগের কাহিনি, সোনার খাঁচা, সব্যসাচী, বাবুমশাই, অনিন্দিতা, কবিতা, ভোলা ময়রা, দাদার কীর্তি, সুবর্ণগোলক, মধুময়, দেবিকা প্রভৃতি ছবি।
আরও পড়ুন-কমিশনের সুপারিশে অযোগ্য হেমন্ত, স্বামীর চেয়ারে কল্পনা
অন্যান্য মাধ্যমে অভিনয়—
উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপে কিছুদিন অভিনয় করেছেন। পেশাদারি মঞ্চে তাঁকে প্রথম পেলাম বিশ্বরূপা থিয়েটারে “আগন্তুক” নাটকে। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চের “বাঘিনি” নাটকে তিনি দুর্গা। বিপরীতে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। সারকারিনা মঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন “সম্রাট ও সুন্দরী” নাটকে।
শেষকথা—
১৯৯৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রায় নিঃসঙ্গ সুলতা চৌধুরি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। স্বর্ণযুগের বাংলা ছবির জগতের এই শিল্পীর অবদানকে স্মরণ করতেই হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে।