সত্যি কথাটা সাফ সাফ বলে ফেলাই ভাল। একেবারে শুরুতেই সেটা করা শ্রেয়।
ঠেলায় পড়ে চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মহান সাজার চেষ্টা ভারতীয় জুমলা পার্টির। ঘৃণা ভাষণে কার্যত মদত জুগিয়ে এখন যখন বিষয়টা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল তোলপাড়, তখন অসাম্প্রদায়িক সাজার নাটক করছে মোদি-শাহর দল। কতটা নির্লজ্জ, কতটা বেহায়া হলে, খুল্লম-খুল্লম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর পর দাঙ্গাবাজ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারিগররা এরকম ন্যাকামির ঘোমটা টানার নাটক করতে পারে!
বিজেপি যে কতটা দ্বিচারী, বিজেপি যে কতটা মিথ্যাচারী, বিজেপি যে কতটা দু’মুখো, সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় তাদের দলের সংবিধান।
আরও পড়ুন-বুঝে খান সুরক্ষিত থাকুন
নূপুর শর্মা। ভারতীয় জুমলা পার্টির জাতীয় মুখপাত্র। সপ্তাহখানেক আগে একটি টিভি শোয়ে মহানবি হজরত মহম্মদ সম্পর্কে তিনি অবমাননাকর মন্তব্য করেন। তখনও এ ব্যাপারে কোনও বিজেপি নেতাকে প্রতিবাদ করতে শোনা যায়নি।
নূপুর দেবীর বক্তব্যের নিরিখেই ট্যুইট করেন নবীন কুমার জিন্দাল। তখনও মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন তাঁরা, যাঁদের নিয়মিত ‘মন কি বাত’ শুনে শুনে দেশবাসী ক্লান্ত।
ওইসব ঘৃণা-ভাষণের জেরে কানপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়। সেখানে বেছে বেছে আটশোর বেশি সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানোর দায়ে গ্রেফতার করা হল। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হল জাতীয় নিরাপত্তা আইন। তখনও প্রতিক্রিয়া নেই জুমলা পার্টির রাঘববোয়ালদের তরফে। তারপর, যখন দেখা দিল কূটনৈতিক অস্থিরতা, ভারতীয় পণ্য অবরোধের ডাক দেওয়া হল, আরব দুনিয়া ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে সরব হল, তখন মৌন ব্রত ভেঙে, পিঠ বাঁচাতে, বিদ্বেষ সম্প্রচারক নূপুর-নবীনকে সাসপেন্ড-বহিষ্কারের রাস্তায় হাঁটল জুমলা পার্টি।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরার দুর্দশা নিয়ে “ত্রিপুরা ফাইলস” প্রকাশ তৃণমূল কংগ্রেসের
নূপুর-নবীনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দলীয় নীতি না মানার কথা বলছে বিজেপি।
কোন বিজেপি? যে বিজেপির দলীয় সংবিধানের ১১ নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, দলের লক্ষ্য হল সেরকম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ যেখানে জাতি বর্ণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিক রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার পাবেন, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সমানাধিকার লাভ করবেন এবং নিজ নিজ বিশ্বাস ও মতপ্রকাশের ব্যাপারে স্বাধীনতা পাবেন।
কোন বিজেপি? যে বিজেপি-র সদস্য হতে গেলে যে ফর্মটি পূরণ করতে হয়, সেটাতে লেখা থাকে, ‘‘আমি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করি এবং মানি যে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হবে না।’’ এই অঙ্গীকার করে ফর্মটিতে স্বাক্ষর করতে হয়।
এসব কথা যে কতবড় মিথ্যাচার তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের সময় যোগী আদিত্যনাথ মুসলমানদের কুকুরের সঙ্গে উপমিত করেন। মুসলমানদের অপরাধী, মাফিয়া এবং সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেন। তাদের ‘তালিবান’ বলে চিহ্নিত করেন। মুসলমানদের বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নিদান দেন।
আরও পড়ুন-কয়লা সঙ্কটের দায় কেন্দ্রেরই, মত বিশেষজ্ঞদের
বিজেপির সংবিধান ও বিজেপির কর্মীদের দলীয় অঙ্গীকারপত্র যে কতবড় মিথ্যাচার তা ফাঁস হয়ে যায় যখন গত মে মাসেই মধ্যপ্রদেশে ৬৫ বছর বয়সি, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ভাওয়ারলাল জৈনকে বিজেপি কর্মী দীনেশ কুশওয়া পেটাতে পেটাতে বলেন, ‘‘তোর নাম কী? তোর নাম ‘মহম্মদ’ না কী?… আধার কার্ড দেখা।’’ পরদিন সকালে ভাওয়ারলাল জৈনের মৃত শরীর উদ্ধারের পর নিমাচ জেলার বিজেপি সভাপতি সাফ জানান, দীনেশ কুশওয়া তাঁদেরই কর্মী আর পুলিশ জানায়, দীনেশের স্ত্রীও অতীতে বিজেপি-র সম্প্রচারক ছিলেন।
বিজেপির সংবিধানে ওইসব কথার উল্লেখ যে কতবড় দ্বিচারিতা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না যখন বিহারের বিজেপি বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর কোনও রাখঢাক না করে বলেন, যেভাবে বিজয়া দশমীয় দিন রাবণের কুশপুতুল পোড়ানো হয়, সেভাবেই মুসলমানদের পুড়িয়ে মারা উচিত। এর আগে, এই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে ওই মহান নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, দেশের সব মুসলমানদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন-কয়লা সঙ্কটের দায় কেন্দ্রেরই, মত বিশেষজ্ঞদের
বিজেপির সংবিধানে ওইসব বুকনি যে দলীয় কর্মীদের না-মানার জন্যই লেখা, তা গোপন থাকে না যখন ২০২১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিজেপি নেতা তথা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় হরিদ্বারের ধর্ম সংসদে মুসলমান নিধনের ডাক দেন। সেখানেই পূজা শাকুন পাণ্ডেকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আসুন, আমাদের মধ্যে থেকে অন্তত ১০০ জন ২০ লক্ষ মুসলমানকে খতম করে জেলে যাই।’’
বিজেপির সংবিধানের ওইসব ন্যাকামি ধরা পড়ে যায় যখন দলের মহিলা মোর্চার নেত্রী উদিতা ত্যাগী টিভি শোতেও মুসলমান নিধনের জন্য অস্ত্র তুলে নেওয়ার ডাক দেন। হিন্দু ধর্মকে বাঁচানোর জন্যই নাকি এটা দরকার বলে সওয়াল করেন।
বিজেপির ফর্মে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি যে কপট উচ্চারণ তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগরের বিধায়ক মায়াঙ্কেশ্বর সিং বলেন, হিন্দুস্তানের হিন্দুরা জেগে উঠে মুসলমানদের দাড়ি টেনে ধরে বলুক, ‘রাধে রাধে’ না বললে পাকিস্তানে চলে যাও।
আরও পড়ুন-বিমানের মতো নিয়ম এবার রেলেও, বেশি লাগেজ নিলেই গুনতে হবে জরিমানা
ফেকু জমানায় সংখ্যালঘু নিরাপত্তা যে নেহাতই কথার কথা তা অগোপন হয় যখন কর্নাটকের কোডাগু জেলায় বজরঙ্গ দলের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবিরের ছবি ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর এ-বিষয়ে তদন্তে নামার অপরাধে একজন পুলিশ অফিসারকে বদলি করে দেওয়া হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার বুকনি, সহিষ্ণু থাকার শপথ যে বিজেপির তরফে কত বড় নাটক তা বুঝতে অসুবিধা হয় না, যখন উত্তরপ্রদেশের একাধিক বিধায়ক, রাঘবেন্দ্র প্রতাপ সিং থেকে শুরু করে নন্দকিশোর গুর্জার, সবাই খোলাখুলি জানিয়ে দিতে ইতস্তত করেন না, যে বা যারা বিজেপিকে ভোট দেয় না, তারা হিন্দু নয় এবং তাদের বুলডোজারের মুখে পড়তেই হবে। একই কথা শোনা যায় তেলেঙ্গানার বিধায়ক টি রাজা সিংয়ের মুখেও।
আরও পড়ুন-গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কর্মশালা
আজ ফাঁদে পড়ে বগা কান্নার নাটক করছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে বেইজ্জতির পর দলীয় সংবিধানের মিথ্যাচারকে মুখোশ করে মুখ বাঁচাতে নেমেছে ভারতীয় জুমলা পার্টি।
কতগুলো মুখোশ পরলে তবে হাইড্রার সব ফণা আড়াল করা যায়? প্রশ্নটা সহজ। কিন্তু উত্তরটা এখনও অজানা।