থাবা বসল সিলেবাসে, ভুলতে হবে অনন্য অতীত

সিবিএসই সিলেবাস প্রণেতারা গেরুয়াপক্ষের যা কিছু চক্ষুশূল সেসব-কিছুতেই কাঁচি চালাতে ব্যস্ত। তাতে যদি ভারতীয় পরম্পরার একটা বড় অংশ শিক্ষার্থীদের অজানা থাকে, তবে তো সোনায় সোহাগা। সহিষ্ণুতার পাঠ ভুলিয়ে দিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য গুলিয়ে দিয়ে, সবকিছু গৈরিক রঙে রাঙানো যাবে। মোদির ভারতে শিক্ষার ওপর নেমে আসা আঘাতের ছবি তুলে ধরছেন ঋত্বিক মল্লিক

Must read

চোখ-কান বন্ধ করলেই যদি কোনোও কিছু পৃথিবী থেকে লোপ পেত তাহলে আজ থেকে হয়তো কিছু বছর পরে ২০১৪ সাল থেকে ভারতে বয়ে চলা সময়কে মানুষ স্রেফ চোখ বন্ধ করেই উপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। ইতিহাসে থেকে যাবেই ভারতের এই অন্ধকারময় অধ্যায়। অথচ এই অসম্ভব কাজটি করতে চাইছে আদপে হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সিবিএসই-র (CBSE) সিলেবাস প্রণেতারা।

আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি যে যা কিছু আরএসএস-এর চক্ষুশূল, যেমন ধরুন গণতন্ত্র ও বৈচিত্র্য, অসাম্প্রদায়িকতা, নির্জোট আন্দোলন, ঠান্ডা লড়াই আর সবচেয়ে অপছন্দের ইসলামের উত্থান, অ্যাফ্রো-এশিয়ান অঞ্চলসমূহ এবং ভারতে মুঘল আমলের ইতিহাস— এই সবই ছেঁটে ফেলা হয়েছে কেন্দ্রীয় বোর্ডের সিলেবাস থেকে। কৃষিনীতি নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে থাকা, পিছু হটা মোদি সরকার দশম শ্রেণির সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছে ‘কৃষিতে বিশ্বায়নের প্রভাব’ অংশটি। একইভাবে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আর পড়বে না ‘দারিদ্র্য আর পরিকাঠামো’ অধ্যায়টিও যা সাম্প্রতিক অতিমারির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

আরও পড়ুন – আমরা জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখি

এই ছেঁটে ফেলা অংশগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায় মোদি সরকারের অ্যালার্জি ঠিক কোন কোন বিষয়ে। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই তারা অস্বীকার করতে চায়, ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায় অন্য ধর্মের মানুষদের। তবে এই প্রচেষ্টা তাদের নতুন নয়। গত বছরই পাঠ্যসূচি থেকে বাদ গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, নাগরিকত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলো। প্রচণ্ড বিরোধিতার কারণে এই বিষয়গুলি আবার ফিরে আসে পাঠ্যসূচিতে। এই বছর সুযোগ পেতেই এনসিইআরটি-কে শিখণ্ডী করে আবার বাদ গেল নানা বিষয়।

আরও পড়ুন – চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আজ রিয়াল-ম্যান সিটি দ্বৈরথ

সারা দেশের শিক্ষকদের একটা বেশ বড় অংশ সরব হয়েছেন এর বিরুদ্ধে। সিবিএসই-র (CBSE) এই গা-জোয়ারি পাঠক্রমের ঠিক বিপরীত মেরুতেই রয়েছে পশ্চিমবাংলার রাজ্য বোর্ডের সিলেবাস। এই রাজ্যের পড়ুয়ারা সপ্তম শ্রেণিতেই পড়ে ফেলে ইসলামের উত্থান, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক জুড়ে তার অগ্রগতি, সেখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি। পরবর্তী সময়ের ভারতের সঙ্গে এর সংযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। অবশ্য যারা ভারতের মুঘল যুগকেই মুছে দিতে চাইছে তাদের কাছে সংস্কৃতির এই চলাচল কোনও অর্থই নিয়ে আসে না। দেশ জুড়ে পড়ুয়ারা জানবে না মুঘলদের নিয়ে, অথচ মুঘল সাম্রাজ্যের কীর্তিগুলো ছড়িয়ে থাকবে চোখের সামনে।

আরও পড়ুন – অম্বিকা ব্যানার্জীর প্রয়াণ দিবসে এবিসিএফ এর উদ্যোগে রক্তদান শিবির

একই কথা বলা যায় অসাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গেও। দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান বই থেকে বাদ পড়ল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনীতি’ অধ্যায়ে ফৈজ আহমেদ ফৈজের দুটি কবিতার নির্বাচিত অংশ। ফৈজ আহমেদের দুটি দোষ, একে পাকিস্তানি, তায় কমিউনিস্ট। মোদি সরকার আসার পর প্রায় এক দশক কাটতে চলল, তবু এতদিন তিনি যে ছিলেন সেটাই বরং আশ্চর্যের। এর পাশাপাশি যদি তাকানো যায় এই রাজ্যের দিকে, দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে রয়েছে অন্তত একজন অন্য প্রদেশের এবং অন্তত একজন অন্য দেশের সাহিত্যিকের লেখা।

বাংলাদেশের আল মাহমুদ, আশরাফ সিদ্দিকী, আবুল ফজল তো আছেনই, এ-ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্যিকদের লেখা অনায়াসে জায়গা করে নেয় এ রাজ্যের পাঠক্রমে। তবে, শুধু পাক-কবি ফৈজ কেন? গেরুয়া শিবির তো উপেক্ষা করতে চায় খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও! নিকট অতীতে বাদ গিয়েছিলেন তিনিও, তাঁর দোষ, তিনি বাংলা ভাষার লেখক। বিকৃত উচ্চারণে তাঁর লেখা উদ্ধৃত করা যায়, “চোলায় চোলায়” ভেরি বাজিয়ে অশ্লীল জয়যাত্রার সার্কাস করা যায়, কিন্তু সিলেবাসে তাঁকে জায়গা দেওয়া যায় না। গোটা দেশ যেখানে ধর্ম, ভাষা এবং সামাজিক গোঁড়ামির কারণে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে উঠছে, সেখানে পশ্চিমবাংলার মতো একটি অঙ্গরাজ্য উন্মুক্ত করে চলেছে তার ভাষা ও বোধের সীমানা।

আরও পড়ুন – সিবিআইয়ে মানুষের আর শ্রদ্ধা নেই: সুজিত

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে নির্জোট আন্দোলনকে ঘিরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কৃতিত্বও অবশ্যই পড়ুয়াদের সামনে আনা উচিত। শুধু কংগ্রেসের বিরোধিতার জন্যই বাদ গেল নির্জোট আন্দোলনের এই পর্ব যা কিনা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রক্ষিত হয়ে আছে এই রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সরকারি সিলেবাসে। কেন্দ্রের এই অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত কি নোংরা রাজনৈতিক চাল চালতে গিয়ে প্রকারান্তরে তাদের শিক্ষার্থীদেরই প্রতিযোগিতায় অনেকটা পিছিয়ে দিল না?

তাই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-কে মাথায় রেখে কোনওভাবেই তৈরি হতে পারে না রাজ্যের পাঠক্রমের রূপরেখা (স্টেট কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক)। এর জন্য প্রয়োজন রাজ্যের নিজস্ব শিক্ষানীতি, যাকে আমরা বলতে পারি স্টেট এডুকেশন পলিসি। সুখের বিষয়, এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর উদ্যোগে গঠিত হয়েছে এমনই এক কমিটি, যার সদস্যরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন এই রাজ্যশিক্ষানীতি প্রণয়নের। যেদিকে এগোচ্ছে আমাদের মোদি সরকারের শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা, তাতে অদূর ভবিষ্যতেই যে অন্ধকার নেমে আসবে শিক্ষাক্ষেত্রে, তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই প্রয়োজন এই রাজ্যের নিজস্ব একটি শিক্ষানীতি। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বৈচিত্র্যকে মাথায় রেখে রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকে আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনার সুফলকে এ রাজ্যের আঙিনায় নিয়ে আসাই আসলে বিজেপিপুষ্ট সিবিএসই-র এই উন্মাদের পাঠক্রমের একমাত্র প্রতিবাদ।

Latest article