শীত পড়েছে। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, পিকনিক নিয়ে মাতোয়ারা হওয়ার সময়। পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের মেজাজ চড়ছে। আছে হরেক কিসিমের মেলাও। বইমেলা থেকে খাদ্যমেলা, হস্তশিল্পমেলা, মৎস্যমেলা আরও কত কি! তবে একটা আনন্দ এই সময় আমরা অনেকেই মিস করি। সেটা হল, সার্কাস। একসময় শীতকালে সার্কাসের আকর্ষণ ছিল প্রশ্নাতীত। ছোটবড় সবাই দলবেঁধে সার্কাসের তাঁবুতে পৌঁছে যেতাম। কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দান আর সিঁথির সার্কাস ময়দানের খ্যাতি তো সেজন্যই। কিন্তু জীবজন্তুর খেলা নিষিদ্ধ হবার পর থেকে সার্কাস শিল্পটাই কার্যত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-মানুষের পরিষেবায় কড়া বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর, স্বচ্ছ, সক্রিয় পুর–প্রশাসন
তবে এবারের শীতে সার্কাসের মতো মনোরঞ্জনের কিছুটা অনুভূতি নাকি পাওয়া যাচ্ছে। এই মত কারও কারও। তার মধ্যে একজন রাজ্য বিজেপির এক বিশিষ্ট নেতা। প্রায় ২৭ বছর পদ্মফুলের পূজারী তিনি। এত বছর ধরে সব ভোটে দলের জন্য প্রাণপাত করেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একনিষ্ঠ সদস্যও এই বিজেপি নেতা। কলকাতার বাসিন্দা হলেও এবারের পুরভোটে পুরোপুরি নিজেকে নিষ্ক্রিয় রেখেছেন। ঠাট্টা করে তিনি সেদিন বলছিলেন, “কোথায় পৌঁছেছি আমরা? লজ্জা হচ্ছে প্রাণের দলটার দুরবস্থা দেখে। বিজেপির কাণ্ডকারখানায় তো এখন সার্কাসের মজা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।” নিজের দলের প্রতি ক্ষোভে, অভিমানে কেন বিজেপিকে সার্কাস পার্টি বলছেন, একের পর এক ঘটনা সাজিয়ে প্রবীণ ওই নেতা বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন।
আরও পড়ুন-ইউনেস্কোর হেরিটেজ সম্মান বাংলার দুর্গাপুজোকে মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের দাবি, শাহকে কটাক্ষ অভিষেকের
তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম (পড়তে হবে বামফ্রন্ট), এমনকী কংগ্রেসও দু-তিন মাস আগে থেকে পুরভোট নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু বিজেপি গা-ঝাড়া দিল নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। ৫ নভেম্বর দলের রাজ্য কমিটির শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা প্রথম বৈঠকে বসলেন। বৈঠকে কলকাতা এবং হাওড়া পুরসভার ভোট পরিচালনার জন্য দুটি কমিটি করা হল। তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক মহল মনে করছিল, কলকাতা এবং হাওড়া শহরের পুরভোট একসঙ্গে হবে।
হাওড়ার কমিটি নিয়ে যা ঘটল তাকে সার্কাসের কোনও শোয়ের চিত্তাকর্ষক ইভেন্ট বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। খোদ হাওড়া জেলা বিজেপির সভাপতি সুরজিৎ সাহা পরের দিনই সাংবাদিক বৈঠক ডেকে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করলেন। কমিটিকে মানবেন না বলেই থামেননি তিনি, বর্তমানে বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন। অবশ্য পদ্মফুল নেতৃত্ব ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে সুরজিৎবাবুকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হলেন।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরার আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে এবার সরব মোদির মন্ত্রীই
সার্কাসের শো কিন্তু তাতে শেষ হয়নি। কলকাতার পুরভোট পরিচালনার কমিটি নিয়ে যে নাটক হল তাতেও মজার খোরাক কম ছিল না। যাঁদের নিয়ে প্রথম বৈঠকে কমিটি হল তাঁরা নিয়োগের কোনও চিঠি পেলেন না। ওই বৈঠকের দিন পনেরো পর ঘোষণা করা হল, ভোট পরিচালনার ‘আসল কমিটি’। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিটির সদস্যরা হয়ে গেলেন সাদামাঠা প্রচার কমিটির সদস্য আর যাঁদের কলকাতা পুরভোট পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁরা মোটামুটি একত্রে কোনও বৈঠক এখনও পর্যন্ত করতে পেরেছেন কিনা বিজেপির কর্মকর্তারা জানেন না। পাঁচজনের এই কমিটির দু’জন জানিয়ে দিয়েছেন ঘনিষ্ঠজনের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত, সুতরাং ভোটের কাজে সময় দিতে পারবেন না। দলের রাজ্য সহ-সভাপতি প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট পরিচালনা কমিটির ইনচার্জ করার পর দলেরই একটা অংশ ‘ফেক নিউজ’ বার করে জানিয়ে দেয়, ওই দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন-শস্য বিক্রিতে কৃষকদের ঋণ
সার্কাস আরও জমে গেল পুরভোটের প্রার্থী-তালিকা প্রকাশ হতেই। কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রার্থী খুঁজতে বিজেপির নেতা-নেত্রীদের জিভ বেরিয়ে যায়। ধরেবেঁধে রাজি করিয়ে কোনও মতে একটা প্রার্থী-তালিকা তৈরি হয়। কিন্তু সেই তালিকা ঘোষণা হতেই সার্কাসের এই ইভেন্টে সবাইকে চমকে দেন রুপালি পর্দার নায়িকা রূপা গাঙ্গুলি। নামী অভিনেত্রী, সাংসদ এবং বিজেপির জাতীয় স্তরের নেত্রী সরাসরি একটি ওয়ার্ডের দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেন। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশ্যে রূপাদেবী আরও জানিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে তিনি নির্দল প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করবেন। সার্কাসের এই খেলায় আরও চমক মজুত ছিল।
আরও পড়ুন-শহর জুড়ে রঙিন প্রচার
রাজ্য বিজেপির অন্যতম সহ-সভাপতি রাজকমল পাঠক দু’তিন দিন পর একই ওয়ার্ডের প্রার্থী নিয়ে রূপাদেবীর সমর্থনে সরব হন। নিজে আবার ওই ওয়ার্ডেরই (৮৬) বাসিন্দা। রাজকমলবাবুর অভিযোগ, প্রার্থী নিয়ে তাঁর কোনও মতামত নেওয়া হয়নি। সুতরাং তিনি পুরভোটের প্রচারে রূপাদেবীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারবেন না। এখনও রূপা, রাজকমলের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতৃত্ব কোনও ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায়নি।
প্রার্থীদের নাম ঘোষণা তো হল, কিন্তু প্রচারে নামার পর বিজেপির কঙ্কালসার চেহারাটা একেবারে বে-আব্রু হয়ে পড়ল। প্রার্থীরা প্রচারে কোনও লোকলশকর পাচ্ছেন না। বিজেপির বিভিন্ন মণ্ডল দলের নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, কর্মী নেই, অর্থ নেই প্রচার হবে কী করে! কোনও প্রার্থীর প্রচারে স্বামীর সঙ্গী কেবল নিজের স্ত্রী কিংবা উল্টোটা। নয়তো পরিবারের দু’একজন সদস্য।
আরও পড়ুন-Mamata Banerjee: কলকাতার জন্য একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
অর্থাৎ দলের কর্মী-সমর্থকদের সেইসব ওয়ার্ডে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সার্কাসের এই পর্বেও অপেক্ষা করছিল ক্লাইম্যাক্স। ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থীর অবস্থা আরও করুণ। তাঁর স্ত্রী ললিতা সরকার সরাসরি জোড়াফুলের পতাকা হাতে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমে পড়েছেন। এইসব ঘটনার উল্লেখ করে দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া বরিষ্ঠ আলোচ্য বিজেপি-নেতা মন্তব্য করলেন, ‘একে সার্কাস পার্টি ছাড়া আর কী বলবেন!’