শৈশবের জাদুকর
কাঁচা বয়সে হাতে এসেছিল ‘আবোল তাবোল’। জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন বাবা। তার আগেই অবশ্য নাম জানা হয়ে গিয়েছিল কবির। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে। তবে ‘আবোল তাবোল’ পড়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। রবীন্দ্র-নজরুল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কবিতাগুলো আবৃত্তি করতাম। মনকে নিয়ে যেত এক অচেনা জগতে। যে জগতের সন্ধান পাওয়া যায়নি আগে। পাতায় পাতায় অফুরান মজা। আশ্চর্য আনন্দ-উপাদান। তখন ভাবতাম, সত্যি কি এমন হয়? আছে এমন জগৎ? মনে মনে খুঁজতাম ট্যাঁশগরু, কুমড়োপটাসদের। মুখোমুখি হতে চাইতাম কাতুকুতু বুড়ো, খুড়োর কলের সেই খুড়োর, যার কল পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে দেয়। ঝোলাগুড় মাখিয়ে পাউরুটির স্বাদ নিতে নিতে কতবার ভেবেছি, সত্যিই সেরা। এইভাবেই আমার, আমাদের শৈশব জুড়ে ছিলেন তিনি, সুকুমার রায়। রেখেছিলেন আচ্ছন্ন করে। ‘রেখেছিলেন’ প্রয়োগটা সঠিক হল না। আজও রেখেছেন। যখনই তাঁকে পড়ি, অবাক হই। বঙ্গজীবনের শৈশবের জাদুকর তিনি। আমার প্রথম দিকের কিছু ছড়া-কবিতায় তাঁর প্রভাব এড়াতে পারিনি।
আরও পড়ুন-দিনভর উত্তর ২৪ পরগনার প্রতিটি ব্লকে হল ধিক্কার মিছিল-পথসভা
অসঙ্গতি তুলে ধরতেন
বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। রবীন্দ্র-সুহৃদ এবং শিশুসাহিত্যিক। সাহিত্যে বাবার পথ অনুসরণ করেছিলেন সুকুমার। অসম্ভব মেধাবী। বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। গভীরভাবে ছিলেন বিজ্ঞান ও সমাজমনস্ক। প্রধানত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলো। লিখেছেন ছোটদের মনের মতো করে। সহজ সরল ভাষায়। এই বিষয়ে তাঁর প্রথম লেখা প্রবন্ধ ‘সূক্ষ্ম হিসাব’। তবে হাস্যরস ছিল তাঁর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য। নির্ভেজাল হাস্যরসই তাঁকে এনে দিয়েছিল চূড়ান্ত খ্যাতি। তার মধ্যে দিয়েই তুলে ধরতেন সমাজের নানা অসঙ্গতি। লেগে থাকত বিদ্রুপের সুর। ফুটে উঠত সময়ের ছবি, সমাজের ছবি। যদিও ‘আবোল তাবোল’-এর সব কবিতায় হাস্যরস আছে বলা যায় না। উদাহরণ ‘বুড়ির বাড়ি’। এক হতদরিদ্র অসহায় বৃদ্ধার করুণ ছবি ফুটে ওঠে এই কবিতায়। পাঠ করা মাত্র মনের মধ্যে আনন্দের বদলে করুণ রসের জন্ম হয়। ‘সৎপাত্র’ কবিতায় আঁকা হয়েছে এক নিন্দুকের ছবি। যে পরের ভাল দেখতে পারে না। ভাঙচি দেওয়া স্বভাব। সমাজে প্রতিনিয়ত আমরা এমন মানুষের দেখা পাই। আছে এইরকম আরও কিছু কবিতা। দিন ফুরিয়ে আসছে, হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কবি। ‘আবোল তাবোল’-এই আছে সেই ইঙ্গিত।
আরও পড়ুন-ক্ষমতায় এলেই কৃষকদের ঋণ মকুব হবে, ছত্তিশগড়ে প্রতিশ্রুতি রাহুলের
আট বছর বয়সে
জিনিয়াস ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে পৌঁছেছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা‘নদী’ প্রকাশিত হয়‘মুকুল’ পত্রিকার ১৩০২ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। তবে যেটুকু জানা যায়, ছাত্রাবস্থায় বিশেষ সাহিত্যচর্চা করেননি। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায়‘সন্দেশ’ পত্রিকা বেরোয়। তখন থেকেই মূলত সুকুমারের সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ। ২৬ বছর বয়সে। মাত্র দুই বছর যেতে না যেতেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু। সেই সময় থেকেই পত্রিকার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সুকুমার। তবে খুব দীর্ঘ হয়নি সেই যাত্রা। তাঁর সাহিত্য চর্চা শেষ হয় মাত্র দশ বছরের পরিসরেই। রোগশয্যায় শেষ আড়াই বছর বিশেষভাবে সৃজনশীল ছিলেন। লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, সংগীত, নাটিকা, প্রবন্ধ ও শব্দের ধাঁধা। এঁকেছেন ছবি। পড়াশোনা করেছেন মুদ্রণ শিল্প নিয়ে। কবিতাগ্রন্থে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘আবোল তাবোল’, কাহিনিসংকলনে‘পাগলা দাশু’ আর নাটিকায়‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’।‘খাই খাই’ ও‘হ-য-ব-র-ল’,‘অবাক জলপান’ ইত্যাদিও তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।
আরও পড়ুন-বাম-শাসিত কেরলে জনসভা হামাস নেতার!
বাংলায় ননসেন্স-এর প্রবর্তক
বাংলা ভাষায় সুকুমার রায়ই প্রথম ননসেন্স-এর প্রবর্তক। তাঁর প্রথম ছড়ার বই ‘আবোল তাবোল’ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার। ছাত্রজীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। মুখপাত্র ছিল‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর‘মানডে ক্লাব’ নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন। সেই সময় আধুনিক সাহিত্যে ননসেন্সের কোনও জায়গা ছিল না। আধুনিক সাহিত্য মানেই ছিল বড়দের সাহিত্য। গুরুগম্ভীর বিষয়। ব্রিটিশ সাহিত্যিক এডওয়ার্ড লিয়র উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে লিখেছিলেন‘বুক অব ননসেন্স’। সেই বইটির হাত ধরেই শিশুরা সাহিত্যে প্রথম পেয়েছিল এক অদ্ভুত দেশের খোঁজ। ননসেন্সকে দুনিয়াভর জনপ্রিয় করার পেছনে আরও একটি বড় হাত লুই ক্যারলের। ১৮৬৫ সালে তিনি‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ নামে অদ্ভুত ও উদ্ভট উপন্যাস লিখেছিলেন। ইংরেজিতে যেমন ক্যারল, এডওয়ার্ড লিয়র, বাংলায় তেমন সুকুমার। তাঁকে বাংলা ননসেন্স সাহিত্যের রাজপুত্র মনে করা হয়।‘ননসেন্স’ ও উদ্ভট ধরনের রচনায় এডওয়ার্ড লিয়র, লুইস ক্যারলের লেখায় তিনি অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মিশিয়েছিলেন নিজস্ব কল্পনা। বিভিন্ন লেখায় দেখা যায় মৌলিক ভাবনার প্রকাশ। একজন শিশু তাঁর কবিতা পড়ে যতটা আনন্দ পায়, ততটাই আনন্দ পান একজন পরিণত বয়সের মানুষ। একটি কবিতা দু’জনের চোখে দুই রকম ভাবে ধরা দেয়। ছোটবেলার একরকম অর্থ ফুটে ওঠে, বড় বয়সে আরেক রকম অর্থ। তাঁর লেখা যতটা সরল, ততটাই গভীর। তিনি মারাত্মকভাবে রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ছিলেন।‘বাবুরাম সাপুড়ে’,‘একুশে আইন’ কবিতাগুলো পড়লে সেটা ভালই বোঝা যায়। কাউকেই ছেড়ে কথা বলেননি। যদিও খুব সরাসরি বলেছেন, তা নয়। বলেছেন নিজের মতো করে। এমনভাবে, যেখানে একটা কথার দুই রকম অর্থ হয়।
আরও পড়ুন-কাতারে ৮ ভারতীয়র মৃত্যুদণ্ড: দিল্লির সামনে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ
দেখে যেতে পারেননি
তাঁর প্রতিটি বই আজও সমাদৃত। তবে একটি বইও নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি ১৮৮৭-র ৩০ অক্টোবর জন্মানো প্রতিভাবান মানুষটি। প্রথম বই ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশের কয়েকদিন আগে, ১৯২৩-এর ১০ সেপ্টেম্বর, কালাজ্বরে ভুগে না ফেরার দেশে চলে যান। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ঠিক একশো বছর আগে। খুব কম সময়েই সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ সময় সাহিত্যচর্চার সুযোগ পেলে অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছতে পারতেন। সেটা হল না, এ বড় আক্ষেপের বিষয়। তাঁর সৃষ্টি আজও আমাদের আনন্দ দেয়। হাসায়। ভাবায়। এইভাবেই তিনি থেকে যাবেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
আরও পড়ুন-মুকেশ আম্বানিকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ২০ কোটি দাবি
বিশিষ্টদের চোখে সুকুমার রায়
রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের
চিরঞ্জিত চক্রবর্তী
সুকুমার রায় সবারই খুব প্রিয় কবি। আমারও। উনি যে সময় লেখালেখি শুরু করেন, সেই সময় বেশিরভাগ লেখকই সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লিখতেন। কবি এবং গদ্যকাররা। ধরা যাক সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। রবীন্দ্র অনুসারী কবি। অসাধারণ ছিল তাঁর ছন্দের হাত। তাঁকে ছন্দের জাদুকর বলা হত। তিনি কবিতা লিখতেন মূলত সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। এমন অনেকের কথাই বলা যায়। ওইরকম সময় পাঠককে আনন্দ দেওয়ার মতো লেখা, মজার লেখা লিখেছেন সুকুমার রায়। তাঁর পাশাপাশি সুনির্মল বসুও। তারপরে এসেছেন অনেকেই। তবে সুকুমার রায় সবার সেরা। তাঁর ‘আবোল তাবোল’-এর অ্যাবসার্ডিটির কোনও তুলনাই হয় না। রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের। জেরম কে জেরম, লিয়রের সঙ্গে তুলনীয়। যেমন শব্দ চয়ন, বিষয় নির্বাচন, তেমন ছন্দ। এমন বাঙালি খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায় যাঁরা ‘আবোল তাবোল’ পড়েননি। বহু মানুষ আছেন যাঁরা ‘আবোল তাবোল’-এর সব ক’টা কবিতাই মুখস্থ বলতে পারেন। আমার প্রায় পুরোটাই মুখস্থ। সেই ছোটবেলা থেকে। আসলে লেখাগুলো ভাল লাগার মতো। তাই সহজেই মুখস্থ হয়ে যায়। মানুষ মনে রাখতে পারে। বইটির শতবর্ষ চলছে। আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আজও বেস্ট সেলার ঠিক এই কারণেই। ‘আবোল তাবোল’-এর প্রতিটি ছড়াই আমার খুব প্রিয়। তার মধ্যে বেশি প্রিয় ‘গোঁফ চুরি’, ‘গন্ধ বিচার’। এই ছড়া দুটির মধ্যে আমি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার দেখতে পাই। ওপর পক্ষ, নিচের পক্ষ, সামান্য, অসামান্যর ভেদ। ছড়াগুলো ছোটবেলায় পড়লে একরকম মানে করা যায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানে বদলে যায়। অন্য রকম অর্থ ধরা পড়ে। প্রায় প্রত্যেকটা লেখার মধ্যেই একটা গল্প আছে। শুধুমাত্র ‘আবোল তাবোল’-এর ছড়াগুলো নিয়ে একটা প্রোডাকশন হতে পারে। থিয়েটারের মতো।
আরও পড়ুন-গাজায় যুদ্ধবিরতি চেয়ে রাষ্ট্রসংঘে প্রস্তাব, ভোট দিল না ভারত
‘আবোল তাবোল’-এর পাশাপাশি সুকুমার রায়ের অন্যান্য বই বা লেখাও আমার খুব প্রিয়। ওঁর ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে আমি অভিনয় করেছি। লক্ষ্মণের চরিত্রে। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রে। গড়পারের বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে আমার আশৈশব যোগ। সুকুমার রায়ের প্রয়াণের পরে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ওঁর ভাই সুবিনয় রায়। সেই সময় ‘সন্দেশ’-এ ছবি আঁকতেন আমার বাবা শৈল চক্রবর্তী। সত্যজিৎ রায় তখন খুব ছোট। বাবা আঁকা জমা দিয়ে এলে উনি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন। পরবর্তী সময়ে বাবার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নিবিড় সম্পর্ক রচিত হয়েছিল। আমিও পেয়েছি বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালকের স্নেহ। তাঁর তথ্যচিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় আমি প্রচ্ছদ আঁকার সুযোগ পেয়েছিলাম। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও আমার পছন্দের লেখকদের একজন। সব মিলিয়ে রায়চৌধুরী পরিবার আমার খুব প্রিয়। তিন প্রজন্মের সূত্রে। আজও আমি সময় পেলেই সুকুমার রায়ের লেখা পড়ি। ওঁর আঁকা ছবি দেখি। আনন্দ পাই। মানুষটি দীর্ঘায়ু হলে আমরা আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম।
আরও পড়ুন-জ্যোতিপ্রিয়র গ্রেফতারে বিজেপির চক্রান্ত নিয়ে ফুঁসছে ক্ষুব্ধ মন্তেশ্বর
আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে মিশেছিলেন
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
আমাদের বেড়ে ওঠার সময় রায় পরিবারের একটা বড় ভূমিকা ছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির গল্প’ থেকে শুরু। তারপর সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়। সুকুমার রায়ের খেয়াল রস ছোটবেলায় খুব একটা যে বুঝতাম, তা নয়। এমনিই ভাল লাগত। সেই ভাল লাগা থেকেই ওঁর কবিতাগুলো আমরা পাঠ করতাম। ট্যাঁশ গরু’,‘বোম্বাগড়ের রাজা’ প্রভৃতি কবিতায় আমাদের মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। অনেক পরে যখন ‘আবোল তাবোল’ বইটা ফিরে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তখন মনে হয়েছে, ক্ষণজন্মা মানুষটি অল্প বয়সের মধ্যে এরকম একটি অসামান্য বই কী করে লিখেছেন। কতটা জিনিয়াস হলে এটা সম্ভব হয়।‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে আমি রামের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। সংলাপগুলো অবশ্যই মজাদার। পাশাপাশি গভীর।‘পাগলা দাশু’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এ তো আমাদের জীবনের গল্প। এইভাবেই সুকুমার রায় আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে মিশেছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। আমার ছেলেদেরও পড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের হাতে এখন অনেক অপশন। আমরা যতটা পড়তে পেরেছি তারা যে ততটা পড়তে পারছে, তা নয়।
আরও পড়ুন-জ্যোতিপ্রিয়র গ্রেফতারে বিজেপির চক্রান্ত নিয়ে ফুঁসছে ক্ষুব্ধ মন্তেশ্বর
কেউ কেউ বলেন ‘আবোল তাবোল’-এর লেখাগুলো ছোটদের নয়। সেটা তো পরের কথা। আসল ব্যাপার হল লেখাগুলো ছোটদের ভাল লাগে। পড়ে ছোটরা আনন্দ পায়। লেখাগুলো কালোত্তীর্ণ। বহুস্তরীয়। স্তরগুলো পাওয়ার জন্য অনুসন্ধিৎসু হতে হয়। আজও যে সেই লেখাগুলোর কাছে আমরা ফিরে যাই তার কারণ, লেখাগুলো সময় কাল পার করতে পেরেছে, বিভিন্ন স্তরকে নিয়ে খেলা করতে পেরেছে। চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা যেমন। প্রথমে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়তে হয়। মানবতাবাদ কখন আসছে সেটা পরে। সুকুমার রায়ও সেই রকম। প্রথমে নির্মল আনন্দ দেবেন। অনেক পরে বুঝতে হবে কারিকুরি। অবসেস্ট হয়ে পড়লে তবেই সেটা বেছে নিতে হবে।
আরও পড়ুন-শিশু-নির্যাতন ও ধর্ষণ রোখার বার্তায় একরত্তি কন্যাকে লক্ষ্মীরূপে আরাধনা
পাণ্ডিত্য আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী
সুকুমার রায় আমার খুব প্রিয়। তাঁর লেখা অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। বহু কবিতাই আমাদের মুখস্থ। পরিণত বয়সে যখন‘হ-য-ব-র-ল’ পড়েছি, চমৎকৃত হয়েছি। প্রায় প্রতিটি পাতায় যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। মানবদেহ, পশুদেহ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হয়েছে। একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়, এর পিছনে একটা গভীর খোঁচা আছে। আমি মনে করি, ননসেন্স রাইমে সুকুমার রায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি। ওঁর লেখা ছোট-বড় সব বয়সিদের প্রিয়। প্রায় প্রতিটি লেখায় অন্য রকমের অর্থ রয়েছে। ছোটরা ছোটদের মতো বোঝে, বড়রা বড়দের মতো। ভাবনার পরিবর্তন ঘটে বয়স এবং অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমার নাতি গড়গড় করে মুখস্থ বলে ‘আবোল তাবোল’-এর কবিতা। আনন্দ পায়। আমিও সমানভাবে আনন্দ পাই। মজা পাই। সুকুমার রায় ছাত্র হিসেবে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। নেতৃত্ব দেওয়ার একটা বিরাট গুণ ছিল। একটি আড্ডার নামকরণ করেছিলেন মানডে ক্লাব। সেই ক্লাবের জন্য মজার মজার বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন লিখেছিলেন। গদ্যে এবং পদ্যে। সেগুলোও দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। জিনিয়াস ছিলেন। সুকুমার রায়ের পাণ্ডিত্য আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতী: আত্ম-প্রচারকদের ফলক সরাতে বলুক কেন্দ্র, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
সবসময় এক নম্বরে রাখতে ইচ্ছে করে
পদ্মনাভ দাশগুপ্ত
সুকুমার রায় আমাদের কাছে চিরকাল ভালোলাগার জায়গা। ‘আবোল তাবোল’ নয়, ওঁর লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়‘ঝালাপালা’র মাধ্যমে। খুব ছোটবেলায়। কীভাবে‘ঝালাপালা’ আমার হাতে এসেছিল, আজ মনে নেই। সেটা পড়ে স্বভাবতই খুব ভাল লেগেছিল। তারপর পড়া শুরু করি ‘সুকুমার রচনা সমগ্র’। সে এক আশ্চর্য জগৎ। প্রত্যেকটি লেখার মধ্যে উনি একটা অন্যরকম কিছু বলার জায়গা তৈরি করেন। এক-এক রকম বয়সে আমরা এক-একরকম ভাবে বোঝার চেষ্টা করি। এই বিষয়টা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় লাগে। ওঁর লেখার রসাস্বাদন করা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। বলে বোঝানো মুশকিল। সবদিক থেকেই। পরবর্তী সময়ে ওঁর‘হ-য-ব-র-ল’,‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ পড়েছি। অভিনয় করেছি। এবার আসি ‘আবোল তাবোল’-এর কথায়। উনি লিখছেন,‘ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর/ গানের পালা সাঙ্গ মোর’। অদ্ভুত ট্রাজিক একটা জায়গাকে কী সহজ ভাবে তুলে ধরেছেন। আরেকটি জায়গার কথা বলি,‘আজকে দাদা যাবার আগে/ বলব যা মোর চিত্তে লাগে’, অথবা‘রাম-খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাচ/ কথায় কাটে কথার প্যাঁচ’– এই লেখার ক্ষমতা, বিশেষত ওই বয়সে, ভাবাই যায় না। অকালে চলে গেছেন। যদি দীর্ঘ সময় থাকতেন, বাংলা সাহিত্য আরও অনেক কিছু পেতে পারত।‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’র কথাও বলব। পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যাই। আমাদের অনেকরকম মতবাদ আছে। মতবাদগুলো যখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায় তখন কী হয়, অসাধারণ শ্লেষের মাধ্যমে উনি দেখিয়েছেন। খুব ভাল লাগে পড়তে। সুকুমার রায়ের লেখাকে আমার সবসময় এক নম্বরে রাখতে ইচ্ছে করে। এককথায় অসাধারণ।