আধ ডজন বর্ষপূর্তি, ভয়ংকর সেই ‘মিত্রোঁ’ ডাক

একেবারে ভৌতিক কাহিনিতে শোনা নিশির ডাকের মতো। ‘মিত্রোঁ’ সম্বোধন শুনলেই আপামর দেশবাসীর শিরদাঁড়ায় কাঁপন। কত কথাই না শুনেছিলাম! কত কিছুই না বোঝানো হয়েছিল। নোটবন্দির ছ’বছর পর দেখা যাচ্ছে, সেসব বেমালুম মিথ্যাচার। বৃহৎ অশ্বডিম্ব প্রসব আর অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি। এর বাইরে আর কিছুই হয়নি নোটবন্দির কারণে। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

মোদি জমানার অন্যতম সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত হল ‘নোটবন্দি’ (Demonetization)। ছ’বছর আগে ভুলভাল নানা কথা শুনিয়ে, গিলিয়ে, বুঝিয়ে এই সিদ্ধান্ত দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল জনবিরোধী গেরুয়া সরকার। আধ ডজন বছর পেরিয়ে ভারতের আমজনতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, ‘নোটবন্দি’ (Demonetization) স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সর্ববৃহৎ ‘আর্থিক কেলেঙ্কারি’। এর সুফল হিসেবে যা যা প্রচার করা হয়েছিল, তার কণামাত্রও মেলেনি।
৮ নভেম্বর, ২০১৬, দেশবাসীকে বলা হল, হে মিত্রগণ! দেশকে কালো টাকার কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নোটবন্দির সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মাথায় হাত পড়ল। এটিএম-এর লাইনে মারা পড়লেন প্রবীণ ও অসুস্থরা। স্বনির্ভর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যাঁরা তাঁরা কর্মহীন হলেন। সবই নাকি বৃহত্তর স্বার্থে, দেশীয় অর্থনীতির বিকাশের বিরাট যূপকাষ্ঠে ক্ষুদ্র নাগরিকের আত্মবলিদান।

কী হল সেসব করে?
অর্থনীতির পতন। সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার ছায়া। আর ছ’বছর পর দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে লোকের হাতে যত নগদ অর্থ এখন তার চেয়ে লোকের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেশি। নভেম্বর, ২০১৬-তে প্রচলিত নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ১৭.৯৭ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। নোটবন্দি-উত্তর (Demonetization) ছ’বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ, নোটবন্দির অন্যতম ঘোষিত উদ্দেশ্যই ছিল, লোকের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা হ্রাস করে ডিজিটাল লেনদেনকে অনুপ্রাণিত করা। পাশাপাশি, যে স্বপ্নগুলো ফেরি করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল— দুর্নীতি কমবে, জাল নোটের বহর কমবে, সন্ত্রাসবাদীদের তহবিলে জোগান বন্ধ হবে।
সেদিন চালু ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে চারদিকে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, সমস্যা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মোদিজি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে ছেড়েছিলেন। নগদের জোগান বন্ধ হওয়ায় কম করে ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-ময়ূরের গ্রাম এবং আরও কিছু জায়গা

কী হল তার পরিণতিতে?
বিদেশ থেকে কালো টাকা দেশে ফেরত এল না, দারিদ্র‍ এল আরও বেশি মাত্রায়। অর্থনীতিতে নগদের ব্যবহার শূন্য হল না, দুর্বলতর হল, সন্ত্রাসবাদ মারা পড়ল না, মারা গেল ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, কোটি কোটি ছোটখাটো চাকরি। পঞ্চাশ দিনের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ উজ্জ্বলতর হওয়ার খোয়াব দেখিয়েছিলেন মোদি-সরকার। ২১৯০ দিন পর দেখা গেল দেশে বেকারত্ব ৮ শতাংশেরও বেশি।
সেদিন দেশবাসীকে ‘মিত্রোঁ’ সম্বোধন করে মোদিজি বলেছিলেন, ৫০ দিনের মধ্যে প্রত্যাশা পূরণ না হলে দেশবাসী তাঁকে যে শাস্তি দেবেন, তা তিনি মাথা পেতে নেবেন। আজ যখন প্রমাণিত, নোটবন্দি ‘সংগঠিত লুটপাট এবং আইনসম্মত ডাকাতি’র সমার্থক পদক্ষেপ, তখন কিন্তু সরকার নোটবন্দির সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন, ‘মিত্রোঁ’ সম্বোধনও এখন বড় একটা শোনা যায় না।
অথচ সেদিন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা ওই পদক্ষেপের ত্রুটি কেন্দ্রীয় সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেলেন, তাঁদের সতর্ক দিশা দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন।
সেসবই সেদিন উদ্ধত শাসকের বধির কর্ণে পতিত হয়েছিল।
আর আজ মোদি-সরকারের চালচলন দেখে মনে হচ্ছে, ছ’বছর আগে এমন কোনও কিছুই তাঁরা ঘটাননি। এমন বিপর্যয় ঘটে থাকলে তার দায় তাঁদের নয়।
ভয়ানক সেই রাত্রির ষষ্ঠবর্ষ পূর্তির প্রহরে মনে হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটাই ওঁরা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটাই ওঁরা চুপচাপ হজম করিয়ে দিতে চাইচেন।

একথা অনস্বীকার্য যে ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি আর জনঘাতী নোটবন্দি ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ডে আঘাত হেনেছে। জনমানসে আতঙ্কের প্রসার ঘটিয়েছে। সরকারের ওপর আম-জনতার বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছে।
একথা না-মেনে উপায় নেই যে, নোটবন্দি আর ভ্রান্ত কৃষি আইনের মতো সরকারি সিদ্ধান্ত আর যাই-ই হোক, দরিদ্র জনগণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং কৃষিজীবী জনতার স্বার্থে প্রণীত হয়নি।
সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে প্রকাশ, গ্রামীণ বেকারত্ব ক্রমে মাত্রা ছাড়াচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশে যেখানে বেকারত্বের হার ৮.৪২ শতাংশে পৌঁছেছিল। দেব দীপাবলির পুণ্যাহে যখন হিন্দুত্ববাদের প্রদীপ জ্বালানোর আয়োজন দিকে দিগন্তে, যখন সেসব নিয়েই ব্যস্ত গেরুয়া পক্ষ, তখন পল্লি ভারত ক্রমশ নিষ্প্রদীপ হচ্ছে। কাজের বাজার ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। মানুষ চাকরি খোঁজাই কমিয়ে দিয়েছেন। কৃষি, অকৃষি, সর্বক্ষেত্রে কাজ কমছে। কাজের বাজারে সার্বিকভাবে অংশগ্রহণের হারটাই কমছে।
আর সরকার? কেন্দ্রের সরকার?
তাঁরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারছেন না বলে বেকারত্ব বা কাজের বাজারের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পরিসংখ্যান প্রকাশ করাটাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
সত্য সেলুকাস! কী বিচিত্র এই জমানা!

Latest article