মহাকাশযাত্রা ও অবতরণে জাইরোস্কোপ

মহাকাশযান উৎক্ষেপণ থেকে অবতরণে জাইরোস্কোপের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নানা ভূমিকায় থাকে এই জাইরোস্কোপ। যার অবদান সম্পর্কে সুদূর কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে কলম ধরলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমোস্ফিয়ারিক সায়েন্সের অতিথি অধ্যাপক ও বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

ফরাসি বৈজ্ঞানিক লেওন ফোকাল্ট ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর ঘূর্ণনের দ্বিমুখী প্রভাব অনুসন্ধান করার জন্য জাইরোস্কোপ (Gyroscope) যন্ত্র তৈরি করেন। এই যন্ত্রে একটি ধাতুর গোলাকার পুরু প্লেটকে Y আকৃতি শোন-এর মধ্যে আটকানো হয়, যাতে এর কেন্দ্রগামী উলম্ব অক্ষে অনায়াসে ঘুরতে পারে। পরে এই শোন-কে অন্য একটি ঘূর্ণায়মান ধারকের মধ্যে আটকানো হয়। তারপর সমস্ত যন্ত্রটি একটি দৃঢ় কাঠামোর ওপর শক্ত করে আটকানো হয়। অনেক জটিল অঙ্ক করে জাইরোস্কোপ কোনও বস্তুর ঘূর্ণন-বেগ মাপতে পারে আর ঘূর্ণনের অক্ষ পরিবর্তন করে ওই কাঠামোর (এক্ষেত্রে কোনও যান) গতির দিকও পরিবর্তন করতে পারে। এক্ষেত্রে চাকা, হাল, বৈঠা, পাখনা, পাখা ইত্যাদি কোনও কিছুরই প্রয়োজন হয় না। ঘুরন্ত বস্তুর জাড্য (ঘুমন্ত বা অলস) শক্তি প্রয়োগ করে করা হয়। এই যন্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে। এই যন্ত্রকে জাইরো কম্পাস হিসাবে ব্যবহার করে জাহাজের অবস্থান, আর জাইরোস্কোপ (Gyroscope) হিসাবে ব্যবহার করে জাহাজকে ডানদিক-বাঁদিক ঘোরানো যায়। এরোপ্লেনেও জাইরোস্কোপ ব্যবহার করে গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। যেহেতু জাহাজ এবং এরোপ্লেন যথাক্রমে জল এবং বায়ুমাধ্যমের ওপর চলে, তাই মাধ্যমের ঘর্ষণ-বল প্রয়োগ করে জাইরোস্কোপ ব্যবহার না করলেও চলে। কিন্তু মহাকাশযান পৃথিবীর ১০০ কিমি ওপরে উঠলে বস্তুত কোনও মাধ্যম থাকে না। শূন্যস্থান বলা যায়। তখন জাইরোস্কোপ ছাড়া মহাকাশযানের অবস্থান জানা, সুনির্দিষ্ট দিক পরিবর্তন করানো ও অন্য কোনও মহাজাগতিক স্থানে ধীরে ধীরে অবতরণ করানো একেবারে অসম্ভব। ন্যাশনাল এরোনোটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সংক্ষেপে নাসা, এই মহাকাশ প্রযুক্তিকে মোটামুটি ১০ ভাগে ভাগ করেছে। স্পেস টেকনোলজি ৬ (এসটি-৬) অধ্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধি (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রয়োগ আরও উন্নত জাইরোস্কোপ প্রযুক্তির কথাই বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো)-এর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা এই সমস্ত মহাকাশ-প্রযুক্তি নখদর্পণে এনে ফেলেছেন।

আরও পড়ুন- আমার পদবি মোদি-চোকসি-মালিয়া নয়!

মহাকাশ প্রযুক্তির সমস্যা
ধরে নেওয়া যাক, একটি ক্যারাম বোর্ড-এর ওপর একটি স্ট্রাইকার আছে। স্ট্রাইকারের পরিধির ওপর একটি লাল স্পট, পেন দিয়ে চিহ্নিত করা হল। স্ট্রাইকারকে যত সূক্ষ্মভাবে স্ট্রাইক করা হোক, বেশকিছুটা দূর গেলে, লাল স্পটের সাহায্যে স্ট্রাইকারে ঘূর্ণন ধরা পড়বেই। অর্থাৎ বস্তুর ওপর বলপ্রয়োগ করলে বস্তুর সরণ ও ঘূর্ণন দুইই হবে। মহাকাশ যানের ক্ষেত্রেও তাই, উৎক্ষেপণের পরেই সরণ এবং ঘূর্ণন হয়। রকেট ইঞ্জিনের সমস্ত স্টেজ (সাধারণত ৩ স্টেজ) কমপ্লিট হওয়ার পর যখন পৃথিবীর অক্ষপথে আসে, তখনও সরণ ও ঘূর্ণন হতে থাকে (যদিও লুনা ২৫-এ এটা করা হয়নি)। এখন প্রয়োজন অনুযায়ী উপগ্রহকে প্রায় বৃত্তাকার অক্ষ বা অতি-উৎকেন্দ্রিক উপবৃত্তাকার অক্ষে পাঠানোর জন্য বুস্টার মোটর চালানোর প্রয়োজন। গতি বাড়াতে হলে অতি-উৎকেন্দ্রিক অক্ষেই পাঠাতে হবে। কিন্তু উপগ্রহের ঘূর্ণন বন্ধ না হলে কিছুই করা যাবে না। সাথে প্রতিটি মূহর্তের উচ্চতা ও গতির দিক ও মান জানা প্রয়োজন। জ্বালানি কম খরচ করে, বেশ কয়েকবার অক্ষপথ পরিবর্তন করে (সময় বেশি লাগে লাগুক, এটাই চন্দ্রযান ৩-এর ৪০ দিন লাগার প্রধান কারণ) অতি-উৎকেন্দ্রিক অক্ষে পাঠাতে বুস্টার মোটর চালাতে হবে। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘূর্ণন বন্ধ করতে হবে (স্টেবিলাইজ)। আবার পৃথিবীর আকর্ষণের বাইরে যেতে হলে মুক্তিবেগ (Scape ভেলোসিটি) অর্জন করতে হবে। যার মান ১১ দশমিক ২ কিমি প্রতি সেকেন্ডে। অতি বিশাল বেগ, শব্দের থেকেও ৩৩ গুণ বেশি। রাইফেলের গুলির বেগ ২ কিমি প্রতি সেকেন্ডের থেকেও কম। মুক্তিবেগ অর্জন করতে না পারলে আবার উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে ফিরে আসবে। যতবার বুস্টার মোটর চালানো হবে ততবার ঘূর্ণন বন্ধ করতে হবে। মুক্তিবেগ অর্জন করে চাঁদের অতি-উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথে পৌঁছবে। সেখান থেকে চাঁদের প্রায় বৃত্তিও কক্ষপথে আনতে আবার বুস্টার মোটর চালাতে হবে। এতে উপগ্রহের গতি কমবে। আবার ঘূর্ণন বন্ধ করে বুস্টার মোটর চালিয়ে চিলের মতো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে উলম্ব অবতরণ অবস্থায় আসতে হবে এবং ধীরে উলম্ব অবতরণের সমস্ত কাজ করবে। প্রতি মুহূর্তে ঘূর্ণন বন্ধ করে উচ্চতা ও গতি জানতে হবে। এখানে যত পদক্ষেপ বলা হল, তার থেকে হাজার হাজার গুণ বেশি পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে এসটি-৬।

এসটি-৬
জাহাজ বা এরোপ্লেনে জাইরোস্কোপে ঘূর্ণনে ভর (মাস) ব্যবহার করা হয়। এর ওজন অনেক এবং অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন। স্পেস টেকনোলজি ৬ প্রযুক্তির জাইরোস্কোপ (Gyroscope) একটি মাইক্রো ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল সিস্টেম (MEMS) বা যন্ত্র। আর আয়তন প্রায় কম্পিউটারে ব্যবহৃত মাইক্রোচিপসের সমান। মহাকাশে, মহাকাশযানের সামান্য ঘূর্ণন এই জাইরোস্কোপ অনুভব করতে পারে। আর স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্রয়োজনে ঘূর্ণনকে বন্ধ করে দিতে পারে। যেকোনও মুহূর্তে ঘূর্ণন বা দিক-পরিবর্তন হলেই কম্পিউটার জাইরোস্কোপের (Gyroscope) ঘূর্ণন অক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশযানের অবাঞ্চিত ঘূর্ণন বা দিক-পরিবর্তন বন্ধ করে দেয়। বাইরের কোনও শক্তির (ঘর্ষণ) প্রয়োজন হয় না। শুধু তাই নয়, মহাকাশযান কোন মুহূর্তে কতটা বিচ্যুতি হয়েছে সব কিছু কম্পিউটারকে জানিয়ে দেয়। কোনও সময় যদি কোনও কারণে মহাকাশযানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবুও পরে প্রকৃত অবস্থান, উচ্চতা জানা যাবে। বর্তমানে জাইরো-ইলেক্ট্রনিক্স এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, এর জন্য মাত্র ৭৫ মিলি ওয়াট শক্তির প্রয়োজন, একটি এলইডি লাইটের থেকেও কম। বলাই বাহুল্য, ন্যানো টেকনোলজি-সহ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগ প্রয়োজন। কোনও কোনও দেশ স্টেট অফ দি আর্ট টেকনোলজি ব্যবহার করে সুসংগত (কোহেরেন্ট) আলো দিয়ে অতুলনীয় ফাইবারে অপটিক জাইরোস্কোপ (এফওজি) তৈরি করেছে।

Latest article