বরফের মরুভূমির দেশ স্পিতি ভ্যালি

ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় স্পিতি ভ্যালি। হিমাচলপ্রদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র এই স্পিতি ভ্যালি। চেনাব নদীর তীরে অবস্থিত এই স্পিতি উপত্যকার পর্যটন কেন্দ্রে গেলে মনে হবে সব পেয়েছির দেশে চলে এসেছেন। এমনই তার সৌন্দর্য। তার হালহকিকত জানাচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয় লোক্ষণ

Must read

শহুরে জীবন থেকে অন্য একটা জীবন। শীতল মরুভূমির দেশ। এখনও কংক্রিটের জালের মায়ায় তাকে বাঁধতে পারেনি আগ্রাসী উন্নয়ন। এখানে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়েছে আপন খেয়ালে। এখানে এলে আপনার মনে হবে যেন আপনি এসে পৌঁছেছেন ‘সব পেয়েছি-র দেশে’।
হিমাচলের লাহুল-স্পিতি। সংক্ষেপে স্পিতি ভ্যালি (Spiti Valley)। পায়ের নিচে রুক্ষ পাথুরে জমি, মাথার উপরে ঘননীল আকাশে ছেঁড়া মেঘ, পাশে গর্জন করে বয়ে চলা স্পিতি নদী, চোখের সামনে বরফঢাকা পাহাড় আর চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট শুনতে পাওয়া নিজের হৃদস্পন্দন৷ স্পিতি নামটা শুনলেই মনের মধ্যে একটা অন্যরকম ছবি ভেসে ওঠে যা হয়তো আগে কখনওই দেখা হয়নি বা স্বপ্নে দেখা হয়েছিল বলে মনে হয়।

স্পিতি (Spiti Valley) মানে হচ্ছে মধ্যভূমি অর্থাৎ এটি তিব্বত ও ভারতের ঠিক মাঝে অবস্থিত। আর এটিই একমাত্র স্থান যেখানে বৌদ্ধদের হাজার বছরের পুরাতন ইতিহাস জড়িত। এই স্পিতি ভ্যালি মূলত ১৪,০০০ ফুট উপরে অবস্থিত, অর্থাৎ এর বেশিরভাগই বিশাল পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছে যা সত্যি অসাধারণ এক আবিষ্কার। এমনকী এখানে নদীও আছে, ১২,০০০ ফুট উচ্চ পাহাড়ের উপর। ভ্যালিতে লেকও পাবেন, যা নয়নাভিরাম। আর দেখলে মনে হবে যেন আকাশ। চারদিকে তাকালেই শুধু আকাশ আর পাহাড়।
কীভাবে যাবেন? কলকাতা থেকে দিল্লি। সেখান থেকে বাসে করে যেতে হবে, তাহলে সুবিধা হবে। প্রাইভেট গাড়িতেও যেতে পারেন। তবে দিল্লি থেকে কুল্লু গেলেই সুবিধা। অথবা দিল্লি টু মানালি যেতে পারেন। তারপর মানালি ২ দিন ঘুরে স্পিতি ভ্যালি যেতে পারেন।

কখন স্পিতি ভ্যালিতে (Spiti Valley) যাবেন? স্পিতি ভ্যালি যাওয়ার রাস্তা ১২ মাস খোলা থাকে তবে আপনি কখন যাবেন এবং কোন ধরনের আবহাওয়া আপনার কাছে ভাল লাগে সেটার উপর নির্ভর করে। তবে ট্যুরিজম সিজনের কথা চিন্তা করলে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারফেক্ট সিজন ধরা হয়।

কী কী দেখবেন?
কল্পা : হিমাচলের এক কল্পলোক। প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে ছবি এঁকেছে কল্পার ক্যানভাসে। কল্পায় ঢুকতে দেখা মিলবে কিন্নর জেলার সদর শহর রেকংপিও। জমজমাট আর ভিড়ে ঠাসা। ছোট্ট শহরের মাথার উপর বরফমোড়া শৃঙ্গরাজদের ক্যানভাস। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দু’পাশে পাইনের আতিশয্য। তারই ফাঁকে পবিত্র কৈলাস শৃঙ্গের হাসিমাখা মুখ। কল্পার বাজারের কাছেই সুন্দর গোম্ফা হু-বু-লাংকার দেখে নিন। কল্পার ঠিক নিচেই চিনি গ্রাম। কাঠ, পাথরের সুন্দর ঘরবাড়ি আর সামদুব চোলিং বৌদ্বগুম্ফা এবং নারায়ণ-নাগিন মন্দির। আপেল চাষের জন্য বিখ্যাত এই জায়গা।

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীই ফের ত্রাতা ইস্টবেঙ্গলে নতুন লগ্নিকারী ইমামি

কোথায় থাকবেন : কল্পায় থাকার জন্য রয়েছে হিমাচল পর্যটন দফতরের হোটেল দ্য কিন্নর-কৈলাস। এছাড়াও সান এন স্নো, হোটেল কৈলাস ভিউ, হোটেল শীতল রয়েছে।
নাকো : রুক্ষতার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে এক অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা। পাথর দিয়ে গাঁথা গ্রাম। মাঝে কাকচক্ষুর মতো সুন্দর এক স্বপ্নাভ পবিত্র লেক। গ্রামের নাম, নাকো। রুক্ষতার মাঝে পাহাড়ের খাঁজে সবুজ ফসলের বাহার। ঘন আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের মিছিল। মাঝে পবিত্র নাকো লেক। উইলো ঘেরা লেক প্রদক্ষিণ করে চলে আসুন এক সুন্দর গ্রাম-ঠিকানায়। প্রাচীন লোটসাবা মনাস্ট্রি দেখে নিন। নীল আকাশের ঠিকানায় পতপত করে ওড়া লাল-সাদা-নীল পতাকার বাহার আর টাটকা হিমেল বাতাসে ৩৮০০ মিটারের নাকো অনবদ্য।

কোথায় থাকবেন : এখানে সেরকম কোনও সরকারি হোটেল নেই। তবে অনেক বেসরকারি হোটেল পেয়ে যাবেন।
টাবো : নাকো থেকে ঈগলরঙা পাহাড় আর রুক্ষতায় ভরপুর সৌন্দর্য দেখতে চলে আসুন স্পিতি উপত্যকার এক অপরূপ প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের দেশে, টাবোয়। এখানকার আপেলের বাগিচা চোখ টানবে নিঃসন্দেহে। দেখতে পাবেন ৯৯৬ সালের শতাব্দীপ্রাচীন গুম্ফা। ২৩টি চোর্তেন, ৯টি মন্দির। এর অন্দরমহলের স্টাকো ও ফ্রেস্কো চিত্রকলার অনবদ্য শোভা। ১৯৯৬ সালে প্রাচীন গুম্ফার পাশেই নতুন মনাস্ট্রি নির্মাণ করা হয়। পাহাড়ের কোলে বসানো এই গুম্ফা এক অনবদ্য শিল্পশৈলীর নিদর্শন।

কোথায় থাকবেন : এখানেও থাকার জন্য অনেক প্রাইভেট হোটেল পেয়ে যাবেন।
কাজা : স্পিতি উপত্যকার এক শীতল মরুর দেশ। ঘন নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। এখানে ঢুকতেই দেখা মিলবে নবতম মনাস্ট্রির। এখানকার সবচেয়ে বড় মনাস্ট্রির নাম লা ওড পাইলাখাং। এর ঠিক উপরেই আরও এক গুম্ফা লোব সাবা লাঙ্কা। কাজা যাওয়ার পথে ধানকর লেক আর ধানকর মনাস্ট্রি দেখতে ভুলবেন না কিন্তু৷ কাজা থেকে ২২ কিমি দূরে কি মনাস্ট্রি। ৪১১৬ মিটার উচ্চতায় এক ঝুরো পাহাড়ের কোলে দুর্গের আদলে তৈরি করা হয়েছে এই মনাস্ট্রি।

কোথায় থাকবেন : এখানে থাকার জন্য রয়েছে রাজ্য পর্যটন দফতরের হোটেল স্পিতি। বেসরকারি হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল স্পিতি সরাই, হোটেল ডেলেক হাউস, হোটেল ভেজোর, হোটেল স্পিতি ভ্যালি।
কিব্বের গ্রাম : কি মনাস্ট্রি থেকে ৮ কিমি দূরে কিব্বের গ্রাম। শীতে বরফে ঢেকে থাকে। ৪২০৫ মিটার উচ্চতার কিব্বের গ্রাম হল বিশ্বের উচ্চতম ‘মোটরেবল ভিলেজ’। পাহাড়ের মাথায় গ্রাম আর সুন্দর গুম্ফা। এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি মুগ্ধ করবে।

এইগুলি ছাড়াও রয়েছে কাজা থেকে ৮ কিমি দূরে প্রায় ১৩০০০ ফুট উচ্চতায় আরও এক নিসর্গের নাম, লাংজা গ্রাম। হিমেল বাতাস মাখা এই গ্রামে রয়েছে সুন্দর মনাস্ট্রি। লাংজা থেকে ১৫ কিমি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা চড়াই পেরিয়ে চলে আসুন কমিক ভিলেজে। এখানে তাংযুদ গুম্ফা আর তার আশপাশে কয়েকটি পরিবার নিয়েই এই গ্রাম। এরপর কমিক থেকে চলে আসুন হিকিমে। প্রায় ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায়। সাজনোগোছানো ঘর। রুক্ষতার মাঝে চাষজমিন। এই গ্রামেই রয়েছে বিশ্বের উচ্চতম ডাকঘর। আজও অনেকেই নিজের ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করে আসেন হিকিম পোস্টঅফিস থেকে।

Latest article