গুণে ভরপুর গুড়
গুড়ে রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ জলীয় অংশ, সুক্রোজ, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, জিঙ্ক, ভিটামিন বি সিক্স, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ডায়েটরি ফাইবার। এছাড়া রয়েছে ফাইটোকেমিক্যাল সহ আরও বিভিন্ন উপকারী মিনারেলস। আখ থেকে তৈরি গুড় চিনির একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প। মধু এবং গুড়ে সমপরিমাণ ক্যালরি থাকলেও গুড়কে বেশি উপকারী বলেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ গুড়ের মধ্যে থাকা ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ শরীরের জন্য না কি খুব প্রয়োজনীয়।
আরও পড়ুন-ওড়িশায় আরও এক রুশ নাগরিকের মৃত্যু, ১৫ দিনের মধ্যে ৩টি দেহ উদ্ধার
গুড়ের ইতিবৃত্ত
আখের বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum officinarum। আখের রস থেকে চিনি এবং একধরনের গুড় তৈরি হয় যাকে বলে আখের গুড়। খেজুরের রস থেকেও গুড় তৈরি হয়। আবার তাল থেকেও হয় গুড়। বর্ণে, গন্ধে, স্বাদের রানি সে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়া, শ্রীলঙ্কায় প্রচুর গুড় উৎপাদন হয়। আর এই সব দেশে গুড়ের বহুল ব্যবহার। সারা বিশ্বের অন্যতম বড় গুড় উৎপাদক হল এদেশের মহারাষ্ট্র। কারও কারও মতে গুড়ের জন্ম পূর্ব ভারতে। আবার ভিন্নমতে পর্তুগিজরা এটি ভারতে প্রবর্তন করেছিল। বিভিন্ন ধরনের গুড় পাওয়া যায় বাজারে। ঝোলা গুড়, ভেলি গুড়, চিটে গুড়, নলেন গুড় (খেজুর গুড়), পাটালি গুড় (জমাট বাঁধা), হাজারি গুড় (সাদা খেজুর গুড়) আখের গুড়। গুণের আধার গুড়ে আছে কিছু দোষও তবে তা প্রায় না ধরারই মতো।
আরও পড়ুন-ড্রাইভার তো রাখতে পারতে, ঋষভকে কপিল
ঔষধিগুণের আকর গুড়
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে গুড় খাওয়ার উপকারিতার উল্লেখ রয়েছে। অনেক আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করতে গুড়ের ব্যবহার হয়। এক বছরের পুরনো গুড় শরীরের জন্য দারুণ উপকারী। পুরনো গুড় রক্ত পরিষ্কার করে। এতে রয়েছে আয়রন যা হিমোগ্লোবিন বাড়ায় এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে।
চরকসুশ্রুত সংহিতা অনুযায়ী গুড়ের মধ্যে রয়েছে বিষনাশক গুণ। এটি শরীর থেকে টক্সিনকে দূর করে। লিভার এবং প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কারণ এরাই মূলত আমাদের শরীর থেকে বর্জ্যপদার্থকে নিষ্কাশিত করে। ফলে এরা সুস্থ থাকলে রক্ত শুদ্ধ হয়। গবেষণা অনুযায়ী গুড়ে রয়েছে রক্ত পরিশোধন করার ক্ষমতা। লিভারকে পরিস্রুত করে গুড়। লিভারের কাজের বোঝা কমিয়ে দেয়। আমাদের পাকস্থলীকে ঠান্ডা রাখে গুড়।
আরও পড়ুন-হারতেই ছুটিতে এমবাপে
কেন খাবেন গুড়
গুড়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ যা স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক ক্রিয়াকলাপের জন্য জরুরি। গুড় স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপটরের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, স্নায়বিক ক্ষয় প্রতিরোধ করে। অ্যালঝাইমার রোগ, মৃগীরোগ বা যে কোনও স্নায়বিক ভারসাম্যহীনতা প্রতিরোধ করে।
খিদে কমে গেছে? গোলমরিচের সঙ্গে খেজুর গুড় মিশিয়ে খান, দেখবেন খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করবে। আবার খুব বেশি খেয়ে ফেলছেন বা উল্টোপাল্টা খাচ্ছেন? হজমের গোলমাল, তাহলে খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণে গুড় খান, এতে হজমের সমস্যা কমবে। গুড় আমাদের বিপাকীয় ক্রিয়াকে উন্নতি করে। হজমের জন্য দায়ী এনজাইমগুলোকে সক্রিয় করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাকে দূর করে।
খুব চোঁয়া ঢেকুর উঠছে? সন্ধক নুনের সঙ্গে গুড় খান অল্প করে দিনে দু’বার, দেখবেন চোঁয়া ঢেকুর গায়েব।
আরও পড়ুন-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলো
শরীরে তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে গুড় ফলে শরীর গরম থাকে। রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধি করে।
ফুসফুসের কার্যক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে গুড়। প্রতিনিয়ত ধুলো, ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করলেও ফুসফুস তা নিজে থেকেই বের করে দেয়। কিন্তু দিনের পর দিন দূষিত পরিবেশে বা কলকারখানায়, খনিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই ক্ষতির থেকে ফুসফুসকে সুরক্ষিত রাখে গুড়। ফলে হাঁপানির সমস্যাও লক্ষণীয় ভাবে কমে। ঠান্ডা লাগা, কাশি এইসব সমস্যাগুলোর সঙ্গে যোঝে গুড়।
গুড়ে রয়েছে ভাল পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা শরীরকে ফ্রি রাডিকলসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে। শরীরকে কোনও ধরনের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখে গুড়। এতে রয়েছে ফেনলিক অ্যাসিড যা অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে অনেকাংশে সুরক্ষা দেয়।
প্রতিদিন এক টুকরো গুড় খেলে মহিলাদের পিরিয়ডজনিত অনেক সমস্যাই কম হয়। মহিলাদের পিএমএস উপসর্গ— যেমন মেজাজের পরিবর্তন, পিরিয়ড ক্র্যাম্প এবং তলপেটে ব্যথা, পেশির সঙ্কোচন, মাথাব্যথা এগুলো কমাতে সাহায্য করে। অনিয়মিত রজঃস্রাবের সমস্যাও কমায়।
আরও পড়ুন-ড্রাইভার তো রাখতে পারতে, ঋষভকে কপিল
খেজুরের গুড় খেলে চুল ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে। এটি ত্বককে টক্সিন মুক্ত রাখে। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। ত্বকে বার্ধক্যের ছাপ আসতে দেয় না, সৌন্দর্য ধরে রাখে। ত্বক শীতল করে ও ত্বকের ক্ষত মেরামত করে। কোলাজেন গঠনে সাহায্য করে। চুল পড়া কমায়।
যাঁরা ওজন কমাতে চাইছেন তাঁদের নিয়মিত অল্প করে খেজুর গুড় খাওয়া উচিত। গুড় পটাশিয়াম সমৃদ্ধ তাই এটি জল ধরে রাখা প্রতিরোধ করে। ফলে ইউরিন বেশি পরিমাণে ক্লিয়ার হয়।
চিটগুড়ও খুব উপকারী শরীরের জন্য। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর এনার্জি। প্রাণী খাদ্যশক্তির একটি বড় উৎস চিটগুড়। বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাদ্যের যেখানে অভাব সেখানে চিটগুড় ভাল বিকল্প ।
আরও পড়ুন-নয়া অ্যাপ, কর্মসূচি অভিষেকের
গুড়ে থাকা ম্যাঙ্গানিজ গলা খুশখুশ, শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করে। এটি খেলে ব্রংকিয়াল মাসলগুলো ভাল থাকে। ফলে গলা এবং শরীর অনেক রিল্যাক্সড লাগে।
গুড়ের আয়রন মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতে অনবদ্য। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি অ্যালার্জিক উপাদান। অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে।
জন্ডিস রোগের জন্য গুড় উপকারী। নিয়মিত খেলে ধীরে ধীরে সমস্যা কমবে।
আখের গুড়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি আর শর্করা থাকে। এ জন্য ডায়েরিয়ার রোগীকে আখের গুড়ের স্যালাইন ওয়াটার খাওয়ানো হয়। শর্করা শরীরের জল ধরে রাখতে সাহায্য করে। সেই কারণে উপোসের পর বা উপোস চলাকালীন অনেক গুড় জল খান, এতে ডিহাইড্রেশন হয় না। চিকিৎসকেরা গরমকালে গুড় জল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন-সংগীতশিল্পী সুমিত্রা সেনের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং বাতজনিত অন্য যে কোনও সমস্যায় গুড় খুব কার্যকরী কারণ এতে রয়েছে প্রদাহনাশক উপাদান।
তালের গুড়ে রয়েছে আয়রন এবং ফোলেট যা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খুব উপকারী।
তালের গুড় আমাদের ডাইজেস্টিভ এনজাইমকে সক্রিয় রাখে বলে বাওয়েল মুভমেন্ট উদ্দীপিত করে।
কেন খাবেন না গুড়
গুড় যতই উপকারী হোক না কেন, যাঁদের ওবেসিটি আছে, তাঁদের আখের গুড় বেশি না খাওয়াই ভাল। ক্যালরি বেশি থাকার কারণে আখের গুড় দ্রুত ওজন বাড়াতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন- প্রয়াত সংগীতশিল্পী সুমিত্রা সেন
গুড় মিষ্টিকারক। অতিরিক্ত পরিমাণে খেলেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যাঁদের সুগার রয়েছে তাঁদের কোনও গুড়ই বেশি না খাওয়া ভাল।
গুড়ে ভেজালের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। যা খুবই ক্ষতিকর। তাই সবসময় অপ্রক্রিয়াজাত গুড় খাওয়া উচিত। না হলে সংক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত পরিমাণে গুড় খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। চর্মরোগ দেখা দিতে পারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। গুড় সহ্য না হলে, বমিভাব হয়।