পলিসিস্টিক ওভারি

লাইফস্টাইল ডিজিজ শব্দটির সঙ্গে এখন আমরা ওতপ্রোত জড়িত। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ বা পিসিওডি হল এমনই একধরনের অসুখ। তবে আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান অনুযায়ী পিসিওডি কোনও রোগ নয়, রোগের উপসর্গের সমষ্টিমাত্র। তাই বিশেষজ্ঞরা এখন একে বলছেন ‘পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম’। বর্তমান বিশ্বের নারীরা যেসব শারীরিক সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগেন তাদের অন্যতম হচ্ছে এই পিসিওএস। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতি ১০ জন নারীর ১ জনের মধ্যে এই উপসর্গ বিদ্যমান। কেন মেয়েরা এত ব্যাপক হারে পলিসিস্টিক ওভারির শিকার? এর চিকিৎসাই বা কী? এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ পল্লব গাঙ্গুলি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক–শিক্ষক ডাঃ প্রদ্যোৎবিকাশ কর মহাপাত্র। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

বলিউডের অভিনেত্রী সারা আলি খান থেকে সোনম কাপুর, এমা থম্পসন, ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম-সহ প্রায় অনেক সেলিব্রিটিই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান (Polycystic ovary syndrome) ডিজিজের শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি দশজনে একজন ভারতীয় মেয়েরই এই অসুখ রয়েছে। কিন্তু কেন?
সাধারণত মেয়েদের বয়ঃসন্ধির শুরু থেকে এবং রি-প্রোডাক্টিভ এজ বা জননকালীন বয়সের সময় পলিসিস্টিক ওভারির উপসর্গ ধরা পড়তে শুরু করে। একেবারে প্রি-মেনোপোজাল ফেজের আগে পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নারী সন্তানধারণে সক্ষম ততদিন পর্যন্ত পিসিওডি দেখা দিতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে প্রায় শতকরা ৩ জন থেকে ২৭ জন মেয়ের মধ্যে এই উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া গবেষণায় প্রমাণিত যে বয়ঃসন্ধির অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সের মেয়েদের মধ্যে প্রায় শতকরা ১১ জন পলিসিস্টিক ওভারির শিকার। লাইফস্টাইল জনিত সমস্যা এবং হরমোনাল সমস্যা— দুটোকে একত্রে করেই উৎপত্তি হয় পিসিওডির।

এখন প্রশ্ন হল, পিসিওডি আর পিসিওএস কি এক?
পলিসিস্টিক ওভারিকে (Polycystic ovary syndrome) শনাক্ত করে সেই অসুখটি সম্পর্কে প্রথম বর্ণনা করেন আমেরিকান গায়নোকলজিস্ট ইরভিং এফ স্টেন এবং মাইকেল এল লেভেন্থাল। তখন এই রোগের নামকরণ হয়েছিল স্টেন লেভেন্থাল সিনড্রোম। এর পরবর্তীতে এই রোগের নামকরণ হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ সংক্ষেপে পিসিওডি। এখন সেই নামের পরিবর্তন করে হয়েছে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। বর্তমানে ডিজিজ শব্দটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে তার কারণ চিকিৎসক তথা বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এটা কোনও ডিজিজ বা রোগ নয়। এটা বেশ কিছু লক্ষণ বা উপসর্গের সমষ্টিমাত্র যার কারণ জিনগতও হতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালগুলোয় এই ধরনের সিস্টকে মুক্তোর মালা আখ্যা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ এক ঝলকে দেখলে মনে হবে ওভারি বা ডিম্বাশয়ের চারধার ঘিরে ছোট ছোট বিডের মুক্তোর মালা বসানো আছে।

কেন হয় পলিসিস্ট
সাধারণত একটি বয়স অতিক্রম করার পর সব মেয়েরই ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসেই ডিম নির্গত হয়। নিষেক না ঘটলে সেই ডিম দেহ থেকে বার হয়ে যায় রক্তের মাধ্যমে। যাঁদের পলিসিস্টিক ওভারি (Polycystic ovary syndrome) রয়েছে, তাঁদের এই ডিম নির্গত হওয়ার নিয়মটি নির্দিষ্ট রীতি মেনে হয় না। কখনও অপরিণত ডিম, কখনও-বা আংশিক, সম্পূর্ণ ডিমে ভরে যায় ডিম্বাশয়। এই অপরিণত ডিমগুলো দেহ থেকে বের হতেও পারে না। এক সময় সেই ডিমগুলোই জমে সিস্টের আকার নেয়। ছোট ছোট টিউমারের আকারে দেখতে এই সিস্টগুলো তরল বা অর্ধতরল উপাদান দিয়ে তৈরি। ‘পলি’ কথার অর্থ অনেক। অনেক সিস্ট ডিম্বাশয়ের উপর জমতে থাকে।
আবার ডিম্বাশয় থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন নিঃসরণ হলেও তা ডিম্বাশয়ের চারধারে জমে সিস্টের আকার নেয়।
এটা কোনও রোগ নয় রোগের কিছু উপসর্গ মাত্র। আসল রোগটি হল মেটাবলিক ডিজ অর্ডার বা মেটাবলিজমের সমস্যাজনিত অসুখ। এর উৎস খোঁজা খুব মুশকিল। তবে আপাতভাবে বলা যেতে পারে এই রোগ জেনেটিক এবং এর সঙ্গে পরিবেশগত ফ্যাক্টরগুলো যখন মিলে যায় তখন এই রোগটি প্রকাশ পায়। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারি।
পলিসিস্টিক ওভারির মূল কারণ হচ্ছে ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর ওয়ান বা আইজি এফ ১। এটি এক ধরনের এনজাইম বা প্রোটিন। যা শরীরে বৃদ্ধি পেলে পলিসিস্টিক ওভারি হয়। এর সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া এবং পরিশ্রম কম হলে দিনে দিনে এই রোগ তরান্বিত হয়। এই রোগীরা হাইপার ইনসুলিমিয়ার শিকার হন অর্থাৎ ইনসুলিনের পরিমাণ এদের শরীরে বেশি থাকে কিন্তু ইনসুলিনের কাজটা কম হয় যাকে এক কথায় বলা যায় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। সেই কারণে পরবর্তীকালে এঁদের অনেকেরই টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
পলিসিস্টিক ওভারি এক ধরনের মেটাবলিক হরমোনাল ডিজ অর্ডার বা বিপাকীয় ক্রিয়ার অসাম্যতা যেটা এফএসএইচ এবং এলএইচ- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থেকে আসে। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এই হরমোন নিঃসৃত না হলে ওভিউলেশন হয় না পাশাপাশি ওভারিও খুব বেশি পরিমাণে পুরুষ হরমোন নিঃসরণ শুরু করে দেয়। তাই পিসিওএস-এর রোগীর শরীরে পুরুষ হরমোনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এই জন্যই পলিসিস্টিক ওভারি যাঁদের রয়েছে তাঁদের গায়ে, হাত, পায়ে, মুখে রোমের আধিক্য দেখা দেয়। আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে যে হাইপোথ্যালামাস তার ওপরেও প্রভাব পড়ে ফলে তাঁদের পিরিয়ডিক্যাল সমস্যাও দ্যাখা দেয়। অনিয়মিত ঋতুস্রাব হয়। ওজন বেড়ে যায়।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
পিরিয়ডস বা ঋতুস্রাব ঠিকমতো না হলে সঙ্গে তলপেটে ব্যথা রয়েছে।
মুখে ব্রণ, হাত-পায়ে অবাঞ্ছিত রোম, চুল ঝরছে, ওজন বাড়ছে। এক্ষেত্রে আলট্রাসোনোগ্রাফি করলে রোগটা ধরে পড়ে।
পলিসিস্টিক ওভারির ক্ষেত্রে ইনফার্টিলিটি হল একটা খুব কমন প্রেজেন্টেশন। বেশিরভাগ বিবাহিত মহিলাই অনেক সময় ইনফার্টিলিটির সমস্যা নিয়ে আসেন।
হাত কিংবা স্তনের নিচের ত্বকে, গলার পেছনের অংশে, কুঁচকিতে কালো দাগ ইত্যাদি। ঘুমে সমস্যা, মাথাব্যথা৷

অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা
সবার আগে বিপাকীয় ক্রিয়ার ভারসাম্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। মানে মেটাবলিক ডিজ অর্ডারকে রিভার্স করতে হবে। এর সবচেয়ে সহজ উপায় হল লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট। প্রথমেই খাওয়াদাওয়ার নিয়ন্ত্রণ বা প্রপার ডায়েট সঙ্গে এক্সারসাইজ শুরু করতে হবে।
এটাই প্রাথমিক চিকিৎসা। প্রতিটি মহিলারই উচিত ওজন বাড়তে না দেওয়া এবং খামোকা ক্যালোরি বেশি না নেওয়া। এতেই অর্ধেক সমস্যার সমধান হয়ে যাবে।
পিসিওএস এবং টাইপ টু ডায়াবেটিস খুব রিলেটেড একটা রোগ। একটা থাকলে আর একটা থাকতেই পারে। পিসিওএস রয়েছে যাঁদের তাঁদের প্রেগনেন্সিতে ডায়াবেটিস ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে প্রেগনেন্সিতে অনেক জটিলতা আসে। যেমন দুম করে মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং মিসক্যারেজ হতেও দেখা যায় একাধিকবার।
পলিসিস্টিক ওভারির চিকিৎসায় সাধারণত দুটো ওষুধ দেওয়া হয়। যা একধরনের ইনসুলিন সেনসিটাইজার। মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ। এগুলো ব্লাড সুগারের জন্যও দেওয়া হয় আবার পলিসিস্টিক ওভারির কিওর করতেও দেওয়া হয়। দুই ক্ষেত্রেই ভাল কাজ করে। এছাড়া বিভিন্ন ইনোসিটল রয়েছে যেমন মায়ো ইনোসিটল এবং কাইরো ইনোসিটল। রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ দুটোর ডোজ আলাদা হয়। তবে এই ওষুধ শরীরে ধরতে এবং কাজ শুরু করতে করতে পাঁচ-ছ’মাস সময় লাগে। অনেকে বেশিদিন খেতে পারেন না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় কিছুটা হলেও। বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্ক যাঁদের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি তাঁরা অনেক সময় খেতেই চান না।
মেটফরমিন জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমন, একটু গা-গুলোয়, বমি-বমি ভাব হয় আবার কারও-কারও বমি হয়, মাথা ঘোরে, লুজ মোশন হয়। অনেকেই এরকম হলে বেশিদিন ওষুধ খেতে পারেন না তখন বন্ধ করে দিতে হয়।
তাই সাধারণত যাঁদের বিয়ে হয়নি বা বিবাহিত হলেও সন্তান নেওয়ার তাড়া নেই তাঁদের ঋতুস্রাব নিয়মিত করার জন্য কনট্রাসেপটিভ পিল প্রেসক্রাইব করা হয়। এতে করে ঋতুস্রাবটা নিয়মিত হতে শুরু করে। এই কনট্রাসেপটিভ পিল ওভারিকে একটু বিশ্রাম দেয়। এফএসএইচ, এলএইচের মাত্রা কমিয়ে দেয়, একটা ভারসাম্য নিয়ে আসে। একটানা ডিম্বাণু তৈরি হতে পারে না ফলে ওভারি বিশ্রাম পায়। একটানা ডিম্বাণু তৈরি হতে থাকলে অনেকসময় সেগুলো পুরো পরিণত হয় না অনেক সময়।
এছাড়া পিল একটানা নেওয়ার ফলে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন তৈরি হওয়া কমতে শুরু করে। এর ফলে চুল ওঠা, অবাঞ্ছিত রোম ইত্যাদি কমে যায়। এর পাশাপাশি তাঁকে ডায়েট আর এক্সারসাইজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। কন্ট্রাসেপটিভ দীর্ঘদিন খেলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় এটা ভুল ধারণা। কনট্রাসেপটিভে যেটুকু ওজন বাড়ে তা খুবই কম।
কিন্তু কেউ দ্রুত সন্তান চাইছেন বা পিল দিয়ে কাজ হচ্ছে না, ওজন কমছে না তাদের মেটফরমিন বা ইনোসিটল জাতীয় ওষুধ ছাড়া গতি নেই।
পলিসিস্টিক ওভারি সারাতে সিস্ট অপর পদ্ধতি অপারেশ। চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেন অপারেশনের দিকে না যেতে। কিন্তু ওষুধ বা পিলে কোনও কাজ না হলে লেপ্রোস্কোপির মাধ্যমে ওভারিয়ান ড্রিলিং করে সিস্টগুলোকে পাংচার করে দেওয়া হয়। চারটে জায়গায় পাংচার করা হয় এর ফলে আবার ওভিউলেশন নতুন করে শুরু হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-বিধানসভার উপনির্বাচনের প্রার্থীপদ পেলেন সায়ন্তিকা ও রেয়াত হোসেন সরকার

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা
পলিসিস্টিক ওভারির ক্ষেত্রে শরীরে পুরুষ হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায়। এছাড়া শরীরে উৎপন্ন হওয়া ইনসুলিন কোষে ঢুকতে পারে না রক্তেই থেকে যায় ফলে রক্তে ইনসুলিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেড়ে যায় তখন পলিসিস্টিক ওভারির সম্ভাবনা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়।
আয়ুর্বেদে যে কোনও রোগের চিকিৎসার করতে দুটো মূল নীতি মানা হয় এক নিদান এবং অন্যটি পরিবর্জন। নিদান মানে হল রোগের কারণ। আয়ুর্বেদ অনুসারে রোগের কারণ নির্মূল করলেই রোগ নির্মূল হবে বলে মনে করা হয়।
নিদান হল দুটো— এক, আহার-নিদান অর্থাৎ খাওয়াদাওয়া। ভুলভাল খাদ্যাভ্যাস এবং বিহার-নিদান মানে কাজকর্ম অর্থাৎ পরিশ্রম কম করা, এক্সারসাইজ না করা এগুলোর দুটো কারণ পলিসিস্টিক ওভারিকে তরান্বিত করে। তাই প্রথমেই সেগুলোকে পরিবর্জন করতে হবে।
এর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, যোগাসন করা, শরীরে জমে থাকা টক্সিনকে ঘামঝরিয়ে বের করে দেওয়া এবং পুষ্টিকর ডায়েটের মাধ্যমে নিজেকে একটা স্বাভাবিক রুটিনে ফেরাতে হবে।
মলমূত্রের বেগ ধারণ করা চলবে না। সেগুলো স্বাভাবিক করতে হবে।
কনস্টিপেশন থাকলে তা নির্মূল করতে হবে। প্রয়োজনে মাইল্ড ল্যাক্সেটিভ যেমন হরীতকীর গুঁড়ো, ত্রিফলা চূর্ণ খাওয়া যেতে পারে।
শীতল ক্রিয়া অর্থাৎ বেশি ঠান্ডা বাতাস নেওয়া বা অত্যধিক ঠান্ডা জল খাওয়া চলবে না।
অতিরিক্ত জার্নি, দিবানিদ্রা এগুলো বর্জন করতে হবে। ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, স্পাইসি ফুড বর্জন করতে হবে। তার পরিবর্তে সরল আহার করতে হবে। ডায়েটরি ফাইবার যেন খাবারে মেন্টেন্ড হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অতিকটূ, অতি অম্ল, অতি মধুর, বেশি লবণ জাতীয় খাদ্য পরিবর্জন করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় বাড়িতে কোনও শুভ অনুষ্ঠান বা পুজো থাকলে ঋতুস্রাব বন্ধ করতে বাড়ির বড়রা ওষুধ খেয়ে নিতে বলেন। একে বলে অ্যাবিউজ অফ হরমোনাল পিল। যা পলিসিস্টিক ওভারিকে তরান্বিত করে। এটা করা যাবে না। পিরিয়ডের নর্মাল ফ্লো যতটা সম্ভব বজায় রাখতে হবে।
পিসিওএস-এর চিকিৎসা দু’রকমভাবে হয়। প্রথম শোধন চিকিৎসা। আমাদের শরীরে অসংখ্য সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্রোত রয়েছে যাকে সোজা ভাষায় বলা হয় চ্যানেল। সেই চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে শরীরের হাইড্রেশন হয়, পুষ্টিবাহিত হয় তেমনই আবার বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। সুতরাং সেই চ্যানেলগুলো ব্লক হয়ে গেলে আয়ুর্বেদের ভাষায় স্রোত অবরোধ হলে বিভিন্ন রোগ হয় যার মধ্যে অন্যতম হল পলিসিস্টিক ওভারি। এই স্রোত যাতে অবরুদ্ধ না হয় তাঁর জন্য শোধন চিকিৎসা করা হয়। অর্থাৎ শরীরকে বায়োপিউরিফিকেশন বা ডিটক্সিফিকেশন করানো হয়।

শোধন চিকিৎসার চারটে ধাপ
১) স্নেহন। যে-ধাপে সারা গায়ে তেল মাখানো হয়।
২) স্বেদন। অর্থাৎ ঘাম ঝরানো। এর জন্য পেশেন্টকে কম্বল চাপা দিয়ে রাখা হয় অথবা মেশিনের সাহায্যে শরীর গরম করিয়ে বা গরম সেঁক দিয়ে ঘাম বের করানো হয়।
৩) এরপর বিরেচন। অর্থাৎ মলত্যাগ করিয়ে টক্সিন বের করে দেওয়া হয়।
৪) পরবর্তী ধাপ হল বস্তি। মলদ্বার দিয়ে মেডিকেটেড অয়েল বা ওষুধ দিয়ে ফোটানো জল পুশ করিয়ে দেওয়া হয়। এই ওষুধের মাধ্যমে লার্জ ইন্টেস্টিনের বিভিন্ন অবস্ট্রাকশনকে সরিয়ে ফেলা হয়। এই শোধন থেরাপি করানোর পর দ্বিতীয় ধাপ হল শমন থেরাপি। শমন হল প্যালিয়েটিভ থেরাপি। একে শমন ঔষধিও বলে।
অনেকেই শোধন থেরাপিতে যেতে চান না। তাঁদের শুধু শমন থেরাপিও করানো যেতে পারে। এতেও ভাল কাজ হয়। কিন্তু শোধন এবং শমন দুটো চিকিৎসা একসঙ্গে নিলে পিসিওএস -এ দ্রুত ফল মেলে।
শমন ঔষধিতে নিয়মিত কয়েকটা সিঙ্গল হার্বস বা একক ভেষজের ব্যবহার করা হয়। যেমন অশ্বগন্ধা, গুরুচি, গুলঞ্চ, হলুদ, দারুচিনি, শতাভরী, দশমূল, ত্রিফলাচূর্ণ তিন গ্রাম করে দু’বার খেলে খুব ভাল ফল দেবে।
এতে পুরুষ হরমোন নিঃসরণ কমবে এবং ইনসুলিন বেড়ে গিয়ে থাকলে সেটাও কমাবে। আয়ুর্বেদের ভাষায় বায়ু-পিত্ত-কফ এই তিনটে দোষের বৈষম্যকে সাম্যাবস্থায় নিয়ে আসবে এই ওষুধ।
এছাড়া এই পলিসিস্টিক ওভারির সঙ্গে আরও কিছু প্রদাহজনিত রোগ শরীরে দেখা দেয় যাকে পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ বলে। সেক্ষেত্রে এই হলুদ, গুরুচি বা গুলঞ্চ প্রদাহকেও কমায়।
এছাড়া পেট পরিষ্কার করতে শুধু হরীতকী চূর্ণ দেওয়া হয়। এছাড়া গুগ্গুল দিয়ে তৈরি বেশকিছু ওষুধও দেওয়া হয় যা পলিসিস্টিক ওভারির জন্য খুব কার্যকরী যেমন গোক্ষুরাতি গুগ্গুল পাঁচশো মিলিগ্রাম করে দিনে দু’বার গরম জলে দেওয়া যেতে পারে।
কৈশোর গুগ্গুল,কাঞ্চন ছাল দিয়ে তৈরি কাঞ্চনার গুগ্গুল পাঁচশো মিলিগ্রাম করে দিনে দু’বার গরম জলের সঙ্গে দেওয়া যেতে পারে।
আরোগ্য বর্ধনী বটি আড়াইশো থেকে পাঁচশো মিলিগ্রাম করে দিনে দু’বার দেওয়া যেতে পারে।
এর পাশাপাশি বেশ কিছু পাচন খাওয়ানো যেতে পারে রোগীকে তাতেও খুব ভাল কাজ হয় যেমন দশমূল ক্বাথ। এটা ২০ এমএল করে সকালবেলা খাওয়ানো, যেতে পারে। আমলকী, হরীতকী, বহেড়া এই ত্রিফলা বা ত্রিকটু অর্থাৎ শুট পিপুল, মরিচ ইত্যাদি সেদ্ধ করা জল ২০ এমএল করে দেওয়া যেতে পারে রোজ। এতে মেটাবলিজম ভাল হয়। অশ্বগন্ধা স্ট্রেস কমায়। অত্যধিক স্ট্রেসের কারণেও পলিসিস্টিক ওভারি হতে দেখা যায়।
পিসিওএস-এর রোগীদের ঋতুস্রাবের সময় পেটে খুব ব্যথা হয় এক্ষেত্রে নারকেল তেল তলপেটে মালিশ করলে খুব ভাল ফল দেয়।
পিসিওএস-এর জন্য লোব্যাক পেন হয়। এক্ষেত্রে কোমরে নারকেল তেল বা রসুন তেল মালিশ করা যেতে পারে এতে পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যাতেও উপকার মেলে।
সর্বোপরি পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে। অন্তত দিনে তিন সাড়ে তিন লিটার । সঙ্গে স্ট্রেস লেভেল কমাতে হবে।
আয়ুর্বেদের চিকিৎসায় রোগী শোধন-শমন চিকিৎসার সঙ্গে যথাযথ ডুজ অর ডোন্টস মেনে চললে খুব কম দিনেই ভাল ফল পান।

Latest article