মোদি সরকার দেশের ৪৪টি শ্রম আইনকে ৪টি শ্রম কোডের মধ্যে নিয়ে শ্রমিক-কর্মীর যতটুকু অধিকার ছিল তা কেড়ে নিচ্ছে। লেবার কোড শ্রমিক-কর্মচারীদের সাংবিধানিক অধিকার, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদের অধিকার, সামাজিক ন্যায় ও সমতার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। লিখছেন
পূর্ণেন্দু বসু
দেশের শ্রম আইন সংস্কারের প্রয়োজন ছিল, তা কাঙ্ক্ষিতও ছিল। শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, শ্রমিক অধিকারের সম্প্রসারণ, মজুরি সুরক্ষা ও পেশাগত সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলি নিয়ে নানা জাতের জাতীয় কমিশন নানা সময়ে সরকারকে বহু পরামর্শ দিয়েছে। সেই পরামর্শগুলির মধ্যে মূল বিষয়গুলি ছিল— ১. সংগঠিত-অসংগঠিত তথা অসুরক্ষিত শ্রমিক-কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা। ২. বেতন-বৈষম্য দূর করা। ৩. স্থায়ীকাজের নিশ্চয়তা বৃদ্ধি। ৪. কর্মজীবী নর-নারীর জীবনমান উন্নয়ন। ৫. সমকাজে সমবেতন। ৬. সামাজিক সুরক্ষার আরও শক্তিশালী রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। সরকার এই সুপারিশগুলির কোনও তোয়াক্কা করেনি। যা করল তা হল, সংস্কারের নামে শ্রমজীবী মানুষকে প্রতারণা।
মালিক পক্ষ যে-ভাবে শ্রমিকের শ্রম ব্যবহার করতে চাইছিলেন, অনেকটা সেইভাবেই চার লেবার কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। ঠিকা শ্রমিকদের একটা বড় অংশকে আইনি সুরক্ষার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মজুরি-সংক্রান্ত শ্রম কোডে বলা হয়েছে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে চালু যে ব্যবস্থা তা উঠিয়ে দিয়ে ‘টাইম রেট’ (সময়ভিত্তিক কাজ) ও পিসরেট বা ফুরন প্রথায় কাজের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে। এর ফলে মজুরির ক্ষেত্রে দক্ষতার মাপকাঠি তুলে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি-বিরোধী মঞ্চ জরুরি, রাজ্যে হাসপাতাল গড়তে চান কাফিল
ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত মেনে চলা হত। যেমন, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, সন্তানপালন, পেনশন, সঞ্চয় ইত্যাদি স্থিরকৃত নির্দিষ্ট বিষয়গুলি ধরে নির্ধারিত হত মজুরি। এর মাধ্যমে সাংবিধানিক দায় ও সুপ্রিম কোর্টের ন্যূনতম মজুরি-সংক্রান্ত নির্দেশকে অমান্য করা হল। উল্লেখ্য, জীবনযাত্রার জন্য যে খরচ, সেই অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি ন্যায় ও ন্যায্যতার ধারণার সঙ্গে যুক্ত। লেবার কোড এই মৌলিক মানবিক ধারণাকে অস্বীকার করেছে।
ন্যূনতম মজুরির হার নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংশোধন করা বাধ্যতামূলক ছিল। তা তুলে দেওয়া হল। ১৮ হাজার টাকার বেশি যাঁরা বেতন পাবেন, তাদের বেতন থেকে কর্তৃপক্ষ টাকা কেটে নিতে পারবেন। এরকম কোনও অধিকার মালিকদের ছিল না।
আরও পড়ুন-সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ রাজ্যের
কার্যত ৮ ঘণ্টা কাজের সময় তুলে দেওয়া হয়েছে। ওভারটাইমও তুলে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, এখন থেকে কোনও বাড়তি টাকা না দিয়ে শ্রমিকদের বাড়তি সময় কাজ করানো যাবে। নারী-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রাত ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কাজ না করানোর যে আইন ছিল তা তুলে দেওয়া হয়েছে। লেবার কোডের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ফ্লোর লেভেল মজুরি নির্ধারণ করেছে ৪,৬২৮ টাকা। অর্থাৎ দিনে ১৭৮ টাকা। যা কি না ১০০ দিনের কাজের মজুরির থেকেও কম। উল্লেখ করা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার নির্ধারিত চালু মজুরি কোনও শিল্প বা পেশাতেই এখন এর থেকে বেশি ছাড়া কম নয়।
শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিপজ্জনক যে উৎপাদন প্রক্রিয়া চিহ্নিত করা ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে। কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি স্থির করার অধিকার সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া হল। পানীয় জল, টয়লেট, বাসস্থানের সুবিধা, ক্রেশ, ক্যান্টিন ইত্যাদি কল্যাণমূলক কাজকর্ম আর মালিকদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক দায় হিসেবে থাকল না। এ-সব এখন সরকারের সদিচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হল।
ফ্যাক্টরির সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় এমন কারখানায় ১০ বা তার বেশি শ্রমিক নিযুক্ত হলেই সেটি আইনের আওতায় আসে। নতুন কোডে এটি ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ করা হয়েছে। এর ফলে ছোট কারখানাগুলি এই আইনের বাইরে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। লেবার কোড তৈরি করে মোদি সরকার জানিয়ে দিয়েছে, দেশে কোনও স্থায়ী চাকরি থাকবে না। মেয়াদি চুক্তিতে চাকরি চালু। এমনকী সরকারি চাকরিকেও এর আওতায় আনা হয়েছে। ৬ মাস মেয়াদের চুক্তিতে চাকরি হবে।
আরও পড়ুন-Kalyan Banerjee: তোপ কল্যাণের
শিল্প-সম্পর্কিত কাজে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে দরকষাকষির কোনও সুযোগ রাখা হয়নি। লেবার কোড অনুযায়ী ৫০ থেকে ৩০০ শ্রমিক কাজ করেন এমন সংস্থায় লেফ-অফ, ছাঁটাই বা ক্লোজার করার জন্য সরকারের অনুমতির আর কোনও দরকার থাকল না। অথচ দেশে এখন ৮০ শতাংশ সংস্থায় ৩০০-র কম শ্রমিক কাজ করেন। এই সব কারখানায় এখন সহজেই ছাঁটাই করা যাবে। পিএফ, পেনশন, গ্র্যাচুয়িটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি স্কিমে নথিভুক্ত করার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাবে কেন্দ্রীয় সরকার। এই সব স্কিমে মালিকদের প্রদেয় অংশ চাইলে ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের। বঞ্চিত হবেন শ্রমিকরা।
সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের সামাজিক সুরক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে সেস বাবদ পাওয়া ৪৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। সেই টাকার কী হবে, সে-সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। বিপুল অসংগঠিক শ্রমিকদের দায় কে নেবে তা স্পষ্ট করা হয়নি।
আরও পড়ুন-কোভিড রুখতে সতর্কতা সংশোধনাগারে
এখন থেকে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে কমপক্ষে মোট শ্রমিকের ১০ শতাংশ বা ১০০ জন শ্রমিক সদস্য থাকতে হবে। যেখানে অনেকগুলি ইউনিয়ন আছে সেখানে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ সদস্য থাকলে তবেই মালিক-কর্তৃপক্ষের কাছে সেই ইউনিয়ন স্বীকৃতি পাবে। সমকাজে সমমজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার শ্রমিকদের টাকা-পয়সা না দিলে এখন থেকে আর প্রিন্সিপাল এমপ্লয়ার তথা মুখ্য নিয়োগকর্তার কোনও আইনি দায়বদ্ধতা থাকল না। পাল্টে দেওয়া হয়েছে শ্রমিকের সংজ্ঞা।
এই আইনগুলির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছোট হয়ে গেল। ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রটি প্রায় ভেঙে দেওয়া হল। শ্রমিকের সংঘবদ্ধ ক্ষমতা ভেঙে দিয়ে তাকে ব্যক্তি শ্রমিকে পরিণত করা এবং পুঁজির প্রভুত্ব করার পথকে প্রশস্ত করতেই শ্রম আইন সংস্কারের এই ধ্বংসাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।