ছিন্নমূল মানুষদের যাপনচিত্র ঘিরে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কোনও না কোনও সময়, কোনও না কোনও মানুষ আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় নানা কারণে যে সমস্ত মানুষ ছিন্নমূল হয়েছেন, ছিন্নমূল হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের জীবনের নানা দুঃখ-যন্ত্রণার কথা, লড়াইয়ের কথা, জীবনের মূলমন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। তা নিয়ে সাহিত্য রচনা করা হয়েছে। গান রচিত হয়েছে, কবিতা লেখা হয়েছে।
আরও পড়ুন-আইসক্রিমের রূপকথা
এই ছিন্নমূল মানুষের ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশের সব ধর্মের মানুষদের ভিতর একটা অভিজ্ঞতা আছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ভারতীয় উপমহাদেশের অভ্যন্তরীণ দেশগুলির ভিতরে ছিন্নমূল মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে যেভাবে দাগিয়ে দিয়ে গেছে, সে যন্ত্রণার সমুদ্র আজও বোধহয় আমরা অতিক্রম করতে পারিনি। ’৪৭ পূর্ববর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ উদ্বাস্তু কাকে বলে তা জানত কেবলমাত্র পুঁথির পাতায়। বাস্তব অভিজ্ঞতা কিছু ছিল না। আরব দেশের নানা সময়, নানা সমস্যাকে কেন্দ্র করে, সেখানকার উদ্বাস্তু সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, তার কথা ভারতের মানুষ জেনেছেন পুঁথির পাতা থেকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যেসব অঞ্চল থেকে আসা মানুষদের অভিজ্ঞতার নিরিখেও সেই যন্ত্রণার মানসিক শরিক হয়েছেন।
ভারতের মানুষজনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ছিন্নমূল মানুষদের জীবন যন্ত্রণার ভয়াবহতাকে সমসাময়িকতার প্রেক্ষিতে মানুষের সামনে বাস্তব বেদনার ছবি এঁকেছে। তারপরও আমাদের দেশের উপর কাঁচি চালিয়েছে রাডক্লিফ। ভারতের মূল ভূখণ্ডের মানুষদের একটা বড় অংশের মানুষদের ছিন্নমূল হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, সেই সময়কাল থেকে আজ অবধি যেন নদীর প্রবাহিত স্রোতের মতো আমরা বয়ে চলেছি।
আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা
ঋত্বিক ঘটক থেকে মান্টো, শিল্পকলার উৎকর্ষতায় চিরকালীন সম্পদ করে দিয়েছেন ছিন্নমূল মানুষদের যন্ত্রণাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, পাকিস্তানের মুহাজির বা ভারত থেকে যে সমস্ত মুসলমান ছিন্নমূল হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ, আজকের বাংলাদেশ গিয়েছেন, বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে স্থাপিত হওয়ার পর উর্দুভাষী যেসব মুসলমানরা রয়েছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ইতিবাচক ভূমিকা না থাকলেও, রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের মতো বাঙালি হয়ে তারা বাঙালির সর্বনাশ চায়নি। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে চেয়েছিল। কারণ, তারা বাংলাভাষী অপেক্ষা উর্দুভাষীদের প্রতি নিজেদের আনুগত্য এবং সাযুজ্য বেশি অনুভব করত।
সেই সব মানুষদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন আজ উদ্বাস্তু দিবসের প্রেক্ষিতে আমাদের বিশেষ ভাবে মনে রাখা দরকার। স্টেশন ওয়াগনের মধ্যে একটি মুহাজির পরিবারকে দেখবার পর শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছিলেন। অমন মর্মস্পর্শী ভাষায় উদ্বাস্তু সমাজকে নিয়ে লেখা কবিতা বাংলা ভাষাতে খুব কম আছে। দুঃখের বিষয় উদ্বাস্তু সমাজের মানবাধিকার নিয়ে আমরা সোচ্চার কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশে যেসব মুহাজির রয়েছে, তাদের যে মানব অধিকার দূরের কথা, মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে, তা নিয়ে কিন্তু না প্রথাগত প্রচার মাধ্যম, না সামাজিক প্রচার মাধ্যম, কোথাও কোনও আলোচনা আমরা দেখতে পাই না।
আরও পড়ুন-আগামীর পড়ুয়াদের অতীত, না-চেনাতে এবার বইয়ে বদল
ঠিক একই কথা প্রযোজ্য দেশভাগের সময়কালে যেসব বাঙালি মুসলমান কেবলমাত্র ধর্মের টান অনুভব করে এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুন একটা নিরাপত্তাহীনতা ভুগতে ভুগতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেছেন, সেই সব মানুষদের নিয়ে এপার বাংলা সাহিত্য কাদের মধ্যে সমরেশ বসু ‘খণ্ডিতা’ ছাড়া আর কি একটি ও সাহিত্য রচিত হয়েছে? ওপার বাংলাতে আমরা দেখেছি শওকত আলির ‘বসত’ সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ মতো হাতেগোনা দুই একটি কথাসাহিত্য বা হাসান আজিজুল হকের কিছু কিছু স্মৃতিচারণমূলক আখ্যান। যেখানে এপার বাংলা থেকে দেশভাগের কালে বা দেশভাগের পরবর্তী সময়ের নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের জেরে বাঙালি মুসলমানদের ছিন্নমূল হওয়ার জীবনযুদ্ধের যন্ত্রণার কথা ।
আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা
তার বাইরে কি সেই মানুষদের কথা কিছু বলার ছিল না? সেই মানুষদের যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা আমাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে ধরে রাখবার কোনও প্রয়োজনীয়তার তাগিদ এপার বাংলাতে সমরেশ বসু ব্যতীত আর কেউ সেভাবে অনুভব করলেন না কেন? যে বামপন্থী কথাসাহিত্যিকরা দেশভাগ ঘিরে নানা ধরনের মর্মস্পর্শী আখ্যান রচনা করেছেন, ছিন্নমূল মানুষদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতির কথা লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁরা কেন এপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া মুসলমান সমাজের প্রতি কোনওরকম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেননি তা নিয়ে আজকের দিনে গবেষণা প্রয়োজন।
একইসঙ্গে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উদ্বাস্তু সমাজকে এপার বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বামপন্থীরা ইউসিআরসি নেতৃত্বে আন্দোলন করেছিলেন। জমি দখলের লড়াই করেছিলেন। সেখানে কিন্তু একটা বড় অংশের এপার বাংলা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমানদের জমি দখল করা হয়েছিল। ছিন্নমূল মুসলমানরা জমি এক্সচেঞ্জের চেষ্টা চরিত্র করেও কিন্তু সফল হননি। সেইসব ছিন্নমূল মুসলমানেরা কিন্তু কেউ বেলেঘাটার নস্কর পরিবারের মতো জমিদার জোতদার ছিলেন না। ছিলেন অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও ছিলেন।
আরও পড়ুন-উর্দি ছেড়ে কোচিং শিক্ষক পুলিশ
তাই দেশভাগের কালে বাঙালি মুসলমানের উপরে বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক- সাংস্কৃতিক, এমনকী ধর্মীয় অত্যাচার হয়েছে তার বিবরণ সেভাবে রাখা হয়নি। ফলে আমাদের দেশভাগজনিত সময়কালের ইতিহাস, ছিন্নমূল মানুষদের লড়াই, সংগ্রামের ইতিহাস এককথায় অসম্পূর্ণ। এই ইতিহাস কেবলমাত্র হিন্দু জনগোষ্ঠীর ইতিহাস। দেশভাগের যে যন্ত্রণা হিন্দু জনগোষ্ঠীর মতোই মুসলমান জনগোষ্ঠীকেও পোহাতে হয়েছে, তার কোনও সামাজিক দলিল এপার বাংলায় তৈরি হয়নি। এটা ইতিহাসের কেবল অপরিপূর্ণতাই নয়, এক ধরনের বিকৃত চিহ্ন।
দেশভাগের কালে এপার বাংলা থেকে যেসব মুসলমানেরা ওপার বাংলায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, সেইসব মানুষদের জানমালের ওপরে ভারতের বিভিন্ন অংশের সীমান্তে প্রহরারত পুলিশ বা বিএসএফ ইত্যাদিরা যে ধরনের লুটতরাজ চালিয়েছে, তা নিয়ে এপার বাংলায় ক’টা সন্দর্ভ রচিত হয়েছে? ক’টা সাহিত্যিক উপাদান তা নিয়ে রচিত হয়েছে? অথচ যদি আমরা আজও ক্ষেত্রসমীক্ষা চালাই, তাহলে দেখতে পাব যে, অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা দেশভাগের সময়কালে এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় যাওয়ার সময়, নিজেদের সামান্য সহায়-সম্পদ সোনাদানা ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ার পথে, সীমান্তে ভারতীয় রক্ষীদের হাতে সবকিছু খুইয়েছেন। পরবর্তীকালে বহু চেষ্টাচরিত্র করে সেগুলো তারা উদ্ধার করতে পারেননি। আবার তার পাশাপাশি বলতে হয়, দেশভাগ আসন্ন জেনে উচ্চবিত্তের, উচ্চবর্ণের হিন্দু রা ওপার বাংলা থেকে যেভাবে সম্পত্তি এপার বাংলায় স্থানান্তরিত করেছেন, তাতে ওপার বাংলায় যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, সেই অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়েই কিন্তু পরবর্তীকালে আইয়ুব খান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে উসকে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন ।
আরও পড়ুন-তুমি অনেকেরই প্রেরণা, কার্তিককে হার্দিক
এই যে উচ্চবর্ণের উচ্চবিত্তের হিন্দুরা দেশভাগের অনেককাল আগে থেকে দেশভাগের সম্ভাবনা অনুভব করে সম্পত্তি স্থানান্তর করতে থাকেন, তার কিন্তু বিন্দুমাত্র সুযোগ নিম্নবর্গীয়, নিম্নবিত্তের হিন্দুরা পাননি। ফলে দেশভাগের কারণে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে কিন্তু নিম্নবর্গের হিন্দুরা অনেক বেশি অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই অর্থনৈতিক নির্যাতনকে আড়াল করার লক্ষ্যেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি সামাজিক নির্যাতনের তত্ত্বকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছে। তুলে ধরেছে নারীর সম্ভ্রমহানির নানা ধরনের কল্পিত কাহিনি। দুই একটি দুঃখজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেনি তা নয়। কিন্তু সেই ঘটনাক্রমের জন্য কখনও কোনও অবস্থাতেই কোনও একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করতে পারে যায় না, অথচ হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি সেই দেশভাগের কাল থেকে, সেই কাজই করে আসছে। আর সেই কাজকে আশ্রয় করেই আজও তারা তাদের রাজনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।