তিনক্ষেত্রে তিনকন্যা

কন্যা মানেই অনন্যা। ক্ষেত্র যা-ই হোক না কেন। আজ তাঁরা পুরুষের চেয়ে কোনও অংশে কম নন বরং বেশ কয়েক কদম এগিয়ে। শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, তাঁদের অবদান সমাজকেও করছে উপকৃত। তিনটি ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন এমন তিন নারীর কথা আজকের জাগোবাংলায়। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

শ্রীধন্যা সুরেশ
এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে নাম শ্রীধন্যার। এই মেয়েটি কেরলের পিছিয়ে থাকা আদিবাসী সমাজের নতুন সূর্য। কেরলের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া একটি জেলা ওয়েনাড। সেই জেলার ছোট্টগ্রাম পোজুথুনা। এখানে আদিবাসী কুরিচ্যা উপজাতির বাস। সেই উপজাতির সেই সমাজের মেয়ে শ্রীধন্যা সুরেশ। যাঁর পরিচিতির কারণ, তিনি হলেন আদিবাসী সমাজের প্রথম আইএএস অফিসার। ইউপিএসসি পরীক্ষায় ৪১০ র‍্যাঙ্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে আমলা হতে চলেছেন শ্রীধন্যা। এমন অভাবনীয় সাফল্যে গর্বিত তাঁর পরিবার-সহ গোটা গ্রাম।

আরও পড়ুন-এক নারী দুই হাতে তরবারী

অথচ এহেন শ্রীধন্যার ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল কিছুদিন আগেই। খুব সহজ ছিল না সাফল্যের পথ। লিখিত পরীক্ষায় তো পাশ করেছিলেন, কিন্তু ইন্টারভিউ দিতে যেতে হত দিল্লিতে। দিন-আনা দিন-খাওয়া পরিবার দিল্লি যাবে কীভাবে! যাওয়ার টাকাটা কীভাবে জোগাড় করবেন তা ভেবেই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। কারণ, অর্থের অঙ্কটা খুব কম নয়, প্রায় পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না তাঁরা। এদিকে, শ্রীধন্যার বন্ধুরা তাঁদের প্রিয় বান্ধবীর সাফল্যের খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা জানতে পারেন শ্রীধন্যা যেতে চান কিন্তু যাওয়ার অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। বন্ধুর এত বড় সাফল্যের অংশীদার হবেন না এটা ভাবতেই পারেননি বন্ধুরা। কারণ, শ্রীধন্যা যে তাঁদেরও গর্ব। এমতাবস্থায় বন্ধুরা মিলে ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে তাঁর হাতে তুলে দেন। এরপর দিল্লিতে যান শ্রীধন্যা।

আরও পড়ুন-কৃষ্ণগঞ্জে আজও পূজিত হচ্ছে ডাকাতেকালী

শ্রীধন্যা সুরেশের বাবা দিনমজুরের কাজ করে কোনওমতে সংসার চালিয়ে মানুষ করেছিলেন তিন ছেলেমেয়েকে। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বাজারে তির-ধনুকও বিক্রি করতেন। গ্রামেরই সরকারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন শ্রীধন্যা। এরপরে তিনি সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে জুলজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতক হওয়ার পরে শ্রীধন্যা কোজিকোডের কালিকট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন। পড়াশোনা শেষ করে কেরলে তফসিলি উপজাতি উন্নয়ন বিভাগে কেরানি হিসেবেও বেশ কয়েকদিন কাজ করেছেন শ্রীধন্যা। এ ছাড়াও, তিনি ওয়ানাডের আদিবাসী হস্টেলের ওয়ার্ডেন ছিলেন।

আরও পড়ুন-ভুল শুধরে কেরলের বিরুদ্ধে আজ জয়ের খোঁজে ইস্টবেঙ্গল

স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করার পরে একজন আইএএস অফিসারকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রীধন্যা সুরেশ ইউপিএসসি-র জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন। এই পরীক্ষার প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হলেও হাল না ছেড়ে দিয়ে তিনি আরও পরিশ্রম বাড়িয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান।
ব্যর্থতাকে দূরে সরিয়ে রেখেই শ্রীধন্যা ফের পরীক্ষায় বসেন এবং ২০১৮ সালে তৃতীয়বার প্রচেষ্টায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তিনি দারুণভাবে উত্তীর্ণ হন। ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি ৪১০ নম্বর স্থানে ছিলেন।
বারংবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্রের ভ্রুকুটিকে দূরে সরিয়ে রেখেই শ্রীধন্যা সুরেশ তাঁর লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, কঠোর পরিশ্রম করলেই সাফল্য অর্জন সম্ভব।

আরও পড়ুন-ডানকুনি–বেনারস ও খড়গপুর-মোড়গ্রাম করিডর

ক্লডিয়া গোল্ডিন
তিনি আসলে হতে চেয়েচিলেন একজন গোয়েন্দা। সব জিনিসেরই কারণ এবং তথ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতেন সবসময়। ২০ বছর আগে তিনি একটি লেখা লিখেছিলেন যার বিষয় ছিল ‘ইকোনমিকস ডিটেকটিভ’। সেই সময় থেকে আজ অবধি, তিনি সত্য অনুসন্ধান করে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এভাবেই তিনি তাঁর গবেষণার কাজও করে গিয়েছেন। তিনি হলেন ২০২৩-এর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অধ্যাপিকা ক্লডিয়া গোল্ডিন। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে তিনি তৃতীয় মহিলা। শ্রমবাজারে মহিলাদের অবদান এবং তার বদলে প্রাপ্ত বেতন বা মজুরি নিয়ে গবেষণা করেছেন ক্লডিয়া। এর আগে মোট ৯২ জন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র ২ মহিলা এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ক্লডিয়া গোল্ডিন ১৯৮৯-২০১৭ সাল পর্যন্ত NBER-এর আমেরিকান ইকোনমিক প্রোগ্রামের ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপিকা হিসেবে কাজ করেছেন।

আরও পড়ুন-কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হতে রাজি! প্রিয়াঙ্কের মন্তব্যে চাঞ্চল্য

তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনো করেন এবং ১৯৬৭ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। পরবর্তীতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি পান। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও গোল্ডিন উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া-সহ বেশ কিছু জায়গায় অর্থনীতির লেকচারার এবং অধ্যাপিকা হিসেবে কাজ করেছেন।
নোবেল জেতার কথা জানার পর ক্লডিয়া প্রথমেই স্বামীর সঙ্গে এই সুসংবাদটি শেয়ার করেন। এই বিষয় তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এই প্রাইজ জেতা তাঁর কাছে অত্যন্ত সম্মানের এবং এটি অমূল্য। পুরস্কার জয়ের পর তিনি নিজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।
ইকোনমিক সায়েন্সেস অ্যাওয়ার্ড কমিটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব সভেনসন বলেন,‍‘‘শ্রমবাজারে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারাটা সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণা থেকে আমরা সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারি। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে নারীরা আজ যে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তা ভবিষ্যতে দূর করতে পারব।’’

আরও পড়ুন-পর্ষদ সভাপতি গৌতম পালকে রক্ষাকবচ সুপ্রিম কোর্টের

সম্প্রতি নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ইরানের জেলবন্দি মানবাধিকার কর্মী নার্গেস মোহাম্মদিকে। দেশে ‘নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই’ এবং ‘সকলের জন্য মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রচারের জন্য’ নার্গেসকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করেছে নোবেল কমিটি। এরপরই মহিলাদের শ্রমক্ষেত্রে বিশেষ দিশা দেখানোর জন্য অর্থনীতি বিজ্ঞানে গোল্ডিনের নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি।

আরও পড়ুন-পরিচালক গৌতম হালদারের প্রয়াণে শোক প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

নবা ব্যানার্জি
কলকাতার মেয়ে নবরূপা ব্যানার্জি সংক্ষেপে নবা ব্যানার্জি। এই নামেই তাঁর পরিচিতি। ডেজিগনেশনটাও বেশ বড়সড়। তিনি হলেন মার্কিন বেসড নামী সংস্থা এয়ার বিএনবি যার ফুল ফর্ম ‘এয়ার বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’-এর ট্রাস্ট অ্যান্ড সেফটির প্রোডাক্ট অপারেশন এবং স্ট্র্যাটেজির গ্লোবাল হেড। মার্কিনমুলুকে বঙ্গকন্যা নবার দারুণ সুনাম— বলা ভাল পৃথিবী জুড়েই এখন তাঁর পরিচিত। এয়ার বিএনবি অ্যান্টি পার্টি এআই মাস্টারমাইন্ড তিনিই। পৃথিবীর যে প্রান্তে যেতে চান না কেন যত দামি ডেস্টিনেশনই বাছুন এয়ার বিএনবি আপনার রেস্ত অনুযায়ী স্বপ্নকে সত্যি করতে কমখরচে হোমস্টে বা বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু বেশ কয়েকবছর যাবৎ এই নামী সংস্থার মাধ্যমে অ্যাকোমোডেশন বুক করে অনেকেই তাঁর অসদ্ব্যবহার করেছিলেন। পার্টির নামে সুন্দর প্রপার্টিগুলো হচ্ছিল ধ্বংস। নবা ব্যানার্জি এবং তাঁর টিম বিগত তিনবছরে এই যথেচ্ছাচার বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। নবা হলেন তাঁর পরিবারের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার। এয়ার বিএনবির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে তিনি প্রায় তেরো বছর যুক্ত ছিলেন ওয়ালমার্ট ডট কম-এর সঙ্গে। যেটা ছিল তাঁর প্রথম কেরিয়ার ব্রেক। ২০০৭-এ প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাননি। ওয়ালমার্টে থাকাকালীন নবা তাঁর অধ্যবসায়, কর্মনিষ্ঠা, কাজের প্রতি তীব্র প্যাশনের কারণে সার্বিক সাফল্য পেয়েছিলেন। এয়ার বিনবি-তে আসার পরেও সেই সাফল্য অব্যাহত রেখেছেন। শুধু সফল টিম লিডার নন তিনি একজন সফল মা। পাঁচটি সন্তানের জননী নবা বর্তমানে থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোস-এ।

Latest article