পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম
শ্রীমদ্ভগবত গীতায় বলা হয়েছে— ‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমং তপঃ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা।’ অর্থাৎ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। এই জগৎসংসারে বংশপরম্পরায় পিতা এবং পুত্রের সম্পর্কটি যেন স্নেহের এক অদৃশ্য বন্ধনহীনগ্রন্থি। একজন পিতা সারা জীবন বটগাছের মতো সন্তানকে স্নেহ-ভালবাসার ছায়া দান করেন। পারিবারিক ঐতিহ্য উত্তরসূরিদের কাঁধে তুলে দেওয়া পিতার দায়িত্ব এবং সেটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া পুত্রের কর্তব্য এবং গৌরবও বটে। যেমন, শ্রীরামচন্দ্র পিতার নাম অনুসারে ‘দাশরথি’ নামেও পরিচিত হন। পিতার নাম অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের আর এক নাম হল ‘বাসুদেব’। একইভাবে হনুমান হলেন ‘পবনপুত্র’ এবং কর্ণ হলেন ‘সুতপুত্র’। সংসারের এই অমোঘ সত্যটি গোলাম মুস্তাফা তাঁর ‘কিশোর’ কবিতায় যথাযথভাবে লিখেছেন— ‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’
আরও পড়ুন-মৃণাল সেন ১০০
বহু আলোচিত এই সম্পর্কটি নিয়ে তর্কের অবকাশ থেকেই যায়। পিতার পরিচয়ে পুত্রের পরিচিতি নাকি পুত্রের পরিচয়ে পিতার পরিচিতি? কারণ পৃথিবীর ইতিহাস অনুসন্ধান করলে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে পিতার কৃতিত্বকে পুত্র ছাপিয়ে গেছে। আবার কখনও পিতার যশ-খ্যাতির ছায়ায় পুত্র হারিয়ে গেছে প্রদীপের নিচের অন্ধকারে। অবশ্য, সন্তানদের মধ্যে সকলেই যে সমানভাবে বিখ্যাত হয় এমনটিও নয়। জন্মস্থান, জন্ম-কুল বিষয়গুলি অনেক সময় জীবনে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ উভয়রূপেই নেমে আসতে পারে। অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে সুযোগ এবং সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যায় একথা বলাই বাহুল্য। পাঁকেও পদ্ম ফোটে এমন উদাহরণ বিরল নয়। বাংলায় বহুপঠিত প্রবাদ রয়েছে— ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভাল।’ জন্মপরিচয় অথবা কর্মজীবন যাই হোক, ‘জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি, বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই’ এই জীবনধর্ম যেন পিতা এবং পুত্রকে পারস্পরিক শ্রদ্ধায় বেঁধে রাখতে পারে এমনটাই কাম্য।
আজকের আলোচনায় আমরা বাংলা সাহিত্যের দুটি পরিবারের চারজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের উপর আলোকপাত করব। উত্তর কলকাতার ১০০ নম্বর গড়পার রোডে ‘রায়’ পরিবারের পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং পুত্র সুকুমার রায়। অপরদিকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে ‘ঠাকুর’ পরিবারের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও পড়ুন-নববর্ষের সংকল্প
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা
সব শিশুরই অন্তরে
বংশপরম্পরায় রায় পরিবারে প্রতিভার ছড়াছড়ি। এঁদের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। মেধাবী ছাত্র হলেও শিল্পীত অকাজের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বেশি। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি আঁকা, প্রকাশনা, জ্যোতির্বিদ্যা, বেহালা বাজানো ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ছিলেন পারদর্শী। তাঁর আসল নাম কামদারঞ্জন রায় হলেও পারিবারিক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নিলে নাম পাল্টে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রাখা হয়। উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১৮৬৩ সালে ১২ মে, বাংলার নবজাগরণের মধ্যগগনে। উপেন্দ্রকিশোরের থেকে রবীন্দ্রনাথ মাত্র দু’বছরের বড় হলেও দু’জনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সেই সূত্রেই পারিবারিক যাতায়াত ছিল অবাধ। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন মাসিক পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হত নিয়মিত। সাহিত্য-সংস্কৃতির তৎকালীন জোয়ারে যখন বড়দের জন্য ভারী ভারী গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখতে সবাই ব্যস্ত, উপেন্দ্রকিশোর রচনা করলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের নতুন অধ্যায়। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘টুনটুনির বই’, ‘ছোটদের রামায়ণ ও মহাভারত’, ‘পান্তাবুড়ির কথা’ ইত্যাদি তাঁর অমর সৃষ্টি। ছাপার গুণমান নিয়ে খুঁতখুঁতে উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে মুদ্রণযন্ত্র আমদানি করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মেসার্স ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামের নিজস্ব ছাপাখানা। ‘হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং’ নিয়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ছোটদের জন্য বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর নিজেই। এ-কথা বললে অত্যুক্তি হয় না, যে, সাহিত্যের ধারাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল হল শিশুসাহিত্য। শিশুদের মনস্তত্ত্ব জটিল এবং বহুমুখী। সেখানে আছে রূপকথা, কল্পনা, ম্যাজিক, অ্যাডভেঞ্চার, ভূত-প্রেত ইত্যাদি নানান বৈচিত্রের পরিসর। চিরাচরিত সাহিত্যে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে এসে অনেক দায়িত্বের সঙ্গে এই ধরনের সাহিত্য রচনা করতে হয়। সহজ-সরল ভাষা, মজাদার কাহিনি, ছবিতে রঙের ব্যবহার এবং সর্বোপরি লিঙ্গ-বৈষম্য বিষয়ে ভীষণ সতর্কতা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন-৪ রাজ্যে উপনির্বাচনে ধরাশায়ী হল বিজেপি
অন্যদিকে, পিতা হিসেবে উপেন্দ্রকিশোর দায়িত্বশীল এবং সতর্ক ছিলেন পারিবারিক জীবনেও। সুকুমার-সহ ছয় ছেলেমেয়ে এমনকী ভাইঝি লীলা মজুমদার পর্যন্ত এই পারিবারিক শিশুসাহিত্যের পরিমণ্ডল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিশুসাহিত্যে অবদান রাখেন। জ্যেষ্ঠপুত্র সুকুমারকে তিনি গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ নিয়ে ‘প্রিন্টিং অ্যান্ড ফটোগ্রাফি’ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে পাঠান। কিন্তু সুকুমার বিদেশ থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ১৯১৫ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর মারা যান। অল্প বয়সে পিতার স্নেহচ্ছায়া হারিয়ে সুকুমার পারিবারিক ঐতিহ্য কাঁধে তুলে নেন। তিনিও দীর্ঘজীবী হননি। ১৯২৩ সালে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সুকুমার রায় পরলোক গমন করেন। তখন শিশুপুত্র সত্যজিৎ-এর বয়স মাত্র ২ বছর। সত্যজিৎ পরবর্তীকাল ঠাকুরদার গল্প নিয়ে সিনেমা বানিয়ে জগদ্বিখ্যাত হন।
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের সম্মানে আপ্লুত সলমন
সুকুমার রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোরের বিশ্বরূপ। বাবা হিসেবে উপেন্দ্রকিশোর সন্তানের সফল উড়ানের জন্য ‘জাহাজের পাটাতন’ প্রস্তুত করেই রেখেছিলেন। কর্ম এবং সাহিত্যজীবনে বিলেতি যাপনের প্রভাব এবং বিশ্বখ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয়, সুকুমারকে ক্ষুরধার করে তোলে। স্বল্পস্থায়ী জীবনে প্রতিভার এমন অনন্য বিস্ফোরণ বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে পাওয়া দুষ্কর। বাবার দেখানো পথে সুকুমারের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ল ছড়ায়, রম্যরচনায়, প্রবন্ধে, নাটকে, ছাপাখানায় এবং ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনায়। তিনি হলেন প্রথম বাঙালি এবং ভারতীয় শিশুসাহিত্যিক যিনি ‘ননসেন্স ছড়া’ প্রবর্তন করেন। এ-ছাড়াও ভারতের একজন অগ্রগামী আলোকচিত্র শিল্পী এবং লিথোগ্রাফার হিসেবে তিনি বিখ্যাত হন। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির অন্যতম হল— ‘আবোল তাবোল’, ‘হ য ব র ল’, ‘পাগলা দাশু’, ‘খাই খাই’, ‘অবাক জলপান’, ‘শব্দ কল্পদ্রুম’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘বহুরূপী’ ইত্যাদি। দুঃখের বিষয় এই বইগুলোর একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হলেও ‘আবোল তাবোল’ ছড়া সঙ্কলনটি তাঁকে সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলে। সঙ্কলনটির প্রতিটি ছড়ায় মিছরির ছুরির মতো লুকিয়ে আছে তৎকালীন বাবুসমাজকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুরধার ব্যঙ্গ এবং গান্ধীজির অহিংস সত্যাগ্রহ নীতির সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিরোধিতা।
আরও পড়ুন-বিষ্ণোইয়ের হুমকি, সলমনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত মুখ্যমন্ত্রী
অন্যদিকে ‘হ য ব র ল’ রচনাটির শিল্পসৌন্দর্য এবং তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে অনেকেই একে ‘এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুকুমার-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তার সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তার ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তার স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল সেই জন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলার ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরও কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তার প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীয় রচনা দেখা যায় না।’ বাবা উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে ব্রাহ্মসমাজের নানান সংস্কারপন্থী কাজকর্মে সুকুমার রবীন্দ্রনাথের সরাসরি সমর্থন পেয়েছিলেন। বিলেতের ‘East and West Society’তে ‘Spirit of Rabindranath’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন সুকুমার, যেটি পরবর্তীকালে ‘The Quest’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া সুকুমার, মুখে-মুখে ছড়া-রচনা-করা সুকুমার এইভাবে একদিন উপস্থিত হলেন বিশ্বের দরবারে। ‘ননসেন্স ছড়া’ প্রসঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পুত্রের কৃতিত্বের এমন তুলনা উপেন্দ্রকিশোরকে অনেকাংশে ‘সুকুমার রায়ের বাবা’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
আরও পড়ুন-সানরাইজার্সকে হারিয়ে তিনে সুপার জায়ান্টস
আজি শুভ দিনে পিতার ভবনে
বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঠাকুর পরিবারের অবদান সর্বজনবিদিত। ঠাকুরবাড়ির খ্যাতিমানদের হাত ধরেই বাংলার নবজাগরণ ত্বরান্বিত হয়েছে। ১৮১৭ সালে ১৫ মে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। স্কুলজীবন থেকেই তিনি রামমোহনের সংস্কার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। এরপর তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হয়ে আধ্যাত্মিক জীবনসাধনা শুরু করেন। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, বাবার বিষয়-সম্পত্তি-ব্যবসা দেখাশোনার কাজে কাঁচাবয়সের ক্ষণিক মোহে বিলাসী হয়ে উঠলেও পিতামহীর মৃত্যুশোক তাঁকে মানসিকভাবে আমূল বদলে দেয়। ঈশ্বরলাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ধর্মচর্চায় আগ্রহী হয়ে মহাভারত, উপনিষদ, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দর্শন ইত্যাদি নানান বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। দেবেন্দ্রনাথের লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল— ‘ব্রাহ্মধর্ম’, ‘আত্মতত্ত্ববিদ্যা’, ‘পরলোক ও মুক্তি’ ইত্যাদি। তিনি একে একে তত্ত্ববোধিনী সভা, ব্রাহ্মবিদ্যালয়, বেথুন সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, বিধবাবিবাহ প্রচলন ইত্যাদি সমাজসংস্কারমূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এসব কিছুর মধ্যেও শিলাইদহ, পতিসরের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
আরও পড়ুন-জিতে প্লে-অফের দৌড়ে রইল পাঞ্জাব
হিমালয়ের পথে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বছরের পর বছর। কিন্তু দ্বারকানাথের অকস্মাৎ মৃত্যুতে ঠাকুর পরিবারে নেমে আসে মহা আর্থিক বিপর্যয়। ১৮৬৩ সালে কলকাতার অদূরে বীরভূমের ভুবনডাঙায় দেবেন্দ্রনাথ কুড়ি একর জমি কিনে ব্রহ্মচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এরপর ১৮৬৭ সালে তিনি ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। দেবেন্দ্রনাথের এই ব্রাহ্মজীবনের সঙ্গে সুস্থ গৃহস্থ জীবনের কখনও কোনও বিভেদ ঘটেনি। সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যজীবন ছিল অত্যন্ত সুখের। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তাঁর চোদ্দোটি সন্তানের জন্ম হয়। আত্মজীবনীতে দেবেন্দ্রনাথ লিখলেন— ‘‘শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষাতেই গঙ্গাতে বেড়াইতে বাহির হইলাম। আমার ধর্মপত্নী সারদা দেবী কাঁদিতে কাঁদিতে আমার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন ‘আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইবে? যদি যাইতেই হয় তবে আমাকে সঙ্গে করিয়া লও।’ আমি তাহাকে সঙ্গে লইলাম। তাহার জন্য একটি পিনিশ ভাড়া করিলাম। তিনি সন্তানদের লইয়া তাহাতে উঠিলেন। আমি উঠিলাম একটি সুপ্রশস্ত বোটে। তখন দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স ৭ বৎসর, সত্যেন্দ্রনাথের ৫ বৎসর, এবং হেমেন্দ্রনাথের ৩ বৎসর।” সাংসারিক পিতার স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কর্তব্যের নিদর্শন এর বেশি আর কী বা হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র। জীবনস্মৃতিতে পিতৃদেব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘‘বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়। মাঝে মাঝে তিনি কখনও হঠাৎ বাড়ি আসিতেন।… অল্প কয়েক দিনের জন্য যখন কলিকাতায় আসিতেন তখন তাহার প্রভাবে যেন সমস্ত বাড়ি ভরিয়া উঠিয়া গম গম করিতে থাকিত।… সকলেই সাবধান হইয়া চলিতেন।… উঁকি মারিতে আমাদের সাহস হয় না।” শিশুপুত্র রবীন্দ্রনাথের মনে পিতা দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও সম্মোহনের আভাস ছড়িয়ে পড়ল যেন। আমৃত্যু পিতার প্রতিটি আদেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
আরও পড়ুন-জয়ে ফিরতে বিরাটদের সামনে এখন চাহাল-কাঁটা
অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ যেন অসীমের চিরবিস্ময়। ১৮৬১ সালে ৭ মে সারদা দেবীর কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই কঠোর অনুশাসনে বড় হয়েছেন। খুব ছোট বয়সে এই আশ্চর্য বালকের মধ্যে কাব্যস্ফূরণ অনুভব করেছিলেন সকলে। ধীরে ধীরে বাপ-ঠাকুরদার প্রতিভা এবং খ্যাতি ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে গেলেন পৃথিবীর প্রান্তে-উপান্তে, আপামর বাংলার ঘরে ঘরে। বাবার উৎসাহে বাড়ির সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশ রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চার নতুন দিগন্ত খুলে দিল। বহুমুখী প্রতিভায় তিনি হয়ে উঠলেন কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, অভিনেতা, শিক্ষক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে পিতার দেখানো পথেই রবীন্দ্রনাথ নেমে পড়লেন সমাজসংস্কার এবং নানান দেশহিতকর কাজে। গ্রামোন্নয়ন, পরিবেশ চেতনা, শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মীয় ভেদাভেদ, ঔপনিবেশিকতা, স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর কলমে গঠনমূলক আলোচনা এবং প্রতিবাদ ঝরে পড়ল।
আরও পড়ুন-সানরাইজার্সকে হারিয়ে তিনে সুপার জায়ান্টস
এরই মধ্যে ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ভূষিত হলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে। পিতার স্বপ্নের শান্তিনিকেতনকে তিনি সাজিয়ে তুললেন নবরূপে। ১৯২১ সালে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় আদর্শে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। লিখলেন অজস্র গান, ভারত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথ পিতাকে অনুসরণ করেই বারবার বেরিয়ে পড়েছেন বিশ্বভ্রমণে। পৃথিবীর নানান দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন রাশিয়ার চিঠি, জাপান যাত্রী, ইউরোপ যাত্রীর ডায়েরি ইত্যাদি গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের এই সুমহান কর্মযজ্ঞ, অকল্পনীয় সাহিত্য প্রতিভা, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁকে অতিমানবীয় চেতনায় ঘিরে রেখেছে আজও। সুতরাং মানুষের কাছে দেবেন্দ্রনাথ চিরকাল ‘রবীন্দ্রনাথের বাবা’ হিসেবেই বেঁচে রইলেন। পুত্র হিসাবে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র পিতা দেবেন্দ্রনাথকে বা উত্তরসূরি রথীন্দ্রনাথকে ছায়াচ্ছন্ন করেননি, সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের পিছিয়ে দেননি, মহাকাশ ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন সমস্ত মানুষের জীবনের ধ্রুবতারা।