বিবেকানন্দ ডাকছেন

ই ক্রান্তিকালে আজ ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ডাঃ দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত

Must read

নিবেদিতা বলতেন, ভারতবর্ষ ছিল তাঁর আবেগের জায়গা। তাঁর মধ্যাহ্নের দিবাস্বপ্ন রাতের দুঃস্বপ্ন। ভারতের অধ্যাত্মচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়তি, আজ এবং আগামী, সবকিছুর মূর্তস্বরূপ তিনি, তিনিই। তিনি মনে করতেন, বেদান্ত-মহাসাগরে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, পারসি সব এক—সকলেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সন্তান। এহেন বিবেকানন্দকে ঘুলিয়ে ভুলিয়ে অন্যরকম করে দেখানোর খেলায় মেতেছে কেউ কেউ। এই ক্রান্তিকালে আজ ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ডাঃ দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত

আরও পড়ুন-মেজাজ হারিয়ে সাংবাদিকের মাস্ক খুলে নিলেন উত্তরপ্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী!

১৮৯২ সালের শেষ সপ্তাহ। এমনই এক শীতকাল। কন্যাকুমারী পৌঁছে তরুণ পরিব্রাজক বিবেকানন্দের ইচ্ছে হল, সমুদ্রের মধ্যে শেষ যে শিলাখণ্ডটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তার ওপর বসে ধ্যানমগ্ন হবেন। দ্বিধামাত্র না করে তিনি ঝাঁপ দিলেন উত্তাল সমুদ্রে। আছড়ে পড়া বিশাল বিশাল ঢেউ সাঁতরে উঠলেন সেই পাথরের ওপর। তারপর পেছন ফিরে দেখলেন সমগ্র ভারতভূখণ্ডকে। দুই বাহু প্রসারিত করে যেন আলিঙ্গন করতে চাইলেন তাঁর দেশকে। এই তাঁর শিশুশয্যা, যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী। তাঁর ভাষায় ভারতবাসী তাঁর প্রাণ, ভারতের দেবদেবী তাঁর ঈশ্বর, ভারতের মৃত্তিকা তাঁর স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ তাঁর কল্যাণ।

আরও পড়ুন-গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে চুরি গেল করোনার টিকা

বিবেকানন্দের এই তীব্র দেশপ্রেম বা ভারতচেতনার উৎস সন্ধান করলে তিনটি পর্যায় খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম পর্বে তাঁর পরিবারের সংস্কারমুক্ত পরিবেশ। দ্বিতীয় পর্বে ‘জীবরূপে শিব সেবা’ ধারণার উদ্গাতা শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য। আর তৃতীয় পর্বে বিস্তৃত ভারত পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা। যোগাযোগ ব্যবস্থার সেই অনুন্নত কালে আক্ষরিক অর্থেই তিনি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পরিব্রজন করেছেন : ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির স্বদেশবাসীর সঙ্গে বিবেকানন্দের নিবিড় আলাপ কার্যত তাঁর ভারত-আবিষ্কার।

তবে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ হল পাশ্চাত্যে গিয়ে। তিনি দেখলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগে সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; আর সেই সূত্রেই এসেছে শ্রমিক ও নারীর সামাজিক মর্যাদা ও স্বাধীনতা। পাশ্চাত্যকে যত দেখেছেন ততই সেখানে সাধারণ মানুষের, বিশেষত নারী-স্বাধীনতার বহুস্তর বিচ্ছুরণ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। আর আফশোস করেছেন এই বিষয়ে ভারতবর্ষের বহু যোজন পিছিয়ে থাকা প্রসঙ্গে। নিউ ইয়র্ক থেকে মাদ্রাজি অনুরাগীদের লিখেছিলেন, “স্বাধীনতাই উন্নতির প্রথম শর্ত, যেমন মানুষের চিন্তা করিবার ও কথা বলিবার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক, তেমনই তাহার আহার পোশাক বিবাহ ও অন্যান্য সকল বিষয়েই স্বাধীনতা প্রয়োজন—তবে এই স্বাধীনতা যেন অপর কাহারও অনিষ্ট না করে।”

আরও পড়ুন-দিল্লিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম এবার ১০০%

প্রায় চার বছর পশ্চিমে কাটিয়ে ভারতে ফিরে আসার আগে তাহলে কি স্বদেশ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা কিছুটা টলে গেল? এক ইংরেজের এমন ইঙ্গিতের উত্তরে বিবেকানন্দ সগর্বে বললেন, আগে ভারতবর্ষকে ভালবাসতাম, এখন ভারতবর্ষের প্রতিটি ধূলিকণা আমার কাছে পবিত্র। সম্পূর্ণতা পেল তাঁর ভারতচেতনা।

বিবেকানন্দই প্রথম ‘দিবে আর নিবে’-সুলভ বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে পশ্চিমের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন, পাশ্চাত্যের কাছে ভারতের প্রয়োজন ক্ষুধার অন্নের, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিক্ষার। কিন্তু দীনভাবে তাকে এই দান গ্রহণ করতে হবে না। কারণ তার দেওয়ার আছে অনেক কিছু—সহস্রাধিক বৎসরব্যাপী সভ্যতার এক ঘনীভূত সম্পদ। তিনি দাবি করেন, “আমাদের মাতৃভূমির প্রতি জগতের ঋণ অপরিসীম।” সে ঋণ হল ভারতবর্ষের বেদান্তদর্শন। পৃথিবীর সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে ধর্মের দোহাই দিয়ে সময়ে সময়ে যে সংকটকাল উপস্থিত হয় তার মূলে রয়েছে ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত বোধের অভাব, তাকে প্রয়োগের অপারগতা। বিবেকানন্দ বললেন, এই অসুখের নিরাময় নিহিত রয়েছে ভারতীয় বেদান্ত-দর্শনে, সর্ব-অবগাহী বেদান্তধর্মে : “বেদান্ত-মহাসাগরে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, পারসি সব এক—সকলেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সন্তান।” চিকাগো ধর্মমহাসভার আবির্ভাব বক্তৃতাতেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন : যে ধর্ম বিশ্বকে সহিষ্ণুতা আর সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার শিক্ষা দিয়েছে সেই ধর্মমতাবলম্বী হিসেবে আমি গর্ব বোধ করি। আমরা শুধু সর্বজনীন সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী নয়, আমরা স্বীকার করি যে সকল ধর্মই সত্য।

আরও পড়ুন-ওমিক্রনের চেয়েও অনেক বেশি সংক্রামক করোনার এক উপ-প্রজাতির হদিশ মিলল

সমন্বয়ের এই গভীর বোধকে বিবেকানন্দ ছড়িয়ে দিতে চাইলেন সমাজের যাবতীয় অসাম্যের চিকিৎসায়। দীর্ঘকালের অচর্চিত এই ভারতীয় দর্শনকে তিনি ফলিতরূপে প্রয়োগ করলেন। বনের বেদান্তকে নিয়ে এলেন মনের নৈকট্যে। আধুনিক পৃথিবী এই প্রথম ভারতবর্ষের দিকে তাকাল শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে, শিক্ষানবিশের বিনয়ে।

আর ভারতীয় সমাজের কোন কোন দোষের কথা তিনি বিশেষভাবে সংশোধন করতে বলেছেন? তিনি চেয়েছেন এমন সামাজিক সমানাধিকার যেখানে “কোনও পুরুষ নারীর ওপর হুকুম চালাবে না, নারীও পুরুষের ওপর হুকুম চালাবে না।” সার্বিক শিক্ষার লক্ষ্যে তাঁর নিদান, “দরিদ্র লোকেরা যদি শিক্ষার নিকট পৌঁছিতে না পারে, তবে শিক্ষাকেই চাষীর লাঙ্গলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যান্য সব স্থানে যাইতে হইবে।” বলেছেন, “মেয়েদের আগে তুলতে হবে, মাস্কে জাগাতে হবে, তবেই জগতের কল্যাণ, ভারতের কল্যাণ।” ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখতে তাঁর পরামর্শ, “বেদ, কোরান, পুরাণ, পুঁথি-পাতড়া এখন কিছুদিন শান্তিলাভ করুক—প্রত্যক্ষ ভগবান দয়া-প্রেমের পুজো দেশে হোক।” অহিন্দু জনসাধারণ সম্পর্কে তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই; ভুলে না যাই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এবং ইসলামিক দেহ সমন্বিত তাঁর আধুনিক ভারতের স্বপ্নের কথা।

আরও পড়ুন-টেস্ট জেতো, জন্মদিনে দ্রাবিড়কে শচীন

সেই তাঁআরও পড়ুন-র স্বপ্নের ভারতবর্ষ, যে ভারত বেরুবে লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে থেকে। যে “ভারত আবার উঠবে। কিন্তু জড়ত্বের শক্তিতে নয়, চৈতন্যের শক্তিতে। বিনাশের বিজয় পতাকা নিয়ে নয়, শান্তি ও প্রেমের পতাকা নিয়ে।”

Latest article