শতবর্ষ পেরিয়েছেন বছর দুই আগে। আজও বাঙালির সাহিত্য-আলোচনায় উঠে আসে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অন্যধারার সাহিত্যিক। অবলীলায় ভেঙেছেন চেনা ছক। তাঁর লেখা পড়ে একসময় বহু তরুণ-তরুণী চিনেছে প্রেম। তুমুল প্রেম। তবে সেই অর্থে শরীরী নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক। তিনি প্রেমকে দিয়েছিলেন এক নতুন সংজ্ঞা। বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করেছিলেন স্বতন্ত্র ধারা। যে ধারাজলে স্নান করেছেন সাধারণ পাঠক-পাঠিকা থেকে শুরু করে অসংখ্য বোদ্ধা, লেখক, সমালোচক। তাঁর সৃষ্টির সমাদর করেছেন প্রত্যেকেই।
সময় পেরিয়েছে। বদলেছে মানুষের রুচি। তবু আজও প্রকৃত পাঠক পরম যত্নে বুকে আগলে রাখেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বই। এইভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন কালোত্তীর্ণ।
আরও পড়ুন-নির্বাচিত শতাব্দীর মুখ
জানা যায়, জীবনের শুরুতে তিনি ঝাঁপিয়েছিলেন ছবি তৈরির কাজে। সফল হননি। তারপর শুরু করেন ব্যবসা। প্রথমে গেঞ্জি তৈরি, পরে প্রকাশনা। তারপর যোগ দেন সংবাদপত্রে। দু’হাতে লিখতে শুরু করেন। নানা স্বাদের লেখা। বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তাঁর আটপৌরে প্রেমকাহিনি। সেইসব প্রেমকাহিনির চরিত্রদের খুব চেনা লাগে। যেন পাশের বাড়ির কেউ। যাদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। বহু আগের লেখা। তবু যেন বড়বেশি আজকের। এইভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন পাঠকের আপনার জন।
গভীর প্রেমের পাশাপাশি তাঁর রচনায় পাওয়া যেত তুমুল চলচ্চিত্র-উপাদান। যেটা নজরে এসেছিল সেই সময়ের বিশিষ্ট পরিচালকদের। শুধু বাংলার নয়, হিন্দিরও।
তাঁর ‘নার্স মিত্র’ গল্পটি প্রকাশ পাওয়া মাত্র দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। একজন নার্সের জীবনের প্রেম এবং প্রেমহীনতার গল্প। ১৯৫৯ সালে সেই গল্প নিয়ে বাংলা ছবি ‘দীপ জ্বেলে যাই’ তৈরি করেছিলেন অসিত সেন। অভিনয়ে সুচিত্রা সেন, বসন্ত চৌধুরি, অনিল চট্টোপাধ্যায়। দারুণ সাফল্য পেয়েছিল ছবিটি। একই গল্প নিয়ে প্রায় দশ বছর পর অসিত সেন হিন্দিতে তৈরি করেছিলেন ‘খামোশি’। অভিনয়ে ওয়াহিদা রেহমান, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র। আবার সাফল্য। দুটি ছবিতেই অসাধারণ সুর করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, এই গল্প নিয়ে ছবি তৈরি হয়েছিল তেলুগু ভাষাতেও। ১৯৬০ সালে।
আরও পড়ুন-বেরিয়ে এলেন বুদ্ধদেব
তাঁর ‘চলাচল’ গল্প নিয়ে হিন্দিতে তৈরি হয়েছিল ‘সফর’। পরিচালক সেই অসিত সেন। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিতে অভিনয় করেছিলেন
রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর, ফিরোজ খান। এও এক অন্য প্রেমের গল্প। যেখানে চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে রয়েছে সৌজন্যমূলক ফাঁক।
এইভাবে একে একে তাঁর গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘জীবন তৃষ্ণা’, সুচিত্রা-সৌমিত্র অভিনীত ‘সাত পাকে বাঁধা’, বিজয় আনন্দ-জয়া বচ্চন অভিনীত ‘কোরা কাগজ’, অরুন্ধতী দেবী অভিনীত ‘চলাচল’ এবং ‘পঞ্চতপা’, উত্তমকুমার অভিনীত ‘আমি সে ও সখা’, এবং ‘কাল তুমি আলেয়া’, অমিতাভ বচ্চন-রাখি অভিনীত ‘বেমিশাল’, চিরঞ্জিত-মুনমুন অভিনীত ‘অমরকণ্টক’ প্রভৃতি ছবি। প্রত্যেকটি ছবিই সাফল্য পেয়েছে।
শুধু গল্প নয়, প্রয়োজনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ছবির চিত্রনাট্য। কখনও করেছেন চিত্রনাট্যের সংশোধন ও পরিমার্জন।
তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল উত্তমকুমার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। দু’জনের সঙ্গে করেছেন বেশ কয়েকটি কাজ। ডাক পেয়েছিলেন মুম্বই থেকেও। চলচ্চিত্র নির্মাতা শশধর মুখোপাধ্যায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে যাননি। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, চিত্রনাট্য নয়, আমি লিখতে চাই গল্প-উপন্যাস।
আরও পড়ুন-গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অলরাউন্ডার
তাঁর লেখা ‘পঞ্চতপা’, ‘অন্য নাম জীবন’, ‘অপরিচিতের মুখ’, ‘আনন্দরূপ’, ‘আবার আমি আসবো’, ‘আরো একজন’, ‘চলাচল’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘আশ্রয়’, ‘একটি বিশ্বাসের জন্ম’, ‘একাল ওকাল’, ‘খনির নূতন মণি’, ‘দিনকাল’, ‘দুটি প্রতীক্ষার কারণে’, ‘নগর পারে রূপনগর’, ‘নিষিদ্ধ বই’, ‘পিন্ডিদার গপ্পো’, ‘পিন্ডিদার পঞ্চবাণ’, ‘রিটায়ারমেন্ট’, ‘পুরুষোত্তম’, ‘বলাকার মন’, ‘মেঘের মিনার’, ‘রূপের হাটে বিকিকিনি’, ‘লিডার বটে পিন্ডিদা’, ‘শত রূপে দেখা’, ‘সোনার হরিণ নেই’, ‘পরকপালে রাজা রানী’, ‘সজনীর রাত পোহালো’, ‘সবুজতরণ ছাড়িয়ে’ প্রভৃতি বইগুলোর আজও বিন্দুমাত্র কদর কমেনি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র পিন্ডিদাকে বাঙালি পাঠক বহুদিন আগেই আপন করে নিয়েছে।
বিশেষ স্নেহ পেয়েছিলেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘পঞ্চতপা’। দুশোর মতো বই। বেশিরভাগ গল্প-উপন্যাস। লিখেছেন ছোটদের জন্যও। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। এইভাবেই তিনি মুদ্রিত বই এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলেন সারা দেশে।
আরও পড়ুন-চিকেন-ফুচকার অভিনব স্বাদ পাবেন ফুচকা গ্রামে
১৯৮৯ সালের ৪ মে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অনন্তে বিলীন হয়ে যান। কিছুদিন আগেই পেরিয়েছে সেই দিনটি। তবে অসংখ্য পাঠক-পাঠিকার মনে আজও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।