এত রাগ কেন?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে লগ্নি-গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট নিয়ে সরব হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ধনকুবের শিল্পপতি জর্জ সোরস। ব্যস! অমনি তা নিয়ে হইচই বাধিয়ে ফেললেন ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির মন্ত্রী-সান্ত্রি সবাই। অসহিষ্ণুতার এমন আচমকা প্রকাশ, অহেতুক উদ্‌যাপন কেন? বোঝার চেষ্টা করলেন অনির্বাণ সাহা

Must read

মিউনিখের সিকিউরিটি কনফারেন্সে জর্জ সোরস নরেন্দ্র মোদি আর গৌতম আদানির তথাকথিত ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে দু-চারটি কথা বলেছিলেন। আর তাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরে। দু-মিনিটের একটা মন্তব্য আর তাতেই এত হল্লাবাজি! কেন?
১৯৯২-তেই সোরসের নামটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম আমরা। তিনি ব্রিটিশ পাউন্ডের বিরুদ্ধে বাজি ফেলেছিলেন। আর তাতেই তাঁর সিন্দুকে এক বিলিয়ন পাউন্ড ঢোকে। এই ঘটনা যখন ঘটে তখনই ব্রিটিশ অর্থনীতি ‘ব্ল্যাক ওয়েনেসডে’ বা ‘কালা বুধবার’-এর কবলে পড়ে। সেই বিপর্যয় থেকে ব্রিটিশ অর্থনীতি আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি।

আরও পড়ুন-মন জয়ের চেষ্টা কেন্দ্রর, সড়কে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ

সোরস ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন-এর মাধ্যমে সারা বিশ্বজুড়ে সমাজকল্যাণমূলক কর্ম চালান। নাগরিক সংগঠন, শিক্ষা-উদ্যোগ এবং গণস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থাকে ফি-বছর সোরসের ফাউন্ডেশন মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোটি কোটি ডলার দিয়ে সাহায্য করে। ১০০টি দেশের এরকম সংস্থা সোরসের পক্ষ থেকে এই সাহায্য পায়।
এতদ্‌সত্ত্বেও সোরস একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ডেমোক্রেটিভ পার্টিকে অর্থ সাহায্যে কার্পণ্য করেন না। শৈশবে হিটলারের নাৎসি স্বৈরতন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। ফলত, স্বৈরতন্ত্র তাঁর সদা না-পসন্দ বিষয়। চরম দক্ষিণপন্থীরা তাঁকে সহ্য করতে পারেন না। তথাপি সোরস সমগ্র বিশ্বে অর্থ, রাজনীতি ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জগতে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রূপে স্বীকৃত।
এহেন সোরস, এবারেই প্রথম নয়, এর আগেও মোদিজির সমালোচনা করেছিলেন। মোদি সরকার যখন ৩৭০ ধারা বাতিল করে, তখন সেই পদক্ষেপেরও সমালোচনা করেছিলেন সোরস। ২০২০-র জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, মোদির হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর তাগিদ ভারতের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
সোরস মোদির কোনও কোনও পদক্ষেপের সমর্থকও। ডিজিটাল ইন্ডিয়া নির্মাণ প্রকল্প কিংবা স্বচ্ছ ভারত অভিযান সোরস কতৃর্ক প্রশংসিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সামনেই প্রাক্তনীদের ঢুকতে বাধা, উপাচার্য বিরোধী পোস্টার

সেই সোরস মহোদয় মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে বিশ্ব নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার মঞ্চে বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতাদের উপস্থিতিতে মোদিজির সমালোচনা করে বসেছেন। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতোই একটা মর্যাদাপূর্ণ মঞ্চ। তফাত একটাই, ইকোনমিক ফোরামে রেস্তর জোরে অংশ নেওয়া যায় কিন্তু সিকিউরিটি কনফারেন্স পুরোপুরি আমন্ত্রণমূলক। এবারের কনফারেন্সে ৭০০-র বেশি প্রথম সারির নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঋষি সুনক (ইউকে), মাকঁড় (ফ্রান্স), কমলা হ্যারিস (আমেরিকা), ওলাফ স্কোলজ (জার্মানি)। গত বছর এই কনফারেন্সে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর উপস্থিত থাকলেও এ বছর এই মঞ্চে ভারত থেকে কেউ আমন্ত্রণ পাননি।
সোরস উপস্থিত ছিলেন, তবে মূল মঞ্চে নয়, সাইডলাইনে। সোরস নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। বিষয়সূচিতে ছিল জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তুরস্কে বিপর্যয়, চিনের ব্যর্থতা, মার্কিন রাজনীতি-সহ নানা জিনিস। এরই মধ্যে মাত্র দু’মিনিট তিনি ভারত, মোদি ও আদানির বিষয়ে বলেছেন। আর তাতেই ‘গেল গেল’ রব।

আরও পড়ুন-আদানি ইস্যু: মিডিয়ার ‘মুখ’ বন্ধ করা যাবে না, জানাল সুপ্রিম কোর্ট

সোরস বলেছেন, ভারতের ব্যাপারটা বেশ আগ্রহ উদ্দীপক (interesting case)। সেদেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান, অথচ তার নেতা অগণতন্ত্রী (no democrat) মোদি। তাঁর ধূমকেতুসম উত্থানের অন্যতম কারণ মুসলমানদের ওপর হিংসা প্রয়োগের জন্য লোক ক্ষ্যাপানো (inciting violence against Muslims)।
এরপর আসে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট ও আদানি প্রসঙ্গ। তখন সোরস বলেন, আদানি ও মোদি ঘনিষ্ঠ সহযোগী (Close allies)। তাঁদের ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে জড়িত (intertwined)। আদানির সংস্থাগুলো শেয়ার বাজারে টাকা তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শেয়ার বাজারে কারচুপি (stock manupulation) করেছেন। তাঁর নিজের শেয়ারে তাসের ঘরের মতো পতন ঘটে। মোদি এ বিষয়ে নীরব, কিন্তু তাঁকে এর জন্য বিদেশি লগ্নিকারক সংস্থাসমূহ ও সংসদের কাছে জবাবদাহি করতেই হবে।
সোরস এখানেই থামেননি। তিনি আরও বলেন, এর ফলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে মোদির দৃঢ় মুঠি বহুলাংশে শিথিল হবে এবং অতি প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দ্বার উন্মুক্ত হবে। আমি অনভিজ্ঞ (naive) হতে পারি, কিন্তু আমি ভারতের গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবন (democratic revial)-এর প্রত্যাশী।

আরও পড়ুন-দুই বাংলার মায়ার জঞ্জাল

আদানির বিষয়ে সোরস যে মন্তব্যগুলো করেছেন সেগুলোর পক্ষে কোনও তথ্য প্রমাণ বা নথি তিনি দেখাননি। আদানি গোষ্ঠী হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে ওঠা অভিযোগগুলোকে ‘কুৎসা রটনাকারী’, ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘হিসেব কষে ভারতের ওপর আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছিল। সোরসের অভিমতকেও ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপর আঘাত বলে অভিহিত করেছে বিজেপি। তাদের তরফে আরও দাবি করা হয়, সোরস ভারতে জমানা বদলে কার্যকর ভূমিকা নিতে চাইছেন।
এখন যদি, ঠান্ডা মাথায় সোরসের মন্তব্যটিকে বিচার করতে বসি, তাহলে দেখতে পাব, সোরসের বক্তব্যের একাংশ পুরোদস্তর রাজনৈতিক। তিনি মোদিজির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আস্থার বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তিনি মোদিজির রাজনৈতিক উত্থান, আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, আদানি কাণ্ডের প্রভাব মোদিজির নির্বাচনী ভাগ্যকে কতটা প্রভাবিত করবে, এসব নিয়ে মন্তব্য করেছেন। ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি ভাবতেই পারে, এবং সে অধিকার তাদের পুরোমাত্রায় আছে, যে, মোদিজির মতো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ আর হয় না। এই প্রেক্ষিতে সোরসের মন্তব্যের বিরোধিতা করতে বসে তাঁকে ‘বুড়ো, বড়লোক, একগুঁয়ে’ (সৌজন্যে জয়শঙ্কর) বলে অভিহিত করার হকও সম্ভবত তাদের আছে।

আরও পড়ুন-মোহনবাগানের ভাবনায় ক্লেটন

কিন্তু সোরস অর্থনীতি-সংক্রান্ত যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সেটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তিনি ক্রোনি ক্যাপিটালিজম নিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো উপেক্ষণীয় নয় এবং সত্যিই তো, এসব নিয়ে বিদেশি লগ্নিকারী ও সংসদে জবাবদিহি তো প্রধানমন্ত্রীর করারই কথা।
এসব বলে তিনি যেটা বোঝাতে চেয়েছেন সেটা হল কর্পোরেট গভর্নেন্সের ক্ষেত্রে ভারতের দৌর্বল্য এবং এদেশে নিয়ন্ত্রণতন্ত্রের ত্রুটি।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট যে খানিকটা হলেও সারবত্তা ছিল সেটা বোঝার জন্য দুটো দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। এক, আদানি তাড়াহুড়ো করে এফপিও তুলে নিল। দুই, আদানি গোষ্ঠী হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ করার ইচ্ছেটুকুও দেখায়নি।
অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি সর্বদাই সমালোচনাযোগ্য, সেটা ১৯৯২-তে সোরস নিজে ব্রিটেনে যে করেছিলেন সেটাই হোক কিংবা সম্প্রতি হিন্ডেনবার্গ যেটা করল সেটাই হোক। এত কিছুর পর অন্তত সেবি কিংবা এমসিএ বিদেশি লগ্নিকারীদের আশ্বস্ত করতে ও বাজারটাকে শান্ত করার জন্য আদানি গোষ্ঠীর ফরেনসিক অডিটের নির্দেশিকা জারি করতে পারত।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব চন্দ্রিমা

সেসব কিছুই হয়নি।
আর সেজন্যই মনে হচ্ছে এবং এরকম মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
সোরসকে না হয় বুড়ো বড়লোক বলে ধমকে চমকে নস্যাৎ করে দেওয়া গেল, কিন্তু দেশজুড়ে যে ধিক্কার ছি-ছিক্কার উঠেছে, সেটা উড়িয়ে দেওয়ার ‘খ্যামতা’ মোদিজি ও তাঁর ভকত্‌বৃন্দের আছে তো!

Latest article