তৃণমূল কংগ্রেসের ২৭ বছর

২৭ বছর ধরে নিরলস সংগ্রাম। জনস্বার্থে গঠিত তৃণমূল কংগ্রেসের অক্লান্ত পথ চলা। কেন সেদিন নতুন দল গড়ার আবশ্যকতা অনুভব করেছিলেন জননেত্রী। কেন আজও জোড়া ফুল ফুটিয়ে রাখার আবশ্যকতা অনুভূত দিকে দিগন্তে। সেসবের আনুপূর্বিক বিশ্লেষণে প্রবীর ঘোষাল

Must read

সে এক বিভীষিকার রাজত্ব। গোটা বাংলা জুড়ে তখন সিপিএমের বল্গাহীন সন্ত্রাস চলছে। গ্রামে তো বটেই শহরেও শান্তি নেই। লাল সন্ত্রাসের শিকার অবিভক্ত কংগ্রেসের নিচের তলার কর্মী-সমর্থকরা। রেহাই নেই বামফ্রন্টের শরিকদেরও। তারাও সিপিএমের তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছে গ্রামেগঞ্জে। কত প্রাণ যে হার্মাদদের হাতে বলি হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই।

আরও পড়ুন-বাংলা জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ২৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালন, শুভেচ্ছা জানালেন নেত্রী ও অভিষেক

১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে সিপিএমের বিপর্যয় বামফ্রন্ট জমানার একটা মাইলস্টোন। তার চেয়েও বড় কথা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা কংগ্রেসের কেষ্টবিষ্টুদের ম্যানেজ করে দিব্যি দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ওই নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রে জিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের সুখের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাঘা ব্যারিস্টারকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারিয়ে দেওয়া প্রথম প্রথম ‘অঘটন’ বলে চালাবার চেষ্টা করেছিল সিপিএম। কিন্তু অচিরেই তারা বুঝে যায়, মমতা নামে এক ‘ঝড়ের পাখি’র আবর্ভাব হয়েছে বাংলার রাজনীতির আকাশে। অনেকটা কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের মতো।
সত্যিই ঝড়ের পাখি! অল্প দিনেই অত্যাচারিত অবহেলিত বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক নেত্রী হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বছর দুয়েকের মধ্যেই তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে চলে গেল। জেলায় জেলায় ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। যেখানেই মমতা সেখানেই মানুষের ঢল। যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা! স্বভাবতই সিপিএমের ‘চক্ষুশূল’ হয়ে উঠলেন তিনি। কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা-নেত্রীর ঈর্ষার শিকার হলেন। অবশ্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং হাইকমান্ড বুঝে গিয়েছিলেন, বাংলার ‘মুখ’ হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।

আরও পড়ুন-বিজেপি হঠাওয়ের ডাক দিলেন নেতৃত্ব

কিন্তু বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’র সিপিএম বিরোধী অভিযানকে থামাতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সঙ্গে কংগ্রেসের আঁতাত ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে এল। রাজীব গান্ধী যতদিন জীবিত ছিলেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রীর পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বসিয়েছিলেন রাজীবই। আর ওই পদে বসার আগেই জননেত্রী প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, তাঁকে সিপিএম এতটাই ভয় পাচ্ছে যে, হত্যার চেষ্টা করতেও পিছ-পা হচ্ছে না। ১৯৯০ সালে ১৬ অগাস্ট কলকাতার হাজরা মোড়ের ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা। সিপিএমের হার্মাদরা হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছিল। বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষার পর বাড়ি ফেরেন নেত্রী। অগ্নিকন্যার আগুন নেভাতে এরকম ষড়যন্ত্র অবশ্য সিপিএম একবার নয়, বার বার করেছে। কিন্তু মমতাকে তাঁর লক্ষ্য থেকে সরানো যায়নি।

আরও পড়ুন-আইনশৃঙ্খলায় জোর, বৈঠকে গোপালিকা-নন্দিনী-ডিএমরা

রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর সিপিএমের অনেকটাই সুবিধা হয়ে যায় কংগ্রেস হাইকমান্ড এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে লালপার্টির দোস্তি নিবিড় হয়। রাজ্য কগ্রেস নেতৃত্বের একটা অংশ তো বরাবরই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অঙ্গুলিহেলনেই চলাফেরা করত। সিপিএমের মতোই তাদেরও টার্গেট ছিল, মমতা। ১৯৯২ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের ফলাফলই বুঝিয়ে দিয়েছিল, হাইকমান্ডও সিপিএমের নির্দেশেই কাজ করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত তখন থেকেই নতুন দল গঠনের মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। নেত্রী এটাও বুঝে যান, তিনি নয়া দলের জন্ম দিলে, কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের সিংহভাগই তাঁর সঙ্গেই থাকবেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে কলকাঠি নেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে দেওয়ার পর রাজ্যের সর্বত্র দল আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

১৯৯৮ সালের পয়লা জানুয়ারি ছিল রাজ্য রাজনীতির এক মাহেন্দ্রক্ষণ। মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হল। মাত্র কয়েকদিন পরেই লোকসভা নির্বাচন। তাক লাগানো ফল করল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই ফলের পর অবশ্য অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিতকে বলেত শুনেছি, মমতার দলের দশা অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেসের মতো হবে। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, কেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ও তো রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী পার্টি তৈরি করেছিলেন। কী হল, সেই দলের? কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল প্রণববাবুর দল।
কিন্তু মমতা তো সিপিএমকে বধ করার জন্য ঈশ্বর-আল্লার আশীর্বাদ নিয়ে ময়দানে নেমেছেন। তাঁকে কে রুখবে? ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলল তৃণমূল কংগ্রেস। ১৯৯৮ সালের ভোটেও তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বগতি বজায় রইল। কিন্তু রাজ্যবাসীকে ২০০০ সালে আর একটি ভোটে মমতা চমকে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল, পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচন। সিপিআই নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়েছিল।

আরও পড়ুন-আরও হিয়ারিং অফিসার নিয়োগ করছে পুরসভা

মমতা তখন রেলমন্ত্রী। বাক্স-বেডিং নিয়ে তিনি হাজির হলেন মেদিনীপুরে। শহের একটি বেসরকারি বাংলোয় ঘাঁটি গাড়লেন। টানা ৯ দিন সেখানে থেকে তিনি শুধু মামুলি প্রচার নয়, সিপিএমের সন্ত্রাস কবলিত গ্রামগুলি চষে বেড়াতে লাগলেন। মমতাকে কাছে পেয়ে গণ-জাগরণ সৃষ্টি হল। এই অধ্যায়ের এই প্রতিবেদকও একজন সাক্ষী। একই বাংলোয় থেকে আমরা দুই সাংবাদিক মমতার সেই নাছোড় যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলাম। যুদ্ধই বটে। পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত অধিকাংশ গ্রাম তো তখন হার্মাদদের দখলে। দিনেও তাদের আতঙ্কে গ্রামের মানুষ তটস্থ হয়ে থাকে। কিন্তু পরিবর্তনের চোরাস্রোত যে বইতে শুরু করেছে, পাঁশকুড়ায় ভোটের ফল তা বিলক্ষণ জানিয়ে দিল। সিপিএমের বকলমে বামফ্রন্টকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। আর যে কংগ্রেস ভোট কেটে সিপিআইকে জেতাতে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল, তাদের পাঁশকুড়ায় জমানত জব্দ হল। অর্থাৎ বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের বিকল্প যে মমতা এবং তৃণমূল কংগ্রেস, তা নিয়ে জনমনে আর কোনও দ্বিধা রইল না।

আরও পড়ুন-তাইওয়ান নিয়ে ফের উত্তেজনা

সিপিএমও হিসাব কষল, আর ঘোমটা দিয়ে রিগিং-সন্ত্রাস নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে, আরও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে হবে ওই সব অস্ত্র। তার পরিণতি ২০০১ সালে বিধানসভা এবং ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। বুথের পর বুথে পুলিশ পাহারায় হার্মাদরা অবাধে রিগিং করল। সেই সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় শিকার ছিল গ্রামাঞ্চল। লোকসভা ভোটে আরামবাগ কেন্দ্রে সিপিএম ৬ লক্ষ ভোটে জিতে দেশের মধ্যে রেকর্ড গড়েছিল। অথচ, আরামবাগে লালপার্টিকে আজ দূরবিন দিয়ে খুঁজলেও দেখা যায় না। ২০০৬ সালেও সন্ত্রাস-রিগিং চালিয়ে সিপিএম ফের জিতে আসে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দম্ভ করে বলেছিলেন, আমরা ২৩৫, আর ওরা (তৃণমূল কংগ্রেস) শুধু ৩০।
মমতা কিন্তু হতোদ্যম হননি। তৃণমূল কংগ্রেসকে তিনি লড়াইয়ের ময়দানে রেখেছিলেন। আর নিজেও দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন। তার ফলও পেলেন হাতেনাতে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ছিল বাংলার রাজনীততে এটা পরিবর্তনের সেমিফাইন্যাল। ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ২৬টি আসন দখল করে। জোটে ছিল কংগ্রেস এবং এসইউসি। সিপিএমের রিগিং তখন থেকেই অনেকটাই আটকে যায়। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কড়া মনোভাবে হার্মাদদের সাজানো ছক ভেঙে যায়।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ছিল ঐতিহাসিক। দেশের মধ্যে একমাত্র রাজ্য যেখানে বামফ্রন্টের নামে সিপিএম একদলীয় শাসন কায়েম রেখেছিল একটানা ৩৪ বছর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করলেন, লালপার্টির অপশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দুই দশক ধরে তিনি যুদ্ধ করে রাজ্যকে ফ্যাসিস্ট শাসনের কবল থেকে মুক্ত করেন।

আরও পড়ুন-বছর শুরুর দিনেই দিঘায় মানুষের ভিড়ে রেকর্ড

রাজ্যপাটে বসেও মমতা যুদ্ধের অবসান ঘটাননি। তখন ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, এখন চালাচ্ছেন উন্নয়নের যুদ্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে জব্দ করতে নানা জনমুখী প্রকল্পের কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে। সিবিআই, ইডি’র মতো এজেন্সিগুলিকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবুও মমতাকে দমানো যাচ্ছে না। যেমন অতীতে সিপিএম পারেনি। ২৭ বছর তৃণমূল কংগ্রেস একইভাবে অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে মমতার নেতৃত্বে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

Latest article