এ কেমন বাজেট, যে বাজেটে কর্পোরেটের কর কমে, গ্রামীণ কর্ম সংস্থান অবহেলিত হয়? এ বাজেট তবে কি গরিবি আর বেকারত্ব বাড়ানোর বাজেট? লিখছেন অর্থনীতিবিদ দেবনারায়ণ সরকার।
“If the misery of the poor be caused not by the laws of nature but by our institutions great is our sin.” –Charles Darwin
চার্লস ডারউইনের উল্লিখিত বক্তব্য পুনঃপ্রমাণিত আজকের বাজেটে। সত্যিই, দরিদ্রের দুর্দশা যদি প্রাকৃতিক কারণে না ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক কারণে ঘটে তবে তা পাপ।
কী দেখলাম এই বাজেটে?
যেখানে বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কোভিড পরিবেশে বিভিন্ন ধনকুবেরের সম্পদ বৃদ্ধি পেল, এবং তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ ভারতের ৪২ শতাংশ মানুষের সম্পত্তির সমান, আর অন্য দিকে নিচের ৮৪ শতাংশ মানুষের আয় নিম্নগামী আর দরিদ্র মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমল, তখন এই বাজেটে দেখা যাচ্ছে উচ্চবিত্তের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, আর নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কোনও সুবিধা বাড়েনি।
আরও পড়ুন-আইপিএল নিলামের মার্কি লিস্টে ধাওয়ান-অশ্বিন
অত্যন্ত লজ্জা লাগে, বড়লোকদের আরও বড়লোক এবং গরিবকে আরও গরিব করার লক্ষ্যে করপোরেটেদের সুবিধার জন্য ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হল। কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল, এবার তার সময়সীমা ৩১ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হল। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ১৫-২০ কোটি টাকা কমবে। দারিদ্র দূরীকরণে কোনও প্রকল্প এই বাজেটে ঘোষিত হয়নি। এমনকি মধ্যবিত্তের জন্যও কোনও সুবিধার কথা ঘোষণা করা হয়নি। এই সুবিধার কথা কর কিংবা প্রকল্পে ঘোষণা করা যেত, কিন্তু তা কোনও কিছুতেই প্রতিফলিত হয়নি। এমনকি প্রবীণ নাগরিকদের জন্যও কোনও সুবিধার কথা এই বাজেটে ঘোষিত হয়নি।
আরও পড়ুন-কপিল খোঁজার চেষ্টা ছেড়ে এগিয়ে চলো ভারতীয় দলকে বার্তা গম্ভীরের
অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হয় ৯২-৯৩ শতাংশ। অথচ আদের জন্য কার্যত কোনও প্রকল্পই এই বাজেটে ঘোষিত হল না। শুধু বাজেটে বলা হল, আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ লোকের চাকরি হবে। কিন্তু কীভাবে এটা হবে তাঁর কোনও দিশা এই বাজেটে অন্তত নেই। এটাও কি তবে মোদিজীর বছরে দুই কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতির মতোই আর একটা জুমলা?
সামনের বছর পুঁজি খাতে সাড়ে ৭ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ের কথা বলা হল। কিন্তু এর ৬০ শতাংশও কি খরচ হবে? আশঙ্কাটা এই কারণেই যে, এবারে বাজেটে পুঁজি খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ৫ লক্ষ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়নি। প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। খরচ জখক হয়নি, তখন ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হল কেন?
আরও পড়ুন-প্রথম আইপিএল : ফিরে দেখা বিরাটের, আরসিবির টাকার অঙ্ক শুনে অবিশ্বাস্য লেগেছিল
বর্তমান বছরের সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বৃদ্ধির ফলে স্থির পুঁজি গঠনের হার জাতীয় আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ, এন পি এ ২ -এর আমলে এই শতাংশ প্রায় দ্বিগুণ ছিল। তাঁর মানে সরকার কার্যত মেনে নিল, এই আমলে সঞ্চয় বাড়ছে না, বিনিয়োগ বাড়ছে না, উৎপাদন বাড়ছে না, বাড়ছে না চাহিদাও। কোথাও যেন একটা দুষ্ট চক্র ক্রিয়াশীল। তাঁর ফলে বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে দারিদ্র। এখনই প্রায় ৫ লক্ষ ৫ কোটি বেকার, তার মধ্যে প্রায় ২কোটি বেকার কাজের খোঁজও বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে চরম সংকট দেখা যাচ্ছে। গত দু বছরে কর্পোরেটদের কর হ্রাস করার পাশাপাশি প্রায় ৩০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সুবিধা তারা পেয়েছে। কিন্তু তারা বিনিয়োগের পথে পা মাড়ায়নি।
মনে রাখতে হবে, শুধু সরকারি ব্যয় দিয়ে কর্ম সংস্থান বাড়ে না। বেসরকারি বিনিয়োগকারী যে আসছে না, সেটা সার্ভে থেকেও পরিষ্কার। কর্পোরেটরা আরও ধনী হচ্ছেন, কিন্তু বিনিয়োগ করছে না বলে কর্ম সংস্থানের অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে।
আরও পড়ুন-বাজেটে চাঙ্গা শেয়ারবাজার
অর্থ মন্ত্রী ঘোষণা করছেন, এবার রাজস্ব ঘাটতি মাত্রা ছাড়াতে চলেছে। ধ্রা হয়েছিল এই জি ডি পির ৬.৮ শতাংশ হবে। এটা হতে চলেছে জি ডি পির ৬.৯শতাংশ। টাকার অংকে এর পরিমাণ সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
পরিকাঠামো ক্ষেত্রে অনুমিত ব্যয়ের প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে না, সেই টাকা ব্যয় হচ্ছে ঘাটতি বাজেটে বেতন পেনশন মেটাতে। ফলে দরিদ্রতা বাড়ছে, কমছে কর্ম সংস্থান।
অর্থ মন্ত্রীর দাবি বর্তমান বছরে দেশের জি ডি পি ৯.২ শতাংশ নাকি বাড়বে। এমনটা আশাতীত। এটা তো সত্যি যে গত বছরে জি ডি পি ৬ শতাংশেরও বেশি কমেছে। এবার নাকি তা ৯ শতাংশের বেশি বাড়বে। অঙ্ক কিন্তু বলছে, বড়জোর জি ডি পি ২ শতাংশ বাড়বে। করোনার আগে যা জি ডি পি ছিল এখনও সেটাই থাকবে, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-লাল ফৌজের নির্যাতন মিরামকে, অপহরণের পর কী হয়েছিল, জানালেন বাবা
গ্রামীণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ২০২০-২১-এ ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে ব্যয় ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা। এ বছর সেই খাতে ব্যয় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ ব্যয় কমান হয়েছে। এবার ও সেই খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়নি। এর থেকে পরিষ্কার, গ্রামের গরিব মানুষের কাজের ব্যাপারে এই সরকার উদাসীন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সরকার ১ লক্ষ ৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, বাজেটের মোট ব্যয়ের ২ শতাংশের সামান্য বেশি খরচ করতে চাইছে। এটা দেশের এবছরের জি ডি পির প্রায় ০.৪ শতাংশ। উল্টো দিকে আমাদের রাজ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও ব্যয় না বাড়িয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
আর যাই হোক, এই বাজেট গরিবের জন্য নয়, মধ্যবিত্তের জন্যও নয়।