কথামুখ
তরুণ ঔপন্যাসিক অনুপ বাড়তি রোজগারের জন্য বিখ্যাত শিল্পপতি রাজেন্দ্রনাথের বক্তৃতার বিবরণী লিখে দেন। শিল্পপতির মেয়ে গোপার বন্ধু হল অনুপের বোন সুমিত্রা। গোপার জন্মদিনে চুরির মিথ্যে অপবাদে অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় সুমিত্রাকে। দুটি পরিবারের মধ্যে ভাঙন ধরে। রাজেন্দ্রনাথের ছেলে বাবার বক্তৃতা-বিবরণী লিখতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই সন্তান অনুপের বাড়িতে এই অনুরোধ নিয়ে হাজির হন, যাতে অনুপ সেই কাজটি করে দেন। সেখানে পূর্বাচল উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি দেখে সেটি ছাপানোর দায়িত্ব নেন। কিন্তু ঐ উপন্যাস কুপুত্র নিজের নামেই ছাপিয়ে বার করেন। এদিকে অনুপের নানা গুণ; শ্রমিকদের প্রতি টান ভালবাসা, লেখালেখির শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান গোপা। ধীরে ধীরে গোপার গোপন প্রেম জেগে ওঠে এই অনুপের জন্য। অনুপের কাজে সাহায্য করতে ধনির দুলালী গোপা এগিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন-স্তব্ধ সন্তুর
গোপার গান মুগ্ধ করে অনুপকে। বাবা বা দাদার ধাঁচে তৈরি নয় গোপা, সেটাই আরও মুগ্ধ করে অনুপকে। বাবা দাদার সঙ্গে বিবাদ করে গোপা ছুটে আসেন অনুপের কাছে। অনুপের সঙ্গে নতুন দেশ গড়ার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। যে ছবির গল্পের প্রস্তাবনা করলাম, সেই ছবির নাম ‘উদয়ের পথে’। ভারত-বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের প্রথম ছবি উদয়ের পথে। নায়ক রাধামোহন ভট্টাচার্য প্রায় নতুন। কিন্তু নায়িকা বিনতা বসু সম্পূর্ণ নতুন। কিন্তু সেই প্রথম ছবিতেই তিনি দেখালেন তাঁর প্রতিভার পরিচয়। চেহারার মধ্যে যে আভিজাত্য ছিল তাতে গোপা চরিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি। উদয়ের পথে ছবিতে তাঁর মুখের বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতগুলি নিজেই গেয়েছিলেন। গানগুলির মধ্যে ছিল ‘ওই মালতীলতা দোলে’, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’, ‘তোমার বাঁধন খুলতে লাগে’, ‘বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা’ ইত্যাদি। এ-ছাড়া জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ তিনি গিয়েছিলেন এই ছবিতে। সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল। নিউ থিয়েটার্স প্রোডাকশনের সেই ছবি যথারীতি ডাবল ভার্সনে নির্মিত হয়েছিল। হিন্দি ‘হাম রাহি’ তো তিনি গোপার চরিত্রে শিল্পী। উদয়ের পথে ছবির সুবাদে তিনি পেয়েছেন বিএফজে-র বিচারে বছরের শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার। শিল্পী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিকাশ রায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘সুকণ্ঠী, সু-অভিনেত্রী, পরিশীলিত ছাপলাগা চেহারা বিনতা বসুর আগে আর বিশেষ কেউ ফিল্ম লাইনে আসেননি, তা জোর গলায় বলা যায়।”
আরও পড়ুন-সেবার দীপ জ্বেলে যাচ্ছেন যাঁরা
জীবনকথা
প্রবাসী অভিজাত ব্রাহ্ম হিসেবে পাটনায় খুব নামডাক সত্যসখা বসুর। সবাই তাঁকে মান্য করেন। সেই পরিবারে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন বিনতা। বাড়িতে পড়ার আবহাওয়া ছিল। বাড়িতে যা বিরাট লাইব্রেরি ছিল তাতেই সময় কেটে যেত। মন দিয়ে পড়াশোনা করেছেন বিনতা। কলকাতায় আসার পর যেহেতু সংগীতের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড, তাই রেকর্ডে গান গাইতে সময় লাগেনি। নিউ থিয়েটার্সের শিল্পী হিসেবে প্রবেশ করলেন। প্রথমে প্রতিষ্ঠা পেলেন গায়িকা হিসেবে। পরে নায়িকা হিসেবে। ১৯৪২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিকশূল’ ছবিতে তাঁর গাওয়া গান দর্শক শ্রোতাদের মন ভরাল। সুরকার পঙ্কজকুমার মল্লিক। পরে বিভিন্ন ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন তাতে সুরারোপ করেছেন রাইচাঁদ বড়াল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ মজুমদার প্রমুখ সুরকার। ১৯৪৬ সালে বিখ্যাত লেখক-পরিচালক জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ। দুই পুত্র ও এক কন্যার জননী ছিলেন বিনতা রায়।
আরও পড়ুন-যুবভারতীতে আই লিগ ফয়সালার ম্যাচ, মার্কাসই আজ বড় ভরসা মহামেডানের
ছবির জগতে বিচরণ
‘উদয়ের পথে’ ছবির বিরাট মাপের সাফল্যের পর আশা করা গিয়েছিল, তিনি অজস্র ছবির বন্যায় ভাসবেন। বাস্তবে তা হয়নি। চটুল চপল চরিত্র পছন্দ করতেন না। চরিত্রের মধ্যে গভীরতা গাম্ভীর্য আভিজাত্য না থাকলে সেই ছবিতে কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন না। পরিচালক স্বামী তাঁকে অন্য পরিচালকের ছবিতে কাজ করতে দিতেন না। তাই তিনি অভিনয় করতে পারলেন না বিমল রায় পরিচালিত ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতেও। ফলে তাঁর অভিনীত অধিকাংশ ছবিরই পরিচালক স্বামী জ্যোতির্ময় রায়। পরিচালক নিজেই যেখানে কাহিনিকার, সেখানে অথর ব্যাকিং চরিত্র তৈরি করে তাতে নায়িকা হতেন বিনতা। তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে অভিযাত্রী, দিনের-পর-দিন, শঙ্খবাণী, টাকাআনাপাই, মা, কাঁচামিঠা প্রভৃতি। জ্যোতির্ময় রায়ের মৃত্যু হয় ১৯৬১ সালে। স্বামীর মৃত্যুর কারণে প্রায় ১১বছর অভিনেত্রী জীবন থেকে দূরে সরে ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর সব কাজের প্রেরণা স্বামীর মৃত্যুতে তিনি একা হয়ে গেলেন। খানিক ভেঙে পড়লেন। কিন্তু মনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে এবং কাজের মধ্যে থাকতে হবে এই ব্রত নিয়ে আবার তিনি চলে এলেন ছবির জগতে। তখন তিনি চরিত্রাভিনেত্রী। তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’ ছবিতে তিনটি দম্পতির গল্প ছিল। দ্বিতীয় দম্পতি হল বিকাশ রায়-বিনতা রায়। ধনী তবু অসুখী দাম্পত্য। একমাত্র সন্তানের দিকেও নজর নেই। পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের ‘আলো আমার আলো’ ছবিতে নায়ক উত্তমকুমার চরিত্রহীন, তার মূলে ছিল ছোটবেলায় তাঁর মায়ের (বিনতা রায়) নিজের চোখে দেখা লাম্পট্য। মৃণাল সেন পরিচালিত ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতে অভিনয় করলেন দাপটের সঙ্গে। রাজেন তরফদার পরিচালিত ‘আকাশ ছোঁয়া’ ছবির সম্বন্ধেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। এ-ছাড়াও তাঁকে পেয়েছি সখের চোর, শ্রেয়সী, ছায়াতীর, ছিন্নপত্র, নতুন দিনের আলো প্রভৃতি ছবিতে। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি হংসরাজ (১৯৭৭)।
আরও পড়ুন-দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প
অন্যান্য গুণপনা
বিনতা রায়ের নিজস্ব রেকর্ড আছে রবীন্দ্র সংগীতের, গীত ও ভজনের। আকাশবাণীর নাটকের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। বেতার নাটকে তাঁর কণ্ঠস্বর শ্রোতাদের মাতিয়ে দিত। পেশাদার মঞ্চে অভিনয় করেছেন। নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। লিখেছেন গল্প-প্রবন্ধ বিভিন্ন দৈনিকে ও সাময়িক পত্র-পত্রিকায়। তিনি বাংলা ছবির জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন। তাঁর স্বামীর চিত্রনাট্যগুলির তিনি প্রথম পাঠক ছিলেন।
পরপারে পাড়ি
বিনতা রায় পরলোক গমন করেন ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত সহশিল্পী বিকাশ রায় যে তথ্য দেন তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী, ‘‘সকালবেলা অনুপ কুমার টেলিফোন করে খবর দিলে উনি মারা গেছেন। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কতক্ষণ। তারপর গেলাম। ওর দুই-চার জন শিল্পী আত্মীয়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর ওঁর দুই নায়ক রাধামোহন ভট্টাচার্য আর আমি। চিত্রজগতের আর কেউ নেই। দর্শকের চোখের আড়াল হয়েছিলেন অনেক দিনই। ভুলে যাওয়া মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। কিন্তু ব্যথা লেগেছিল ভাবতে আমাদের চিত্রজগতে ওর তো পরিচিত বন্ধুবান্ধব আজ তিরিশ বত্রিশ বছরের মধ্যে হয়েছিল। তারা কেউ এলো না কেন?” সেটাই যে কালের ধর্ম তা নতুন করে বোঝা গেল।