দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প

এ যেন কালের নির্দেশ। কিছু মানুষ সে নির্দেশেই সময়ের আগে জন্ম নেন পৃথিবীতে। এবং এমন কিছু দিশা দিয়ে যান কিংবা দৃষ্টান্ত রেখে যান যে ভাবীকাল তাঁদের আজীবন স্মরণ করতে বাধ্য হয়। এঁরা ভূষিত হন ঈশ্বরের পাঠানো দূত হিসেবে কিন্তু জীবন সঁপে যান মনুষ্যত্বের জন্য। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তেমনই এক মানুষ। ফের একবার তাঁকে ফিরে দেখলেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

উইকিপিডিয়ায় তাঁর প্রথম পরিচয় ‘পরিসংখ্যানবিদ’ কিন্তু বিশ্ব জুড়ে তিনি পরিচিত ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে, সেবাই যার পরম ধর্ম, আলোকবর্তিকা হাতে যাঁর ছবি আজ অবধি আইকন, পৃথিবীর সমস্ত দেশের পাঠক্রমে যাঁর জীবনী অন্তর্ভুক্ত, গত কয়েক দশক যাবৎ যাঁর জন্মদিবস ভূষিত ‘আন্তর্জাতিক নার্সিং দিবস’ হিসেবে! আপাতভাবে অদ্ভুত ঠেকলেও দুটোই সত্যি। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আসলে অচলায়তনকে ভেঙে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক নারীর নাম। যাঁর জীবন শুধু বিস্ময় জাগায় না, বাড়ায় আত্মবিশ্বাস, আস্থা ও ভরসা। অভিজাত ব্রিটিশ পরিবারে জন্মেছিলেন ১৮২০ সালের ১২ মে। বাবা উইলিয়াম নাইটিঙ্গেল, মা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, বিয়ে-পরবর্তী ইউরোপ সফরে বেরিয়েছিলেন তখন। ফ্লোরেন্স শহরে মেয়ের জন্ম হওয়ায় শহরের নামেই নাম রেখেছিলেন মেয়ের। ফ্লোরেন্সের জন্মের এক বছর পর সপরিবার ফিরে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। এরপর ডার্বিশায়ারে বসবাস করতে শুরু করেন তাঁরা।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে আজ জরুরি বৈঠক নবান্নে

হয়তো ঈশ্বর যাঁদের তাঁর দূত হিসেবে পাঠান, অলক্ষে তাঁদের পথও মসৃণ করার দায়িত্ব নেন। নাহলে ফ্লোরেন্স যখন জন্মান তখন অনেক মেয়েই শিক্ষা কী তা বোঝার সুযোগ পেত না। শুধু তাই নয়, তাদের ভবিতব্য ছিল উপযুক্ত পুরুষের উপযুক্ত সহধর্মিণী হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা এবং তাঁর সন্তানের মা হিসেবে গার্হস্থ্য যাপন করা। কিন্তু ফ্লোরেন্সের বাবা তেমনটা মনে করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন মেয়েদেরও শিক্ষা গ্রহণ প্রয়োজন। তাই ফ্লোরেন্স ও তাঁর বোনকে তিনি বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন, ইতিহাস এরকম নানা বিষয়ে শিক্ষিত করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ফ্লোরেন্স বিশ্বাস করতেন স্রষ্টা তাঁকে সেবিকা হওয়ার জন্যই পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে! কারও অসুস্থতার খবর পেলেই ছুটে যেতেন সেখানে। সেবাকাজের সময় তাঁর হুঁশ থাকত না তিনি কে, কোন বাড়ির মেয়ে কিংবা কাদের সেবা করছেন। অসুস্থ, পীড়িত, আর্ত, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই হত একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু বাবা-মাকে যখন ফ্লোরেন্স জানালেন, তিনি নার্সিং-এ প্রশিক্ষণ নিতে চান, প্রথমে তাঁরা রাজি হননি। ফ্লোরেন্স ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলেন অনুমতি আদায়ের জন্য। আসলে নার্সিং-এর কাজকে সে সময় বেশ ছোট চোখে দেখা হত। বড় ঘরের মেয়েরা একে পেশা হিসেবে বেছে নেবে কেউ ভাবতেও পারত না। তাই ফ্লোরেন্সের বাবা-মাও চাইতেন তাঁদের মেধাবী মেয়ে কোনও ভাল পেশায় যাক। শেষ অবধি ১৮৫০ সালে জার্মানিতে গিয়ে তিনি নার্সিং ট্রেনিং নেন। সেখান থেকে ফিরে লন্ডনে হ্যারো স্ট্রিটে এক মহিলা হাসপাতালে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজে যোগ দেন।

আরও পড়ুন-বিজেপি-সিপিএম চায় বাংলাকে অশান্ত করতে

এই সময় থেকেই তিনি নার্সের প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। নিরলস চেষ্টায় ১৮৫৯ সালের মধ্যেই তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন ৪৫ হাজার পাউন্ড। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা নিতে শুরু করেন তিনি। ১৮৫৩ সালের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রচুর ব্রিটিশ সৈন্য আহত হন। কিন্তু সেনা হাসপাতালের অবস্থা ও পরিষেবা যখন জনমানসে তুমুল ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল মাত্র ৩৮ জন সহকারী নার্স নিয়ে ফ্লোরেন্স সেখানে পৌঁছন। ভালবাসা, নিষ্ঠা আর আন্তরিক সেবার মাধ্যমে তিনি শুধু যে সেনাদের সুস্থ করেছিলেন তাই নয়, ভোল পাল্টে দিয়েছিলেন হাসপাতালের পরিবেশ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার। তাঁর একক প্রচেষ্টায় মৃত্যু হার বেয়াল্লিশ থেকে দুই শতাংশে নেমে এসেছিল। এখানেই সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, রাতেও তিনি একা ল্যাম্প নিয়ে অসুস্থ সৈন্যদের দেখতে বেরোতেন। ‘দ্য টাইম’ পত্রিকা এই সময়েই তাঁকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ উপাধিতে ভূষিত করে। সারা বিশ্বে তাঁর এই ছবি প্রচারিত হয়ে যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে প্রশস্তির বন্যা বইতে শুরু করে যা তাঁর মোটেও পছন্দ ছিল না। সেকারণে অনেক সময়ই ব্যবহার করতেন, ‘মিস স্মিথ’ ছদ্মনাম। এরপর ১৮৫৯ সালে রয়্যাল স্ট্যাটিস্টিকাল সোসাইটির প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। আর এক ধাপ এগোন পরের বছরেই। লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতালে নার্সিংকে পূর্ণ সময়ের পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’। বর্তমানে এই স্কুলের নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অফ নার্সিং’। এতেই থেমে থকেননি এই উদ্যমী নারী। ১৮৬৭ সালে নিউ ইয়র্কে প্রতিষ্ঠা করেন ‘উইমেনস মেডিক্যাল কলেজ’। ১৮৮৩ সালে তাঁর এসব অনবদ্য সামাজিক অবদানের জন্য রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে ‘রয়্যাল রেডক্রস’ পদকে সম্মানিত করেন। প্রথম নারী হিসেবে পান, ‘অর্ডার অফ মেরিট’ খেতাব।

আরও পড়ুন-সরকারি বোর্ড লাগানো নীল বাতির গাড়ি নিয়ে ভুয়ো জিএসটি অফিসার ধৃত

সেবাকাজের পাশাপাশি আরও এক ঝোঁক ছিল তাঁর। তথ্য লিপিবদ্ধ করা। প্রথমে যা ঝিনুক সংগ্রহ দিয়ে শুরু হয়েছিল পরে তাই হয়ে দাঁড়ায় প্যাশনে। ভালবেসে ফেলেন পরিসংখ্যানবিদের কাজ। পরবর্তীতেও বিভিন্ন হাসপাতালে ও সেবা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধকরণের কাজ করেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। এর জন্য অঙ্কে বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। রোগীর অসুখ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত নানা তথ্য তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নথিবদ্ধ করে তা ‘পাই চার্ট’, ‘রোজ ডায়াগ্রাম’-এর মাধ্যমে সহজবোধ্যভাবে অনুদান আদায়ের জন্য ও অন্যান্য সুবিধার জন্য পাঠাতেন। এভাবেই তিনি দেখিয়েছিলেন শতকরা নব্বই ভাগ অসুখই হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাবে আর তা নিবারণযোগ্য। সব মিলিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপুল পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছিলেন ফ্লোরেন্স।

আরও পড়ুন-চাঁদেই অঙ্কুরিত

ফ্লোরেন্সের আর এক বিস্ময়কর দিক ছিল তাঁর শক্তিশালী লেখনী। প্রায় দুশোটির ওপর বই লিখেছিলেন তিনি। ১৮৫৯ সালে ‘নোটস অফ নার্সিং’ নামে একটি বই লিখেছিলেন যা আজও প্রাসঙ্গিক। আজও নার্সরা তাঁদের শিক্ষাজীবন শুরু করেন ‘নাইটিঙ্গেল’-এর নামে শপথ নিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নার্সিং-এর জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কারের নামও তাঁরই নামে, ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মেডেল’। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে তাঁর কণ্ঠস্বর, যেখানে তিনি বলেছেন, “যখন আমি থাকব না, তখন আমার এই কণ্ঠস্বর আমার কীর্তিগুলির কথা মানুষকে মনে করিয়ে দেবে এবং সেবাকাজের জন্য তাদের উৎসাহিত করবে।” জীবনের শেষদিন অবধি এই আশা নিয়েই বেঁচেছিলেন তিনি। ১৯১০ সালের ১৩ অগাস্ট ফের ঈশ্বরের কোলে ফিরে যান এই মহান নারী।

Latest article