আমাদের ছোটবেলায় দেখা বিষয়গুলো আজ অপরাহ্ণে বেশি করে মনে পড়ছে। মস্তরামের মেলাতে নারী-পুরুষ সকলে মিলে, হিন্দু–মুসলমান নির্বিশেষে মস্তরাম বাবার দরবারে দুধ আর ডাব দিচ্ছে। বিলের জলে ডাব ফেলছে। সবার মনে কোনও না কোনও গোপন ইচ্ছে পূরণের আশা আছে। পূরণ হয়েছে কি না বলতে পারব না, তবে সুরধনী মাসি আর সকিনা বেওয়া মেলা শেষে, নাতির জন্য রঙিন বেলুন কিনে এক সঙ্গে পা মিলিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সারাটা রাস্তায় চলেছে তাদের সুখ-দুঃখের বারোমাস্যা। জাত ধর্ম এসব কেউ মনে রাখেনি।
আরও পড়ুন-লড়েই জিততে হল জকোকে
আবার আমাদের বাড়ির প্রায় সামনেই বড় মসজিদ। মগরিবের নামাজের শেষের আগে থেকে নারী-পুরুষের ভিড়। সঙ্গে বাটি-ভর্তি জল। নমাজের শেষে ইমাম সাহেব জলে দোয়া পড়ে দেবেন। কারও জ্বর, কারও পেট খারাপ, কারও মাথার ঠিক নেই। জল-পড়া খেলে নাকি ভাল হবে। বিশ্বাস। জলের বাটি নিয়ে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু মা-বোন, ভাই সবাই আছেন। মুসলমান বাড়িতে মনসা পুজো আজও গ্রামীণ বাঙলায় বড় আদর করে হচ্ছে।
আরও পড়ুন-ডিআরএসের দাবি তুললেন মুম্বই কোচও
বাংলায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটে তার বড় কারণ এ রাজ্যের মানুষের বৌদ্ধিক উচ্চতা। এটা প্রথাবদ্ধ শিক্ষার জন্য আসে না। জীবনের থেকে গ্রহণ করতে হয়। মাটিতে কান পাতলে শোনা যায় সহিষ্ণুতার গল্প। বাতাসে ভাসে লালনের গানের সুর। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা। কাজী নজরুলের আহ্বান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত, তত পথ’। বাঙালির মনের দরজা বড় প্রশস্ত করে খোলা হয়। তৈরি হয় ইতিবাচক জীবনবোধ। সেই কারণে বাঙালি জাতি বোধ হয় সকলের থেকে আলাদা। তা যদি না হবে, তাহলে বারাসতের বোসবাবুরা বংশ পরম্পরায় মসজিদের ‘সেবায়েত’ হয়ে থাকবেন কেন? আসলে তো ‘মোতয়ালি’। কী যত্ন নিয়ে মসজিদ রক্ষা করছেন। মসজিদ রেখে পূর্ব বাংলায় চলে গেছেন মুসলমানরা। এই তো সেদিন, একই কারখানায় কাজ করা দুই শ্রমিক আশ্চর্য নজির গড়লেন। হিন্দু ভাইটিকে বাঁচাতে মুসলমান ভাইটি তাঁর কিডনি দিলেন। মৃত হিন্দু জনকে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছেন মুসলমানরা। শেষকৃত্য করছেন। শ্রাদ্ধে মানুষজন খাওয়াচ্ছেন এসব তো আকছার হচ্ছে বাংলায়। কিন্তু আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেককে অবাক করে দিলেন রামপুরহাটের মুসলমান রমণী। তিনি একটি হিন্দু বালকের পৈতের পর ভিক্ষা-মা হলেন। ছবিতে সবার মুখে যে হাসি দেখেছিলাম তাতে মনে হল শত বঞ্চনাতে, চক্রান্তেও বাংলার প্রাণ মরেনি। কোনওদিন মরবে না।
আরও পড়ুন-৩-০ জিতল ইংল্যান্ড
সারা রাজ্য জুড়ে এমন সম্প্রীতির, ঐক্যের ঘটনাগুলি ঘটে যায়। বাঙালি জীবনে তার বড় প্রভাব আছে। এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ সম্প্রীতিতে, ঐক্যে, ভালবাসায় গলা জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকতে চায়। আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য সেটাই। আমরা সবাই মিলে এই ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখব সেটাই প্রতিজ্ঞা।
কিন্তু কোনও কোনও সময় ঝোড়ো বাতাস এসে পড়ে বাংলার বুকে। কোনও সময় সেটা সুনামির আকার ধারণ করে। আসলে যারা বাংলার ঐক্য ও সম্প্রীতি সহ্য করতে পারে না তারা এটা করে। এর শিকড়টা বাংলার বাইরে। সম্প্রতি প্রিয় পয়গম্বরকে নিয়ে এক কুৎসিত মন্তব্য করেছেন বিজেপির মুখপাত্ররা। ঘটনা ও তার পরবর্তী বিষয়গুলো সকলের জানা। আমি তার বর্ণনায় যাচ্ছি না। কয়েকটি বিষয় তবুও বলতে হবে কারণ ভারত তথা আমাদের রাজ্যের সম্মান জড়িয়ে আছে। বিজেপি খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করেছে।
আরও পড়ুন-শেষ ম্যাচে হার হরমনপ্রীতদের
পরে মুখপাত্রদের বহিষ্কার করেছেন। তাঁদের ‘খুচরো নেতা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। আবার তাঁদের নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। চক্রান্তটা সহজে বোঝা যায়। এতদিনে প্রধানমন্ত্রী একটাও মন্তব্য করেননি। মৌন থাকাটাকে কূটনীতির অঙ্গ বলে মনে করছেন। বিদেশে ভারতের সম্মানে বড় আকারের কালো দাগ পড়ে গেছে। ২০টি দেশ আমাদের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে গভীর উদ্বেগ ও উষ্মা প্রকাশ করেছে। যারা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। এত অপমান ভারত অতীতে কখনও সয়নি। বৈদেশিক সখ্য রক্ষা যে কেবল কোলাকুলি করা বা বিনা নিমন্ত্রণে ভোজ খাওয়াতে হয় না সেটা প্রমাণিত। এই চূড়ান্ত ব্যর্থতার জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী নিজে। আসলে দেশের অভ্যন্তরে কোনও স্তরে সমাধানের রাস্তা দেখাতে পারেনি বিজেপি। কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, জীবনের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রক্ষা— কোনওটাতেই সফল নয়। সেই কারণে মানুষের মনটাকে, দৃষ্টিটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়। সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করাটা প্রধান অস্ত্র। ইংরেজরা যেটা শিখিয়েছে। বিজেপি তার পাঠ নিয়েছে ভালভাবে। তাই তাজমহল, কুতুবমিনার, মথুরা ও জ্ঞানব্যাপীর পর প্রিয় পয়গম্বরকে কালিমালিপ্ত করার কুৎসিত খেলায় মত্ত হয়েছেন তাঁরা। বিজেপির দুষ্কর্মের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাবে দেশের অবস্থা কী হতে পারে সে সম্পর্কে বিজেপির ধারণা নেই।
আরও পড়ুন-সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে আসছে নয়া আইন
এই লেখার প্রথমেই বাংলার সম্প্রীতি ও ভালবাসার চিত্রর কথা বলেছি। কিন্তু কোনও কোনও সময় তাতে যে চিড় ধরে না তা নয়। ধরে। এই ঘটনাতে অতি সামান্য হলেও তা হয়েছিল। কয়েকটি জায়গায় পরিস্থিতি খারাপ হয়, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়। প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। তিনি সাধারণ মানুষকে ধৈর্য ধরে প্রশাসনকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিলেন। মানুষ সে-ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এটাই এই রাজ্যে বড় শক্তি।
১২ জুন মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলায় গেলাম একটা ঐক্য সম্মেলনে। দেখলাম মৌলভি মওলানা ইমামরা আছেন। আছেন রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ, মন্দিরের পুরোহিত ও চার্চের পাদ্রি সাহেবরা। আর আছেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ। সবাই একবাক্যে ঐক্য সম্প্রীতি ও ভালবাসার কথা বলছেন। বলছেন প্রিয় পয়গম্বর(স.)-র সেই মহান উক্তি— ‘রাস্তায় পাথর থাকলে তা সরিয়ে দাও, না হলে পথচারীদের কষ্ট হতে পারে।’
এই মহান সহিষ্ণুতার পাঠটাই এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।