আগে কখনও শুনিনি। মনেও হয়নি কখনও একবারের জন্যও। ইদানীং শুনছি। শুনছি মূলত মুখবই-বিশ্ববিদ্যালয় আর হোয়াটসঅ্যাপ পাঠশালার পড়ুয়াদের কাছ থেকে। শুনছি, তাই মনেও হচ্ছে। আর শুধু যে আমার মনে হচ্ছে, তা নয়। আমার মতো গড়পড়তা ছাপোষা প্রায় প্রত্যেক বঙ্গজরই মনে হচ্ছে।
আরও পড়ুন-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চাঁদের উলটো পিঠ
মনে হচ্ছে এবং কথাটা বিশ্বাস করতেও শুরু করেছি।
ক্রমশ আমরা স্থির নিশ্চয় হচ্ছি, মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক নেই।
সত্যিই তো! একটা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান, অপরটি আনন্দ অনুষ্ঠান! শোকের সঙ্গে খুশির যোগাযোগ থাকবে কেমন করে?
এই বোধ থেকেই আমরা ভাবতে শুরু করেছি, পুরো ব্যাপারটার মধ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের একটা বড় রকমের কারিকুরি আছে। ওই যে মহালয়ার সকালে উদাত্তকণ্ঠে সুর করে টেনে টেনে চণ্ডীপাঠ, ওই যে দরাজ গলায় উচ্চারণ ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা’, তাতেই পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধের তিথি জুড়ে গিয়েছে পূজা অনুষ্ঠানের আনন্দলহরীতে।
আরও পড়ুন-ও নদী রে
বাঙালি যখনই বেতারে শুনেছে, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো যে ভুবন’, তখনই সে শারদীয়া দুর্গাপুজোর ‘আনন্দযজ্ঞে’ নিজেই নিজের ‘মধুর আমন্ত্রণ’ গ্রহণ করে নিয়ে মহালয়াকে অন্বিত করেছে মহামায়ার আবাহনের সঙ্গে।
‘জাগো। জাগো, জাগো মা’ বলতে বলতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে আপামর বাঙালি ঘুমচোখ খুলে দেবীবন্দনার প্রস্তুতিপর্বে শামিল হয়েছে পিতৃশ্রাদ্ধের জন্য নির্দিষ্ট তিথিতে। স্নান শেষে জলে, শ্রেয়তঃ বহমান নদীতে, কোমর পর্যন্ত অনাবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে কর-অঞ্জলিতে জল তুলে সূর্যের দিকে মুখ করে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে মন্ত্র উচ্চারণ করার পর হাতের জলমুঠি খুলে নদীতে বা পুকুরে ফেলে বাঙালি ফি-বছর মহালয়ার দিন মনে মনে তৈরি হয়েছে আসন্ন শারদোৎসবের জন্য।
আর তাতেই বুঝি মহালয়া শারদীয় দুর্গোৎসবের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
শোকের সঙ্গে আনন্দের, পিতৃপুরুষের সঙ্গে দৈবীশক্তির অর্চনার যোগাযোগ পাকাপোক্ত হয়েছে নাকি সে-কারণেই।
এমন অর্বাচীন ভাবনায় অভিনবত্ব থাকতে পারে, সত্যের দার্ঢ্য থাকে না।
আরও পড়ুন-সব ছোটদের জন্য
বিষয়টা উপেক্ষণীয়ও থাকে না, যখন উল্লিখিত ইউনিভার্সিটি কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ পাঠসত্রের ছাত্রছাত্রী এবং পোড়োদের সঙ্গে সমাজে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত বিদ্বজ্জনেরাও ভেবে না-ভেবে জানিয়ে দেন, মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক নেই।
কিন্তু ভারতীয় সমাজজীবনের পরাণকথা পুরাণ অন্য কথা বলছে। সেখানে, দেবীর আবাহন ও বোধনের সঙ্গে মহালয়ার তিথিগতভাবে যোগ সুস্পষ্ট। তাতে সন্দিহান হওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
সনাতন ধর্মের প্রাচীনতম শাস্ত্রগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হল মার্কণ্ডেয় পুরাণ। এই পুরাণগ্রন্থের সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় অংশ হল ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ বা ‘দেবীমাহাত্ম্যম’। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১তম থেকে ৯৩তম— এই তেরোটি অধ্যায়ই চণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্য নামে পরিচিত। ভারতবিদ ওয়েন্ডি ডনিগারের মতে, পুরাণটি রচিত হয়েছিল ২৫০ খ্রিস্টাব্দে, তবে ‘চণ্ডী’র রচনাকাল আরও আড়াইশো-তিনশো বছর পর, ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। আবার কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নর্মদা নদীর তীরে মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচিত হয়েছিল।
এই পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য বা চণ্ডী বলে সুপরিচিত অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মহিষাসুর বধের কথা বর্ণিত হয়েছে। এখানকার ১২ ও ১৩ নম্বর শ্লোক জানাচ্ছে মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবকুল মিলিত হয়েছিলেন। সেখানেই তাঁদের শরীর থেকে নির্গত তেজোপুঞ্জ জমাট বেঁধে দেবীমূর্তির রূপ পরিগ্রহ করে।
আরও পড়ুন-ঝুলন গোস্বামীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবেগঘন ট্যুইট মুখ্যমন্ত্রীর
অতীব তেজসঃ কূটং জ্বলন্তমিব পর্বতম্। দদৃশুস্তে সুরাস্তত্র জ্বালাব্যাপ্তদিগন্তরম্। অতুলং তত্র তত্তেজঃ সর্বদেব শরীরজম্। একস্থং তদভূন্নারী ব্যাপ্তলোকত্রয়ং ত্বিষা।।
উদ্বোধন কার্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত স্বামী জগদীশ্বরানন্দ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র এই অংশটিতে পাদটীকায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, সু-উচ্চ হিমালয় পর্বতে মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে এই ঘটনাটি ঘটেছিল আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে। অর্থাৎ মহালয়ার ঠিক আগের দিন দেবী দুর্গা দেবতাদের শরীর থেকে নির্গত তেজোরাশ্মির একত্রীভূত রূপ হিসেবে আবির্ভূতা হন। এরপর শুক্ল পক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে মহর্ষি কাত্যায়ন দেবীর পুজো করেন। দশমীর দিন দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন।
মহালয়ার আগের দিন কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই দেবীর আর-এক নাম কাত্যায়নী। চণ্ডীর অন্তত তিনটি শ্লোকে (একাদশ অধ্যায়ের ২ ও ২৫ নম্বর শ্লোক এবং অষ্টম অধ্যায়ের ২৯ নম্বর শ্লোকে) দেবী দুর্গা কাত্যায়নী নামে উল্লিখিত হয়েছেন।
মেধা মুনির আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং পরিবার থেকে বিতাড়িত বৈশ্য সমাধি। মেধা মুনি তাঁদের শুনিয়েছিলেন দেবীর কাহিনি। লক্ষ্মীতন্ত্র জানাচ্ছে, এই মেধা মুনি আসলে পুরাণ-কথিত ঋষি বশিষ্ঠ।
আরও পড়ুন-নিউ গড়িয়া-রুবি মেট্রোর ট্রায়াল শুরু
চণ্ডীতে লেখা আছে, সেই মেধা মুনি বা ঋষি বশিষ্ঠ সুরথ ও সমাধিকে বলেছেন, শুম্ভ নামক অসুরকে বধের পর ইন্দ্র অগ্নি বরুণ প্রমুখ দেবতারা যে দেবীর স্তব করেছিলেন, যাঁর বন্দনাগান গেয়েছিলেন, তিনি ওই কাত্যায়নী। ‘কাত্যায়নীং তুষ্টুবুরিষ্টলম্ভাদ্ বিকাসিবক্তাস্তু বিকাসিতাশাঃ।’
এই গ্রন্থের নারায়ণীস্তুতি অংশে দেবীবন্দনায় বলা হচ্ছে ‘‘এতৎ তে বদনং সৌম্যং লোচনত্রয়-ভূষিতম্। পাতু নঃ সর্বভূতেভ্যঃ কাত্যায়নি নমো’স্তুতে।’’
হে দেবী কাত্যায়নী! আপনার ত্রিনয়নশোভিত সৌম্যবদন আমাদের সবরকম ভৌতিক বিকার ও সর্বভূতের উপদ্রব থেকে রক্ষা করুক। হে নারায়ণী! আপনাকে প্রণাম।
এই কাত্যায়িনীরূপা দেবী দুর্গার আবির্ভাব তিথি মহালয়ার ঠিক আগের দিন। মহালয়া প্রতি বছর আশ্বিন মাসের প্রথম অমাবস্যায় পালিত হয়। ঠিক তার আগের দিন কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবীর আবির্ভাব অসুরনিধন সুসম্পন্ন করার জন্য। মহালয়ার ভোরই প্রথম ভোর যখন দেবতাদের তেজঃপু়ঞ্জ থেকে নির্মিত দেবীমূর্তি প্রথম সূর্যস্নাত হলেন।
আরও পড়ুন-গাজিয়াবাদ থেকে গ্রেফতার আমির
সুতরাং, হোয়াটসঅ্যাপ পাঠশালার পড়ুয়া হোন বা ফেসবুক-বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোজ্ঞ শিক্ষার্থী কিংবা বঙ্গলোকের বিদ্বজ্জন— যে যা-ই বলুন না কেন, শাস্ত্রসূত্রে তিথি বিচারে মহালয়া দেবীপূজার বৃত্তে, দুর্গাপুজো পালনের বেষ্টনীতে অঙ্গীভূত। এটা অস্বীকার করার জো নেই।
এ-সব তো পুরাণকথা। লোকায়ত জীবনের পরানকথাতেও মহালয়া পালন ও মহামায়ার পূজন, এই দুইয়ের অন্বয়ের সংকেত।
আলয় যেদিন মহঃ বা তেজোপ্রভায় ভরে যায়, সেই দিনই মহালয়া। ‘মহ’ শব্দের অর্থ ‘উৎসব’ বা ‘যজ্ঞানুষ্ঠান’ যেমন হয়, তেমনই ঋগ্বেদের ২.১৬.২ নম্বর সূক্তের কথা বিবেচনা করলে বোঝা যায় ‘মহঃ’র অর্থ তেজ। স্মর্তব্য, দেবতাদের তেজপুঞ্জ জমাট বেঁধে দেবীরূপ পরিগ্রহ করেছেন আগের দিনই। সেই তাৎপর্যে মহালয়ার সঙ্গে স্রেফ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নয়, তার সঙ্গে তেজোরাশি ও উৎসবের যোগ রয়েছে। পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর ‘পূজা পার্বণের উৎসকথা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘‘আভিধানিক বিচারে এই শব্দের (‘মহালয়া’ শব্দটির) বয়স কিন্তু খুব বেশি নয়।”
আরও পড়ুন-সুবিধাবাদী রাজনীতি মিঠুনের
হতে পারে, হতেই পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে এই বিশেষ দিনটিতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করার রীতি স্মরণাতীত কাল ধরে প্রচলিত। পিতৃপুরুষের স্মরণ- উৎসবের আধার হল এই তিথি। প্রচলিত লৌকিক সংস্কার অনুযায়ী, ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে আশ্বিনের কৃষ্ণা অমাবস্যা অবধি পিতৃপুরুষের আত্মারা প্রেতলোক থেকে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। নিজেদের ছেড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের মায়ার টানেই তাঁদের এই ফিরে আসা। মহালয়ায় তাঁদের সকলের আবির্ভাব সম্পূর্ণ হয় বলেই ওই দিনটিতে গৃহে আনন্দ-উৎসব পালনের বিধি আছে। তর্পণের মাধ্যমে ওইদিন তাঁদের পরিতৃপ্ত করার আয়োজন এ-জন্যই।
এখন প্রশ্ন হল, প্রেতপুজো বা মৃতদের ফিরে আসার কথাটিকে বিশ্বাস করা, এটা মানব সভ্যতায় নতুন কিছু নয়। একদা এই পৃথিবীতে বাস করত নিয়ানডার্টল মানুষ। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে এই গ্রহে আগমন ঘটে এক উন্নততর মানব প্রজাতির। নাম ক্রো-ম্যানীয়ঁ। তাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ানডার্টলদের অবলুপ্তি নিশ্চিত হয়। সে যা-ই হোক, এই নিয়ানডার্টল মানুষদের ভেতরেও মৃতকে সমাধিস্থ করার সময় কিছু রীতিনীতি পালনের প্রথা ছিল। প্রয়াত ব্যক্তির পুনরাগমন অসম্ভব নয়, এই বিশ্বাসের বশেই নিয়ানডার্টলরা ওইসব রীতি মেনে চলত।
আবার এটিও প্রায় সর্বজ্ঞাত বিষয়, মিশরীয় ফারাওদের আত্মা যাতে কোনওভাবেই মর্ত্যে ফিরে এসে কষ্ট না পায়, সেজন্য পিরামিডে যাবতীয় ব্যবস্থা থাকত।
আরও পড়ুন-দুই শিশুকে বিক্রি করতে এসে শ্রীঘরে ঠাঁই বাবার
এ-সবই একপ্রকার তর্পণ। শ্রাদ্ধের সময় বা মহালয়ার দিন শ্রদ্ধা সহকারে যে অন্নজল নিবেদন করা হয়, তারই রকমফের।
অর্থাৎ, মহালয়ার আচারবিধিতে নতুনত্ব কিছু নেই। যুগে যুগে নানা কৌম গোষ্ঠীর মধ্যে পিতৃপুরুষের আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি অর্জন করেছে। মহালয়াও সেই ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা একটা পার্বণ।
তবে, মহালয়ার তাৎপর্য বা বিশেষত্ব অন্যত্র। মহালয়া এদেশে আসে সেই সময়ে যে-সময় মাঠ থাকে ফসলভরা। উত্তরপুরুষরা আনন্দে আছে, স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে, এটা দেখলে পূর্বপুরুষরা শান্তি পাবেন, উৎফুল্ল হবেন, এই প্রত্যয় নিয়েই বছরের এই সময়টায় তাঁদের ডেকে আনা।
ফসল যখন মাঠে, তখন ফসল ফলাল যে শক্তিদ্বয়, সেই রোদ আর জলের অর্চনাই তর্পণের আচারে প্রতিভাসিত। সেজন্যই কোমর পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে সূর্যের উদ্দেশে জলের অর্ঘ্য নিবেদন হল মহালয়ার দিন তর্পণের আচার। জল আর তাপ চিরকালীন মাতৃ ও পিতৃশক্তির প্রতীক। সেজন্যই তাদের সমন্বয়ে শ্রদ্ধা অর্পণের সার্থকতা সূচিত হয়। মহালয়ায় পিতৃপুরুষের আত্মাকে কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য দেওয়া হয় তর্পণের মাধ্যমে। এভাবেই সেদিন পূজিত হন সূর্য ও নদী, উত্তাপ ও জল। তাতে মিশে থাকে উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্মধারা, লেপ্টে থাকে অশুভ প্রেত তাড়ানোর সংস্কার। এসব মিলেমিশে জড়িয়েমড়িয়ে মহালয়ায় পিতৃতর্পণের আচার অনুষ্ঠান।
একটু গভীরতর বিশ্লেষণে ফুটে ওঠে আর একটা বিষয়। উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্মাচরণ এবং অশুভ শক্তির বিতাড়ন, দুটোই দুর্গাপুজোর ভরকেন্দ্রে বিরাজমান।
আরও পড়ুন-রানি ভবানীর আমলের চতুর্ভুজা পূজিতা ছিন্নমস্তা রূপে
প্রাথমিক ভাবে দুর্গাপুজো হত বসন্তকালে। শীতে ফুরলে আদিম মানুষ নতুন করে খাবার সংগ্রহ করত, বের হত শিকার অভিযানে। সেই অভ্যাসকে অবলম্বন করেই দুর্গাপুজোর ধর্মধারা গড়ে উঠেছে। আদিতে দুর্গা ছিলেন শস্যদাত্রী, শাকম্ভরী। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ অনুসারে যিনি দুর্গা তিনিই শাকম্ভরী। ‘শাকম্ভরী শতাক্ষী সা সৈব দুর্গা প্রকীর্তিতা’। তাঁর হাতে থাকে খিদে, তেষ্টা, জরা ও মৃত্যুনাশক শাক-সবজির ফলমূল পাতা। ‘পুষ্পপল্লবমূলাদি–ফলাঢ্যং শাকসঞ্চয়ম্। অক্ষয়্যমশ্নুতে শীঘ্রমন্নপানামৃতং ফলম্।।’
এইভাবে শস্যকামনা দুর্গাপুজোয় মিশে আছে। মিশে আছে বলেই আরণ্যক উৎপাদন ব্যবস্থা স্মার্ত-ব্রাহ্মণ্য সমাজবিধানের পথ বেয়ে দুর্গাপুজোর সময় নবপত্রিকা-কেন্দ্রিক ভাবনায় স্থিত হয়। সপ্তমীর সকালে যে-নবপত্রিকা স্নান দিয়ে পুজো শুরু হয়, সেই নবপত্রিকার এক-একটি কল্পিত এক-একজন দেবী। যেমন, কলায় ব্রহ্মাণী, কচুতে কালী, হলুদে দুর্গা, জয়ন্তীতে কার্তিকী, বেলে শিবা, ডালিমে রক্তদন্তিকা, অশোকে শোকরহিতা, মানকচুতে চামুণ্ডা আর ধানে লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেন। এই শস্য-বৃক্ষের অনুষঙ্গে দেবীপুজোর আভাসই মহালয়ার তর্পণে, রোদ আর জলের পুজোয়।
আরও পড়ুন-সুরুল রাজবাড়ির পুজো আজও গরিমায় উজ্জ্বল
দুর্গাপুজোর এই চরিত্রই মহালয়াকে শারদীয় মহোৎসবের বলয়ে টেনে এনেছে। দুর্গার বোধন মানেই বৃক্ষের জাগরণ, দুর্গার পূজন মানেই শস্যের ফলন। সেই ফসল ফলানোর প্রহরেই প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষদের আগমন।
এই তিথি পালনে তাই শ্রদ্ধা আছে, শোক নেই।
আনন্দময়ীর উদ্বোধনে নিরন্তর আনন্দময়তা।
মা যখন ঘরে আসছেন তখনই গোলায় ধান উঠেছে, তখনই সারা বছর খিদে মেটানোর নিশ্চয়তা জাগছে। আর তার শুরুতে প্রেতলোক থেকে ডেকে নিচ্ছি তাঁদের যাঁরা আমাদের প্রিয়জন অথচ আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
এই অনুভবেই একাকার হয়ে যায় মহালয়া আর দেবীপক্ষের সূচনা।
এই বিশ্বাসেই মহালয়া বাদ দিয়ে দুর্গাপুজো কল্পিত হতে পারে না।
মহালয়ার শাস্ত্রবিহিত সংস্কারেই রয়েছে উর্বরতাকেন্দ্রিক কাল্টের অনুষঙ্গ। শস্যদায়িনী দেবীর পুজো।
যিনি শস্যদায়িনী তিনিই বিবর্তিতা হয়ে মহিষাসুরমর্দিনী।
আরও পড়ুন-মেসির জোড়া গোল, জিতল আর্জেন্টিনা
মহালয়া তাই গভীরতর বিচারে তাঁরই বোধন, তাঁর অর্চনারই উদ্বোধন।
এইজন্যই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে শারদোৎসব তার সূত্রপাত মহালয়া তিথি থেকেই ধরা হয়ে থাকে। এতে শাস্ত্রবিরোধী কিছু নেই। লোকাচারের বিপ্রতীপেও কোনও অবস্থানবিন্দু রচনার সুযোগ নেই।
সুতরাং শুভ শারদোৎসবের মতো শুভ মহালয়া বলা যেতেই পারে।
বলা ভাল, তেমনটাই বলা উচিতও।
সুতরাং, হোয়াটসঅ্যাপ পাঠশালার পড়ুয়া হোন বা ফেসবুক-বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোজ্ঞ শিক্ষার্থী কিংবা বঙ্গলোকের বিদ্বজ্জন— যে যা-ই বলুন না কেন, শাস্ত্রসূত্রে তিথি বিচারে মহালয়া দেবীপূজার বৃত্তে, দুর্গাপুজো পালনের বেষ্টনীতে অঙ্গীভূত। এটা অস্বীকার করার জো নেই।
এ-সব তো পুরাণকথা। লোকায়ত জীবনের পরানকথাতেও মহালয়া পালন ও মহামায়ার পূজন, এই দুইয়ের অন্বয়ের সংকেত।
আলয় যেদিন মহঃ বা তেজোপ্রভায় ভরে যায়, সেই দিনই মহালয়া। ‘মহ’ শব্দের অর্থ ‘উৎসব’ বা ‘যজ্ঞানুষ্ঠান’ যেমন হয়, তেমনই ঋগ্বেদের ২.১৬.২ নম্বর সূক্তের কথা বিবেচনা করলে বোঝা যায় ‘মহঃ’র অর্থ তেজ। স্মর্তব্য, দেবতাদের তেজপুঞ্জ জমাট বেঁধে দেবীরূপ পরিগ্রহ করেছেন আগের দিনই। সেই তাৎপর্যে মহালয়ার সঙ্গে স্রেফ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নয়, তার সঙ্গে তেজোরাশি ও উৎসবের যোগ রয়েছে। পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর ‘পূজা পার্বণের উৎসকথা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘‘আভিধানিক বিচারে এই শব্দের (‘মহালয়া’ শব্দটির) বয়স কিন্তু খুব বেশি নয়।”
আরও পড়ুন-নেতাদের কথা অমান্য কুর্মিদের, বাতিল ২৫২ ট্রেন
হতে পারে, হতেই পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে এই বিশেষ দিনটিতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করার রীতি স্মরণাতীত কাল ধরে প্রচলিত। পিতৃপুরুষের স্মরণ-উৎসবের আধার হল এই তিথি। প্রচলিত লৌকিক সংস্কার অনুযায়ী, ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে আশ্বিনের কৃষ্ণা অমাবস্যা অবধি পিতৃপুরুষের আত্মারা প্রেতলোক থেকে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। নিজেদের ছেড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের মায়ার টানেই তাঁদের এই ফিরে আসা। মহালয়ায় তাঁদের সকলের আবির্ভাব সম্পূর্ণ হয় বলেই ওই দিনটিতে গৃহে আনন্দ-উৎসব পালনের বিধি আছে। তর্পণের মাধ্যমে ওইদিন তাঁদের পরিতৃপ্ত করার আয়োজন এ-জন্যই।
এখন প্রশ্ন হল, প্রেতপুজো বা মৃতদের ফিরে আসার কথাটিকে বিশ্বাস করা, এটা মানব সভ্যতায় নতুন কিছু নয়। একদা এই পৃথিবীতে বাস করত নিয়ানডার্টল মানুষ। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে এই গ্রহে আগমন ঘটে এক উন্নততর মানব প্রজাতির। নাম ক্রো-ম্যানীয়ঁ। তাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ানডার্টলদের অবলুপ্তি নিশ্চিত হয়। সে যা-ই হোক, এই নিয়ানডার্টল মানুষদের ভেতরেও মৃতকে সমাধিস্থ করার সময় কিছু রীতিনীতি পালনের প্রথা ছিল। প্রয়াত ব্যক্তির পুনরাগমন অসম্ভব নয়, এই বিশ্বাসের বশেই নিয়ানডার্টলরা ওইসব রীতি মেনে চলত।
আবার এটিও প্রায় সর্বজ্ঞাত বিষয়, মিশরীয় ফারাওদের আত্মা যাতে কোনওভাবেই মর্ত্যে ফিরে এসে কষ্ট না পায়, সেজন্য পিরামিডে যাবতীয় ব্যবস্থা থাকত।
আরও পড়ুন-চোখের জলে বিদায় ফেডেরারের
এ-সবই একপ্রকার তর্পণ। শ্রাদ্ধের সময় বা মহালয়ার দিন শ্রদ্ধা সহকারে যে অন্নজল নিবেদন করা হয়, তারই রকমফের।
অর্থাৎ, মহালয়ার আচারবিধিতে নতুনত্ব কিছু নেই। যুগে যুগে নানা কৌম গোষ্ঠীর মধ্যে পিতৃপুরুষের আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি অর্জন করেছে। মহালয়াও সেই ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা একটা পার্বণ।
তবে, মহালয়ার তাৎপর্য বা বিশেষত্ব অন্যত্র। মহালয়া এদেশে আসে সেই সময়ে যে-সময় মাঠ থাকে ফসলভরা। উত্তরপুরুষরা আনন্দে আছে, স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে, এটা দেখলে পূর্বপুরুষরা শান্তি পাবেন, উৎফুল্ল হবেন, এই প্রত্যয় নিয়েই বছরের এই সময়টায় তাঁদের ডেকে আনা।
ফসল যখন মাঠে, তখন ফসল ফলাল যে শক্তিদ্বয়, সেই রোদ আর জলের অর্চনাই তর্পণের আচারে প্রতিভাসিত। সেজন্যই কোমর পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে সূর্যের উদ্দেশে জলের অর্ঘ্য নিবেদন হল মহালয়ার দিন তর্পণের আচার। জল আর তাপ চিরকালীন মাতৃ ও পিতৃশক্তির প্রতীক। সেজন্যই তাদের সমন্বয়ে শ্রদ্ধা অর্পণের সার্থকতা সূচিত হয়। মহালয়ায় পিতৃপুরুষের আত্মাকে কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য দেওয়া হয় তর্পণের মাধ্যমে। এভাবেই সেদিন পূজিত হন সূর্য ও নদী, উত্তাপ ও জল। তাতে মিশে থাকে উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্মধারা, লেপ্টে থাকে অশুভ প্রেত তাড়ানোর সংস্কার। এসব মিলেমিশে জড়িয়েমড়িয়ে মহালয়ায় পিতৃতর্পণের আচার অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন-সময়ের অপেক্ষা, আগামিকাল রাজ্যজুড়ে ২০০টিরও বেশি পুজোর ভার্চুয়াল উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী
একটু গভীরতর বিশ্লেষণে ফুটে ওঠে আর একটা বিষয়। উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্মাচরণ এবং অশুভ শক্তির বিতাড়ন, দুটোই দুর্গাপুজোর ভরকেন্দ্রে বিরাজমান।
প্রাথমিক ভাবে দুর্গাপুজো হত বসন্তকালে। শীতে ফুরলে আদিম মানুষ নতুন করে খাবার সংগ্রহ করত, বের হত শিকার অভিযানে। সেই অভ্যাসকে অবলম্বন করেই দুর্গাপুজোর ধর্মধারা গড়ে উঠেছে। আদিতে দুর্গা ছিলেন শস্যদাত্রী, শাকম্ভরী। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ অনুসারে যিনি দুর্গা তিনিই শাকম্ভরী। ‘শাকম্ভরী শতাক্ষী সা সৈব দুর্গা প্রকীর্তিতা’। তাঁর হাতে থাকে খিদে, তেষ্টা, জরা ও মৃত্যুনাশক শাক-সবজির ফলমূল পাতা। ‘পুষ্পপল্লবমূলাদি–ফলাঢ্যং শাকসঞ্চয়ম্। অক্ষয়্যমশ্নুতে শীঘ্রমন্নপানামৃতং ফলম্।।’
এইভাবে শস্যকামনা দুর্গাপুজোয় মিশে আছে। মিশে আছে বলেই আরণ্যক উৎপাদন ব্যবস্থা স্মার্ত-ব্রাহ্মণ্য সমাজবিধানের পথ বেয়ে দুর্গাপুজোর সময় নবপত্রিকা-কেন্দ্রিক ভাবনায় স্থিত হয়। সপ্তমীর সকালে যে-নবপত্রিকা স্নান দিয়ে পুজো শুরু হয়, সেই নবপত্রিকার এক-একটি কল্পিত এক-একজন দেবী। যেমন, কলায় ব্রহ্মাণী, কচুতে কালী, হলুদে দুর্গা, জয়ন্তীতে কার্তিকী, বেলে শিবা, ডালিমে রক্তদন্তিকা, অশোকে শোকরহিতা, মানকচুতে চামুণ্ডা আর ধানে লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেন। এই শস্য-বৃক্ষের অনুষঙ্গে দেবীপুজোর আভাসই মহালয়ার তর্পণে, রোদ আর জলের পুজোয়।
আরও পড়ুন-একলা চলো রে
দুর্গাপুজোর এই চরিত্রই মহালয়াকে শারদীয় মহোৎসবের বলয়ে টেনে এনেছে। দুর্গার বোধন মানেই বৃক্ষের জাগরণ, দুর্গার পূজন মানেই শস্যের ফলন। সেই ফসল ফলানোর প্রহরেই প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষদের আগমন।
এই তিথি পালনে তাই শ্রদ্ধা আছে, শোক নেই।
আনন্দময়ীর উদ্বোধনে নিরন্তর আনন্দময়তা।
মা যখন ঘরে আসছেন তখনই গোলায় ধান উঠেছে, তখনই সারা বছর খিদে মেটানোর নিশ্চয়তা জাগছে। আর তার শুরুতে প্রেতলোক থেকে ডেকে নিচ্ছি তাঁদের যাঁরা আমাদের প্রিয়জন অথচ আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
এই অনুভবেই একাকার হয়ে যায় মহালয়া আর দেবীপক্ষের সূচনা।
এই বিশ্বাসেই মহালয়া বাদ দিয়ে দুর্গাপুজো কল্পিত হতে পারে না।
মহালয়ার শাস্ত্রবিহিত সংস্কারেই রয়েছে উর্বরতাকেন্দ্রিক কাল্টের অনুষঙ্গ। শস্যদায়িনী দেবীর পুজো।
যিনি শস্যদায়িনী তিনিই বিবর্তিতা হয়ে মহিষাসুরমর্দিনী।
আরও পড়ুন-২৫০ টি পুজো কমিটির সহযোগিতায় দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ পুজো পরিক্রমা ও ব্রেইল ডিসপ্লে স্ট্যান্ড চালু
মহালয়া তাই গভীরতর বিচারে তাঁরই বোধন, তাঁর অর্চনারই উদ্বোধন।
এইজন্যই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে শারদোৎসব তার সূত্রপাত মহালয়া তিথি থেকেই ধরা হয়ে থাকে। এতে শাস্ত্রবিরোধী কিছু নেই। লোকাচারের বিপ্রতীপেও কোনও অবস্থানবিন্দু রচনার সুযোগ নেই।
সুতরাং শুভ শারদোৎসবের মতো শুভ মহালয়া বলা যেতেই পারে।
বলা ভাল, তেমনটাই বলা উচিতও।