হাঁপানি থাকলে আতশবাজি নয়

সামনেই কালীপুজো এবং দীপাবলি। আলোরই উৎসব। তা-ও পদে পদেই বিপদ। এ-বছর বাজিতে মানবে না বাঁধ। তাহলে হাঁপানি, সিওপিডি বা অন্যান্য রেসপিরেটরি ডিজিজে যাঁরা ভুগছেন তাঁদের কথা কে ভাববে! হাঁপানি রোগীর সংখ্যা এদেশে বেড়েই চলেছে, যার অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। হাঁপানির বিভিন্ন কারণ এবং তার ওপর বাজির ধোঁয়ার ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে বললেন স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিনের বিশিষ্ট ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজিস্ট চিকিৎসক শাম্ব সম্রাট সমাজদ্বার। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

হাঁপানি বুঝবেন কখন
কাশি, বুকে চাপ ভাব, সাঁই সাঁই আওয়াজ, শ্বাসকষ্ট। আর একটি বৈশিষ্ট্য হল হাঁপানি রোগীর দিনের কোনও একটা নির্দিষ্ট সময় অথবা যাতে তাঁর অ্যালার্জি রয়েছে সেটার কাছে গেলে বা সেই খাবার খেলে হঠাৎ করেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন অথচ দিনের অন্য সময় তাঁর মধ্যে অ্যাজমা বলে কিছু আছে বলেই মনে হয় না।
৩৮ শতাংশ অ্যালার্জিক রাইনাইটিস রোগীর অ্যাজমা থাকে। যে কারণে খুব হাঁচি হয়, নাক দিয়ে জল পড়ে, নাকের ভিতর চুলকায়, নাক বন্ধ থাকে। ৮৫ শতাংশ হাঁপানি রোগীরই এইসব ন্যাজাল সিম্পটম পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন-সাত মাসের শিশুকে কামড়ে খেল কুকুর

হাঁপানিকে উসকে দিতে হাউস ডাস্ট মাইট, ফুলের রেণু, মোলস, তামাক সেবন, ভাইরাল ইনফেকশন, ঠান্ডা লাগা, অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস এবং সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ ও বায়ুদূষণ দায়ী। দূষিত বায়ু হাঁপানি একলাফে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।
দু-ধরনের এয়ার পলিউটেন্ট রয়েছে যা সরাসরি অ্যাজমার উপর প্রভাব ফেলে। একটি হল ওজন গ্যাস বা স্মগ। অপরটি হল পার্টিকল পলিউশন। এগুলো বাতাসের ধুলোকণা এবং আতশবাজির ধোঁয়ার মধ্যে থাকে।
বাতাসের মধ্যে থাকা পলিউটেন্ট যেমন ওজোন গ্যাস গ্রীষ্মকালীন দুপুরে ক্ষতি করে। আর পার্টিকল পলিউশন যা শীতকালে বেশি। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাটে, ফ্যাক্টরির আশপাশে, স্টোভ জ্বালালে, রাস্তাঘাট তৈরির কাজের সময় পিচ গলানো হয়, বর্জ্যপদার্থ জ্বালালে এবং বাজি ফাটানোর পর বাড়ে।
বাজি পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ একলাফে অনেকটা বাড়ে এবং অ্যাজমা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রেসপিরেটরি ডিজিজও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
আতশবাজি থেকে দূরে

আরও পড়ুন-ধার নেওয়া টাকা শোধ করতে না পারায় বাইকের পিছনে বেঁধে নির্মম টান যুবককে

সারা বিশ্ব জুড়েই বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এই আতশবাজি বা ফায়ার ওয়ার্কস যার খুব খারাপ প্রভাব পড়ে বাতাসে। আগেই আলোচনায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন পার্টিকলস যা বায়ুকে দূষিত করে এবং তার কিছু ধাতব কম্পোনেন্ট এবং বিশেষ কিছু গ্যাস আতশবাজির কারণে বাতাসে অনেকটা বেড়ে যায়। এই সব কণা যখন নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে যাঁদের বিভিন্ন ধরনের রেসপিরেটরি ডিজিজ রয়েছে বিশেষ করে ব্রঙ্কিওল অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি, ব্রঙ্কিয়েকটেসিস রয়েছে বা লাং-এর কোনও সমস্যা রয়েছে তাঁরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হন। সেই জন্য এই সময় আতশবাজির ব্যবহার যেখানে হবে সেখান থেকে এই সব রোগীরা দূরে থাকলেই ভাল।
বাজি পোড়ানোর পর কিছু বিশেষ গ্যাস নির্গত হয় যেমন সালফার ডাই অক্সাইড,কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড সঙ্গে কিছু পার্টিকলস যেমন মেটাল সল্ট, অ্যালুমিনিয়াম ম্যাঙ্গানিজ এবং ক্যাডমিয়াম, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড সহ ভারী ধাতু যা বাতাসে দ্রুত মিশে যায়। এগুলো হাঁপানির রোগীদের খুব ক্ষতি করে। এগুলো খুব ভারী হয় বলে বাতাসে নিচের দিকে ভাসে। ফলে পরেরদিন এই ধরনের রোগী যাঁরা বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন তাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসনালিতে পৌঁছে যায় এবং আবার নতুন করে কাশির বাড়াবাড়ি, বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট এগুলো শুরু হয়। কোভিডের আগে লাং-এর যে ইলাস্টিসিটি ছিল সেটাও এখন অনেকের নেই। ফুসফুস এমনিতেই দুর্বল এরপর বাজির ধোঁয়া গোদের উপর বিষফোড়ার মতো হয়। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন-মৃত্যু নিয়ে দোষারোপ, উত্তরাখণ্ড প্রশাসনের তোপে ইউপি পুলিশ

ভারতে বিখ্যাত একটি স্টাডি হয়েছিল ইনস্টিটিউট অফ এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার রিসার্চ(আইডিএইএ সি এসআইসি) এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তাতে দেখা গিয়েছিল যে আতশবাজি জ্বালানোর পরে সেই ধোঁয়ার মধ্যে যে মেটালিক পার্টিকলসগুলো থাকে সেটি একটি বৃহত্তর রিস্ক ফ্যাক্টর অ্যাজমা রোগীর জন্য। শব্দবাজি হোক বা আলোর বাজি— দুই-ই বিষাক্ত। এর মধ্যে থাকে কার্বন, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম অক্সালেট, আয়রন ডাস্ট, অ্যালুমিনিয়াম, বেরিয়াম নাইট্রেট, ইত্যাদি বহু ক্ষতিকর কেমিক্যাল। বাজি পোড়ানোর পর এই সব কেমিক্যাল বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বাতাসে ধূলিকণা তৈরি হয়। তাই কালীপুজোর পর কয়েকদিন রাতের দিকে বাতাসে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব থাকে স্মগের মতো। এগুলোই দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। তাই ভারতবর্ষে দেখা গেছে দেওয়ালির ঠিক পরেই বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই করা, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমার ও সিওপিডির সমস্যা অনেকটা বেড়ে গেছে যা প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ। বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যেই এটা দেখা গেছে এবং বেশ কিছু ফ্যাটাল রিপোর্টও রয়েছে এর। তাই এই সময় বিভিন্ন রেসপিরেটরি ডিজিজ-এ যাঁরা ভুগছেন তাঁদের দিকে এই সময় বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

আরও পড়ুন-মালবাজারে বিরোধীদের ধুয়ে দিলেন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো

চিকিৎসা
দূষণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচান। যার মধ্যে অন্যতম একটি পন্থা হল বাজির থেকে দূরে থাকুন। যাঁদের অ্যাজমা নেই তাঁরা বাজি পোড়ানো থেকে বিরত থাকুন বা পরিবেশবান্ধব বাজি বা গ্রিন ক্র্যাকার্স জ্বালান কারণ আপনার আশপাশের অ্যাজমা বা সিওপিডির রোগীর ক্ষতি হতে পারে।
অ্যান্টি পলিউশন ফেস মাস্ক ব্যবহার করুন। বাইরে বেরোলে নাক মুখ ঢাকা দিয়ে বেরোবেন। যাতে ধোঁয়া কোনওভাবে শরীরের ভেতরে না যায়।
কালীপুজো বা দীপাবলির শব্দবাজি বা আলোর বাজিই যে শুধু হাঁপানিকে তরান্বিত করে এমন নয়। বছরের এই সময়টা সতর্কতা অবলম্বন করলে বেঁচে যেতে পারেন কিন্তু সারাবছর হাঁপানি থেকে মুক্ত হতে ধূমপান ত্যাগ করুন। এটা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। প্যাসিভ স্মোকিংও কিন্তু অ্যাজমার জন্য ক্ষতিকর। যিনি ধূমপান করছেন তাঁর হয়তো অ্যাজমা নেই কিন্তু পাশে অ্যাজমার রোগী থাকলে তাঁর ক্ষতি হবেই। ভীষণ ধূমপানে অভ্যস্ত যাঁরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মেরও অ্যাজমা হতে পারে।

আরও পড়ুন-শিল্পোৎপাদনে ধাক্কা, উৎসবের মরশুমে ফের বাড়ল বেকারত্বের হার

অ্যাজমা হল একটি প্রদাহজনিত সমস্যা। এই প্রদাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে কর্টিকো স্টেরয়েড বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের প্রয়োজন। ট্যাবলেটের মাধ্যমে যদি স্টেরয়েড দেওয়া হয় কোনও হাঁপানি রোগীকে। সেটি প্রথমে খাদ্যনালি থেকে রক্তে প্রবেশ করে তারপর সেখান থেকে ফুসফুসে যায়। সেই কারণে যতটা ওষুধ রোগী প্রথমে নেয় তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণে ফুসফুসে পৌঁছয়। তাই ডোজ বেশি লাগে কিন্তু ইনহেলারের মাধ্যমে ওষুধ সরাসরি লাং-এ পৌঁছয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম।

Latest article