মৃগী বা এপিলেপ্সি হল নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়বিক রোগ যাতে রোগীর কনভালশন বা খিঁচুনি হতে থাকে। এই রোগে চিকিৎসা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা একেবারেই নেই। এই দেশে মৃগীর রোগীর সংখ্যা এক কোটির অনেক বেশি। অথচ চিকিৎসা হয় মাত্র কুড়ি লক্ষ মানুষের।
মস্তিষ্কের কোষগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সচল রাখে। কোনও কারণে স্নায়ুতন্ত্রের সেইসব অংশের কার্যপ্রণালীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মৃগীরোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
আরও পড়ুন-পে-স্লিপ দেওয়া বাধ্যতামূলক হচ্ছে
রিস্ক ফ্যাক্টর
এই খিঁচুনি হতে থাকলে বেশকিছু রিস্ক রয়েছে।
এটা বারবার হতে থাকলে মানুষ জ্ঞান হারায়।
এর ফলে কিছু ক্ষেত্রে হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে রোগীর।
বারবার খিঁচুনি হলে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে পারে।
কারণ কী
এই রোগের কারণ জিনগত মিউটেশন কিছু ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করা হয় অর্থাৎ বংশগত কারণেও হতে পারে।
আবার মস্তিষ্কে যদি কোনও সেকেন্ডারি ডিজিজ থাকে যেমন, মস্তিষ্কে টিউমার বা সংক্রমণ।
মস্তিষ্কে মেনিনজাইটিস হলে।
ব্রেন ইনজুরি সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব।
জন্মগত ত্রুটি থাকলেও অনেক সময় এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগ হয়।
অধিক মাত্রায় জ্বর হলে তার প্রভাবে এপিলেপ্সি বা মৃগী হতে পারে। তবে জ্বরের থেকে আসা সব খিঁচুনি মৃগী নয়।
এপিলেপ্টিক পার্সোনালিটি
ঝগড়া করার প্রবণতা বেশি হয়।
স্বভাবে আত্মকেন্দ্রিকতা। গুটিয়ে থাকা।
একটু মেজাজ বেশি খিটখিটে হয়।
যেকোনও বিষয় বেশি চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করে চলা।
আরও পড়ুন-চার পুরসভায় আরও ডেপুটি মেয়র
মানসিক প্রতিক্রিয়া
দীর্ঘদিন যাবৎ মৃগী রোগে ভুগলে রোগীদের ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে তাদের স্বভাব, আচার আচরণে স্থায়ী কিছু পরিবর্তন আসে।
তাঁদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে।
ধীরে ধীরে বুদ্ধির জোর কমতে শুরু করে।
মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায় কারও কারও মধ্যে।
সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন-মিজোরামে পাথর খাদানে ধস নেমে মৃত নদিয়ার তিন যুবক, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
চিকিৎসা
মৃগী হলে আমরা খোঁজার চেষ্টা করি এটা প্রাইমারি এপিলেপ্সি না বংশগত কারণে হচ্ছে নাকি অন্য কোনও রোগের কারণে হচ্ছে।
কিছু মৃগী বা এপিলেপ্সি ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব কিন্তু কিছু মৃগী রোগ রয়েছে যেখানে দেখা যায় রোগী নিয়মিত হাই ডোজের চার-পাঁচটা ওষুধ খাচ্ছেন তা সত্ত্বেও খিঁচুনি কন্ট্রোল হচ্ছে না কিছুতেই। তাঁদের এপিলেপ্সি সার্জারি জরুরি।
এই পর্যায়ে তাঁদের কিছু ডায়াগনোসিস জরুরি পরবর্তী চিকিৎসার জন্য। যেমন লংটার্ম ভিডিও ইইজি। এটা চলতে থাকে একটানা চার-পাঁচদিন ধরে এবং এর সঙ্গেই যখন খিঁচুনি হচ্ছে তখন এই ইইজি খুঁজে বের করে যে মস্তিষ্কের কোন অংশ থেকে মৃগী রোগটার উৎপত্তি হচ্ছে।
এর পাশাপাশি এমআরআই স্ক্যান, স্পেক্ট স্ক্যান, পিইটি স্ক্যান এগুলো করলেও সহজেই দেখে নেওয়া যায় কোথা থেকে রোগের উৎপত্তি এবং তখন সেই উৎপত্তিস্থলকে অপারেশনের মাধ্যমে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে উৎপত্তিস্থল যদি মস্তিষ্কের এমন একটা অংশ হয় যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ এমন একটা অংশ যেটার খুব ভাইটাল ফাংশন রয়েছে যেমন আমাদের হাত-পা নাড়ানো, কথা বলা এই জায়গাগুলোকে কন্ট্রোল করছে তখন সেই অংশ কেটে বাদ দেওয়া যায় না। একে বলা হয় ইলোকোয়েন্ট এরিয়া এপিলেপ্টিজেনিক জোন। তখন বিভিন্ন অন্য পদ্ধতি রয়েছে যার দ্বারা চিকিৎসা করা হয়।
এগুলো ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন, ভেগাল নার্ভ স্টিমুলেশন। এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্ক কেটে বাদ দিতে হয় না। একটা যন্ত্র বসিয়ে দেওয়া হয়। পেসমেকারের মতো যন্ত্র বসিয়ে এপিলেপ্সি বা মৃগীকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়।
আরও পড়ুন-বোতল অ্যালার্ম, পালাচ্ছে হাতি
কিছু সার্জারি আছে এপিলেপটোজেনিক জোন বা যেখান থেকে রোগটার উৎপত্তি হচ্ছে যা কোনও ভাইটাল এরিয়াতে নেই, সেই জায়গাগুলোকে কেটে বাদ দিয়ে দিলে মৃগীরোগটা অনেকখানি কমে যায় বা জীবনযাত্রার মান অনেকটা উন্নত হয়ে উঠতে পারে।
বিভিন্ন প্রকার অপারেশন আছে। যেমন রিসেকশন, ডিসকানেকশন, মাল্টিপল সাবপায়াল অ্যাক্সিশন, টেম্পোরাল লবেক্টমি, হেমিসফেরোটমি, করপাস ক্যালজোটমি। কী ধরনের এপিলেপ্সি, কোথা থেকে এর উৎপত্তি, সূত্রপাত, এটার উপর নির্ভর করে আমাদের কী অপারেশন লাগবে সেটা ডিসাইড করা হয়।
কখনও কখনও দেখা গেছে মস্তিষ্কের কোনও একটা জায়গা থেকে নয়, অনেকগুলো জায়গা থেকে এপিলেপ্সির উৎপত্তি হয়েছে। সেই সব ক্ষেত্রে ভেগাল নার্ভ স্টিমুলেশন খুব কার্যকরী। এখনকার দিনে এই পদ্ধতি বিদেশে খুব চর্চার এবং প্রয়োগ করা হয় কিন্তু এদেশে সচেতনতা নেই। এখানে মৃগীর রোগী কড়া ডোজের চারটে-পাঁচটা ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে অথচ এটা কেউ বুঝতে পারছে না বা ওয়াকিবহাল নয় যে ভেগাল নার্ভ স্টিমুলেটর বসিয়ে দিলে ওর জীবনযাত্রা মানটা বেড়ে যাবে অনেকটা অর্থাৎ এপিলেপটিক অ্যাটাক অনেক কমে যাবে। সুতরাং এটা যাঁদের রয়েছে তাঁরা অযথা ভয় পান অপারেশনে। ভাবেন হয়তো বিপর্যয় কিছু ঘটবে। কিন্তু একটা ছোট্ট মেশিন বসালে মৃগী রোগী একটু স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেন। তাহলে সেটা করাই সবসময় ভাল।
আরও পড়ুন-আসানসোল উপপ্রধান বিলে সই রাজ্যপালের
প্রাথমিক চিকিৎসা
এপিলেপ্সি অ্যাটাক এলে সেই মুহূর্তে পাশে যিনি আছেন তাঁকেই তৎপর হতে হবে। রোগী দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে মাটিতে বা বিছানায় শুয়ে দিতে চেষ্টা করুন।
এই সময় রোগীকে চেপে ধরবেন না, রোগীর মুখে জোর করে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করবেন। জিভের উপর দাঁত পড়ে গেলেও জোরাজুরি করবেন না। হালকা করে মাথাটা ধরে রাখুন।
খিঁচুনি শেষ হলে পাশ ফিরিয়ে দিন আলতো করে। জামাকাপড় ঢিলে করে দিন। রোগী ঠিকমতো শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছে কি না সেটা খেয়াল রাখুন।
পাঁচমিনিটের অনেক বেশি এটি স্থায়ী হলে বা জ্ঞান ফিরলে যদি আবার পুনরায় হয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। অভিজ্ঞ নিউরোসার্জনের পরামর্শ নিন।