দ্রুত ওজন কমানোর এই মুহূর্তে একটাই সেরা উপায় আর তা হল উপবাস বা ফাস্টিং। কমেডি কুইন ভারতী সিং গর্ভাবস্থার আগে প্রায় ১৫ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছিলেন। আধুনিক প্রজন্মের কাছে ফাস্ট ফুড আর ফিস্ট যতটা প্রিয় ততটাই প্রিয় ফাস্টিং। ওজন বাড়ল মানেই উপোস সবচেয়ে দ্রুত কাজ করা একটি দাওয়াই। ডায়েটের একটা অংশ হিসেবে উপবাসকে রাখা হয়।
আরও পড়ুন-হাওড়া-কাণ্ডের জেরে কড়া পদক্ষেপ পুলিশের, ভাড়াটিয়ার তথ্য না দিলে ৬ মাস জেল
যুগ যতই পেরিয়ে আসুক— নতুনের যা কিছু তার শিকড় রয়েছে সেই পুরনোতেই। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতিনীতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ হল উপবাস বা ফাস্টিং। শ্রদ্ধা, ভক্তি, একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা প্রদর্শনের অন্যতম পন্থাই হল উপবাস। প্রতিটি ধর্মেই উপবাসের নিয়মরীতি রয়েছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা একমাস ধরে রোজা বা সিয়াম পালন করেন। সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে নির্জলা উপবাস। রোজায় তেরো থেকে চোদ্দো ঘণ্টার কঠোর উপবাসের রীতি রয়েছে। এই উপবাসটি খানিকটা ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিংয়ের মতোই। বিভিন্ন ধর্মেই উপবাস সম্পর্কে বলা হয়েছে উপোস হল নিজেকে কষ্ট দিয়ে আত্মশুদ্ধি। হিন্দু ধর্মে পুজোআচ্চা, বিয়ে— সবেতেই উপবাসের নিয়ম রয়েছে আবার প্রথাগত উপবাসও রয়েছে, যেমন অম্বুবাচী বা একাদশীর উপোস। জৈনদের পীতাম্বরা এবং শ্বেতাম্বরা জৈন উৎসবে আট থেকে দশদিনের উপবাসের নিয়ম রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মেও উপবাসের কথা শোনা যায়। উপবাস আসলে একধরনের প্ল্যান যার ভাল-মন্দ দুই-ই রয়েছে।
আরও পড়ুন-বেসরকারি হাতে যাচ্ছে রাজ্যের দুই বন্দর
ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিং
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি হল ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিং। এতে একটা সাইকেল অর্ডার মেনে উপোস করা হয়। সারাদিনের ৮ ঘণ্টা খাবার খেয়ে বাকি ১৬ ঘণ্টার উপবাস। অর্থাৎ আপনি যদি রাত ৯টায় ডিনার সারেন তবে তার ১৬ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় মিলটা নেবেন। এর মাঝে আর কিছুই খাওয়া যাবে না। রাতে এই ফাস্টিং প্রসেস শুরু করা ভাল কারণ ঘুমিয়ে পড়লে এমনিতেই অনেকটা সময় চলে যায়। ফলে অসুবিধে হয় না।
ভাল এবং মন্দ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সঠিক কায়দায় ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিং করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে, কোলেস্টেরল হ্রাস পায়, শরীর-মন বেশ চাঙ্গা থাকে। তবে দীর্ঘসময়ের উপবাসে ডিহাইড্রেশন, মুড সুইং, ব্লাডসুগার নেমে যাওয়া, বুক ধড়ফড় ইত্যাদিও হতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
আরও পড়ুন-স্কুলের জমিতে বাড়ি করেছেন, অভিযুক্ত বাম পঞ্চায়েত সদস্য
আরও পদ্ধতি
অনেকের ধারণা ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিং মানেই একটা নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া। তা নয় আরও পদ্ধতি আছে এই ডায়েটে। যেমন—
৫.২ অর্থাৎ সপ্তাহে পাঁচদিন খেয়ে বাকি দু’দিন না খাওয়া। একে ফাস্ট ডায়েটও বলা হয়।
ইট স্টপ ইট অর্থাৎ রাতে ডিনারের পর পরের দিন ডিনার পর্যন্ত ফাস্টিং।
একদিন অন্তর একদিন উপবাস।
সপ্তাহে একদিন ২৪ ঘণ্টা উপবাস।
আরও পড়ুন-ইডেনে পা রাখবেন কিং খান, জিততে মরিয়া নাইটরা
শর্ট টার্ম ফাস্টিং
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দীর্ঘসময়ের জন্য উপোসের চেয়ে কম সময়ের ব্যবধানে উপোস বা শর্ট টার্ম ফাস্টিং অনেক কার্যকর। এতে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমে ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা ঠিক থাকে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমে।
টাইম রেসট্রিকটেড ফিডিং
এই ধরনের উপবাসে ১০ ঘণ্টা যা খুশি খেয়ে নেওয়া এবং পরবর্তী ১২ ঘণ্টা কিছু না খাওয়া। এতে শরীরে ক্যালরি এবং ওজন দুই-ই কমে।
নির্জলা উপবাস বা ড্রাই ফাস্টিং
ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিং-এর যে কোনও পদ্ধতিই নির্জলা করা যায়। তবে নির্জলা উপবাসে শরীর ডি-হাইড্রেটেড হয়ে যায় এবং নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যদিও গবেষণা অনুযায়ী নির্জলা উপোস শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে এবং কোষকে ড্যামেজ হওয়া থেকে সুরক্ষিত রাখে। যে কোনও ধরনের প্রদাহ নাশ করে। ত্বকের বার্ধক্য আসে না। ধর্মীয় কারণে নির্জলা উপবাস করেন অনেকেই। এখন রমজান মাস। এই সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা কঠোর উপবাসের নিয়ম পালন করেন। সূর্যাস্তের আগে খাবার খান তাঁরা, যাকে বলে সেহরি তারপর গোটা দিন নির্জলা উপবাসে থেকে আবার সূর্য ডুবলে উপবাস ভঙ্গ করেন। তখন হয় ইফতার। বিশেষজ্ঞের মতে, রমজানের এই কঠোর নিয়ম শরীরের জন্য উপকারী।
আরও পড়ুন-দমদমের নিমতা ফতুল্লাপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হচ্ছে ৩০ শয্যার হাসপাতাল
রোজা বা উপবাসে উপকারী কিছু পরামর্শ ডায়েটিশিয়ান ফাতিমা ফিরদৌস-এর
ভারতে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টার হয় রোজার উপবাস। অনেকটা সময় নির্জলা এই উপবাসের ফলে শরীর জৈব বিষ বা টক্সিনমুক্ত হয়। রোজা ভাঙার পর হালকা সহজপাচ্য খাবার খাওয়া ভাল।
ইফতারে হাই ফাইবার লো ফ্যাট ডায়াবেটিক ডায়েট খুব উপকারী। খুব মেপে এবং স্বল্প পরিমাণে নানারকম ফল, ড্রাই ফ্রুট, কাঁচা ছোলা, ভেজা চিঁড়ে, স্যালাড, শরবত ইত্যাদি খেতে হবে। ভাজাভুজি, বিরিয়ানি, পোলাও, হালিম ইত্যাদি সপ্তাহে একদিন খেলেই ভাল।
যাঁদের ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার, হৃদরোগ বা অন্য কোনও রোগ রয়েছে তাঁদের অন্তত দু-তিন মাস আগে থেকে রোজার প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রথমেই একজন এন্ডোক্রিনোলজিস্টের পরামর্শ নিন। কারণ বিশেষজ্ঞের কথা অনুযায়ী চললে রোজার সময় কোনও অসুবিধে হবে না।
যাঁরা নিয়মিত ওষুধ খান তাঁরা এই সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধের সময় বদল করে নিতে পারেন। এতে কোনও ঝুঁকি নেই।
নিয়ম অনুযায়ী রোজার পর খেজুর খেতে হয়। এর ধর্মীয় কারণ তো আছেই পাশাপাশি রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও। এত ঘণ্টা উপোসের পর খেজুর খুব উপকারী। খেজুরে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, প্রোটিন ও আয়রন। এতে রয়েছে লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ফলে এটি ব্লাডসুগার হতে বা বাড়তে দেয় না। তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়।
আরও পড়ুন-‘একবছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে’, পরিদর্শন করে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
রোজা শেষ হলে আধগ্লাস জল খান। এরপর থেকে জল এবং জল জাতীয় পানীয় খেতে হবে অন্তত ৮ গ্লাস। যেমন লস্যি, ফ্রুট জুস, লেবুর রস, ডাবের বা গুড়ের শরবত।
ইফতারের ১ ঘণ্টা পর একটা বিশেষ নামাজ পড়তে হয় যার নাম তারাভি। ২ ঘণ্টা ধরে চলে এই নামাজ। নামাজ করার যে শারীরিক ভঙ্গিমাটি খুব বিজ্ঞানসম্মত, ফলে রোজার দিনগুলোয় একটানা ২ ঘণ্টা নামাজের সঙ্গে ব্যায়ামও হয়ে যায়। সেই সময়ের ফাঁকে ফাঁকে জল খাওয়া যায়। প্রয়োজনে এই নামাজের পর একটু ভারী কিছু খেতে পারেন।
সূর্যোদয়ের আগে সেহরির সময় দই বা দুধ যে কোনও একটা রাখুন। কিছু সিরিয়ালস রাখতে পারেন যেমন ভাত, ডাল, সবজি, ডিমসেদ্ধ, চিকেন, বিফ, মিট, খিচুড়ি— সবই খাওয়া যেতে পারে, তবে অল্প পরিমাণে।
আরও পড়ুন-তারকেশ্বর মন্দির পুজো দিতে এসে তীর্থযাত্রীর মৃত্যু
ক্রনিক রোগ রয়েছে এমন ব্যক্তির রোজা রাখা অপরিহার্য নয়, সেই সঙ্গে সন্তানসম্ভবা, বয়স্ক ব্যক্তি যাঁর শারীরিক সমস্যা রয়েছে তাঁদেরও রোজা রাখা অপরিহার্য নয়। যে শিশুর বয়ঃসন্ধি হয়নি এবং যিনি ভ্রমণ করছেন তাঁরাও রোজার নিয়মের বাইরে। যদি কেউ রোজা চলাকালীন অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তা হলে মাঝপথে রোজা বন্ধ করতে পারেন এবং পরে তিনি আবার রোজা করে নিতে পারেন।