কুন্দনন্দিনী
‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র কুন্দনন্দিনী। অনাথিনী, বিধবা, সুশীলা, সর্বগুণসম্পন্না। তার রূপ-লাবণ্যে মোহিত একাধিক পুরুষ। যেনতেনপ্রকারেণ কাছে পেতে চায়। সে প্রবল বুদ্ধিমতী। নানাভাবে খুঁজে নেয় নিজের সুখের উপকরণ। আধুনিক মানসিকতার বশবর্তী। নগেন্দ্রর মতো সংযমী পুরুষও তাকে দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। নগেন্দ্রর স্ত্রী সূর্যমুখী। জানতে পারে স্বামীর মনের চোরাস্রোতের কথা। বাধ্য হয়ে স্বামীর সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর বিবাহের বন্দোবস্ত করে বুকে পাথর চাপিয়ে। এই সময় আশ্চর্যরকমের নীরব ছিল কুন্দনন্দিনী। সে শুধু চিন্তা করেছিল নিজের সুখের কথা। সূর্যমুখীর জন্য একবারের জন্য তার মন কেঁদে ওঠেনি। মনে রাখেনি অনাথ অবস্থায় এই মহীয়সী নারীই আশ্রয় দিয়েছিল তাকে। এই কুন্দনন্দিনী চরম স্বার্থপর। বুঝে নিতে চায় শুধুমাত্র নিজেরটুকু। যদিও তাতে ফল ভাল হয় না। তার কারণেই গৃহত্যাগী হয় সূর্যমুখী। এরপর কুন্দনন্দিনীর কপালে জুটতে থাকে নগেন্দ্রর উপেক্ষা। পরিণতি হয় ভয়াবহ। সবমিলিয়ে ভালমন্দ দুই নিয়ে গড়ে উঠেছে কুন্দনন্দিনী চরিত্রটি। বঙ্কিমের কলমের আঁচড়ে হয়ে উঠেছে বড়বেশি জীবন্ত, রক্তমাংসের। রয়েছে কুয়াশা। আলো ফেললেও বোঝা মুশকিল। তার নাগাল পাওয়া কঠিন।
আরও পড়ুন-সেলুলয়েডের সুচিত্রা
রোহিণী
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের অন্যতম আলোচিত এবং আলোকিত নারীচরিত্র রোহিণী। চরিত্রটিতে আছে অন্ধকারও। বাল্যবিধবা সে। অসাধারণ সুন্দরী। সমস্ত কাজে পটু। তোয়াক্কা করে না সমাজের সংস্কার, রীতিনীতিকে। পরনে কালো পাড়ের ধুতি। হাতে চুড়ি। ঠোঁট রাঙাত পানে। প্রথমেই কৃষ্ণকান্তের সঙ্গে প্রতারণা। হরলালকে বিয়ে করার জন্য। যদিও এই ক্ষেত্রে রোহিণী নিজেই কিছুটা প্রতারিত। পরবর্তী সময়ে প্রেমে পড়ে কৃষ্ণকান্তের ভাইপো গোবিন্দলালের। রোহিণীর প্রতি গোবিন্দলালের অদ্ভুত মায়া জন্মে যায়। দয়াও। গোবিন্দলালের জন্য রোহিণী নিজের অপরাধ স্বীকার করে। গোবিন্দলালও করুণাবশত তাকে কৃষ্ণকান্তের শাস্তি থেকে মুক্ত করতে চায়। তখনই রোহিণী গোবিন্দলালকে নিজের মনের কথা জানায়। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। কারণ গোবিন্দলাল বিবাহিত। অপমানিত রোহিণী আত্মহননে উদ্যত হয়। তাতে আখেরে লাভ হয় তার। প্রেমে পড়ে যায় গোবিন্দলাল। একটা সময় দুজন একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। হাওয়ায় ছড়িয়ে যায় খবর। এই সময় বাড়তে থাকে রোহিণীর কুটিলতা। আরও জটিল হয়ে ওঠে সে। গোবিন্দলালের স্ত্রী ভ্রমরের সঙ্গে শুরু করে রেষারেষি। বাড়িয়ে দেয় তার মনোবেদনা। ভ্রমর পূর্ণিমার মতো। রোহিণী বিপরীত। হারিয়ে পায়, পেয়ে হারায়। বঙ্কিমচন্দ্র তাকে খল বা কুটিল চরিত্র হিসেবে রূপায়িত করেছেন, তবে এক ধরনের সহানুভূতির আশ্রয় নিয়ে। তার কুটিলতার পেছনে আছে বেশকিছু কারণ। হয়তো সে পরিস্থিতির শিকার। সাহিত্যসম্রাট এই নারীচরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। কুসংস্কার-মুক্ত এবং চূড়ান্ত বাস্তববাদী এই নারীকে ঘৃণা করতে চাইলেও পাঠক ঘৃণা করতে পারবে না।
আরও পড়ুন-আইপিএলে আজ ধোনি-রোহিত দ্বৈরথ
শৈবলিনী
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে আছে শৈবলিনী। তার মন আশ্চর্য রকমের আধুনিক। কখন কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, ভালই জানে। সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে প্রেমে পড়ে এক আত্মীয়ের। সম্পর্ক পরিণতি পাবে না জেনেও। প্রেমিক প্রতাপ তাকে নিয়ে নদীতে ডুবে মরতে যায়। কিন্তু শৈবলিনী উপেক্ষা করে মৃত্যুর কালোকে। বেছে নেয় জীবনের আলো। কারণ পৃথিবীর প্রতি তার গভীর ভালবাসা। প্রেমিক হয়ে যায় নেহাত তুচ্ছ। ঘটনাচক্রে তার প্রেমে পড়ে চন্দ্রশেখর। সে মহাপণ্ডিত। ডুবে থাকে পুঁথির পাতায়। বিয়ে হয় দুজনের। তবে চন্দ্রশেখর কোনও দিন পড়তে পারেনি শৈবলিনীর মন। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারে, ঘটে গেছে ছন্দপতন। এইসময় শৈবলিনীর বন্ধুত্ব হয় শ্বেতাঙ্গ যুবক লরেন্স ফস্টারের সঙ্গে। এই অস্থিরমতি যুবক শৈবলিনীর প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হয়। শৈবলিনী বোঝে। তার মধ্যে মিশে থাকে না বোঝার ভান। এইভাবে চলতে থাকে আলো-কালো অদ্ভুত এক খেলা। তাকে চাওয়া যতটা সহজ, পাওয়া ততটা সহজ নয়। বারবার ব্যর্থ হয়েছে চন্দ্রশেখর। অদৃশ্য প্রাচীর ভেদ করে ছুঁতে পারেনি এই নারীর হৃদয়। আসলে শৈবলিনী কিছুতেই সুখী হতে পারে না। হয়তো সে নিজেই সুখী হতে চায় না। কারণ সুখের ঘরের চাবি পেয়েও সে হেলায় হারায়। বঙ্কিম-সৃষ্ট এই নারীচরিত্র অতি আধুনিক তো বটেই, সেইসঙ্গে দুঃসাহসীও। বড় বেশি রহস্যময়ী। কিছুটা সর্বনাশী।
আরও পড়ুন-মুঘল ইতিহাস আর পড়ানো হবে না!
শ্রী
‘সীতারাম’ উপন্যাসের নারীচরিত্র শ্রী। ধর্মের ধ্বজাধারী রাজা সীতারামের স্ত্রী। শ্রীর বিরুদ্ধে যায় জ্যোতিষীর একটি নিদান। সে নাকি হতে পারে প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ। এই অপবাদ তাকে সংসার ত্যাগ করতে বাধ্য করে। বারবার সে ফিরে পেতে চায় নিজের অধিকার। কিন্তু ব্যর্থ হয়। সীতারাম তাকে কোনওভাবেই আপন করে নেয় না। যদিও একবার একটি যুদ্ধ চলাকালীন শ্রীর পূর্ণযুবতী অপরূপা সুন্দরী বীরাঙ্গনামূর্তি তাকে কামনাতুর করে তোলে। লাজলজ্জা ভুলে শ্রীকে দেয় ফিরে আসার প্রস্তাব। কিন্তু শ্রী বুঝতে পারে এই প্রস্তাব মোটেই সম্মানজনক নয়। আপেক্ষিক।
আরও পড়ুন-নববর্ষে কলকাতার বস্তি এলাকায় জ্বলবে সৌর আলো, উদ্যোগ পুরনিগমের
রূপমোহে আবিষ্ট হয়েই তাৎক্ষণিক এই সিদ্ধান্ত স্বামীর। মতিভ্রম বলা যেতে পারে। যেকোনও সময় ঘটে যেতে পারে মনের বদল। কারণ সীতারামের ঘরে তখন আরও দুই স্ত্রী। তাদের নিয়েই মত্ত রাজা। শ্রীর নিখুঁত উপেক্ষা হিংস্র করে তোলে সীতারামকে। ওঠে প্রবল ঢেউ। তবে নিজেকে আশ্চর্য রকমের স্থির রাখে শ্রী। যুক্তি-বুদ্ধির সোজা পথ ধরে এগোয় আগামীর পথে। জীবনে পায়নি নিজের প্রাপ্য অধিকার, সম্মান। তবু হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েনি। এই পরিণত মানসিকতা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। কিছু না পেয়েও সে হয়ে ওঠে পূর্ণ। হেরে গিয়েও ভীষণভাবে জয়ী। সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে শ্রী। বহু নারীর আদর্শ। বঙ্কিম তাকে রূপ দিয়েছেন নিজের মনের মতো করে।
আরও পড়ুন-গুগলের দ্বারস্থ তদন্তকারীরা
আয়েষা
‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য নারী-চরিত্র আয়েষা। শাসক কতলু খাঁয়ের কন্যা। অতি সুন্দরী। অহংকারী। সেইসঙ্গে দয়ালু। বন্দি বিধর্মী শত্রুর সেবা করতেও পিছ-পা হয় না। আয়েষার পুরুষ ওসমান। কতলু খাঁর সেনাপতি। ঘটনাক্রমে জগৎসিংহ এবং আয়েষা পরস্পরের প্রতি প্রবলভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সম্পর্ক রচিত হয় ধর্ম, সমাজ, সংসারের বিরুদ্ধে গিয়ে। আয়েষা জানে, জগৎসিংহের অপেক্ষায় রয়েছে প্রেয়সী তিলোত্তমা। তাই সে একটা সময় নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়। প্রিয় মানুষটির সুখের কথা চিন্তা করে বুকফাটা যন্ত্রণা চেপে তাকে তার প্রিয় নারীর হাতে তুলে দেয়। সমস্ত কিছুই ঘটে আয়েষার নিজের সিদ্ধান্তে। কোনওভাবেই অন্যের নির্দেশে নয়। কারণ সে এক স্বাধীনচেতা নারী। তার মধ্যে রয়েছে মানসিক দৃঢ়তা। তবু প্রিয় পুরুষকে তিলোত্তমার হাতে তুলে দেবার পর তার মাথায় আসে মৃত্যুচিন্তা। তবে শেষপর্যন্ত সেই পথে পা বাড়ায়নি। বিনষ্ট করেনি নিজের অস্তিত্বকে। আরও কিছু মানুষের জন্য তার জীবন, এই সত্য উপলব্ধি করে। মধ্যযুগীয় এই নারীর মধ্যে দিয়েই যেন ঘটেছে নারীর নবজাগরণ। অতি-আধুনিক চরিত্রটি বঙ্কিম উপন্যাসের সেরা নারীচরিত্রগুলির মধ্যে একটি।
আরও পড়ুন-দেশে ফের ঊর্ধমুখী কোভিড সংক্রমণ
কপালকুণ্ডলা
‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?’ নবকুমারের উদ্দেশ্যে এই আন্তরিক প্রশ্ন রেখেছিল কপালকুণ্ডলা। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নায়িকা। এই নারী পরোপকারী, বিশ্বাসী। তাকে দেখা যায় নিষ্ঠুর কপালিকের হাত থেকে নবকুমারকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে। নানা ঝুঁকি নিয়ে শেষমেশ সে সফল হয়। বেঁচে যায় নবকুমার। কপালকুণ্ডলা ধার্মিক। মা কালীর প্রতি তার অগাধ ভক্তি। পুজো দেয়। প্রণাম করে। ঘটনাক্রমে এই নারীর সঙ্গে বিয়ে হয় নবকুমারের। এরপর কপালকুণ্ডলার পতিভক্তি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। তবে ফেলে আসা সমুদ্র তীরবর্তী অরণ্যজীবন কিছুতেই ভুলতে পারে না। নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রবল সমস্যা হয়। দুলতে থাকে অতীত ও বর্তমানের দোলাচলে । আত্মসম্মানবোধসম্পন্না এই নারীর বিবাহকে মনে হয় দাসত্ব। একটা সময় অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয় তাকে ঘিরে। এই অবিশ্বাস, সন্দেহ আসে স্বামী নবকুমারের কাছ থেকে। কপালকুণ্ডলা বিশেষ প্রয়োজনে রাতে বাড়ির বাইরে বেরলে স্বামী তার সঙ্গে যেতে চায়। যদিও পরবর্তীতে নবকুমার নিজের ভুল বুঝতে পারে। অবশ্য তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আসলে বরাবর মনের দিক থেকে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল কপালকুণ্ডলা। অত্যন্ত অভিমানী সে। কিছুটা অ-সামাজিক। তাই হয়তো তার জীবনে ঘটে যায় ছন্দপতন। পরিণতি হয় করুণ। এই চরিত্রটি বঙ্কিমের অমর সৃষ্টি।
আরও পড়ুন-শ্মশান কেলেঙ্কারিতে রক্ষাকবচহীন সৌমেন্দু
দেবী চৌধুরানী
ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে ক’জন নারী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতমা দেবী চৌধুরানী। বঙ্কিমচন্দ্রের এই উপন্যাসের শুরু হয় এক ব্রাহ্মণ পিতৃহীন বিবাহিতা মেয়েকে সামনে রেখে। নাম ‘প্রফুল্ল’। বিয়ের পরেই শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, পেট চালানোর জন্য চুরি-ডাকাতি করতে। সে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যায়। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভবানী পাঠকের সঙ্গে হয় তার সাক্ষাৎ। এই ভবানী পাঠক নিজে ডাকাত সর্দার ছিলেন। ডাকাতি করলেও সন্ন্যাসীর মতো ছিল তাঁর জীবনযাপন। ধনীদের উপর লুটতরাজ চালিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে জিনিসপত্র বিলিয়ে দিতেন। ভবানী পাঠকের ছত্রছায়ায় নিজেকে তৈরি করে প্রফুল্ল। গণিত, দর্শন, বিজ্ঞান এবং কুস্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে। এই বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার মধ্যে দিয়ে প্রফুল্ল একসময় ডাকাতদের রানি হয়ে যায়। সারা বাংলায় তার পরিচয় হয় দেবী চৌধুরানী। সেই সময়ে অবিভক্ত বাংলার উত্তরাংশের ত্রাস হয়ে উঠেছিল এই নারী। তিনি কুয়াশার মতো রহস্যময়ী, অবিশ্বাস্য রকমের বুদ্ধিমতী। এইভাবে স্বামী-পরিত্যক্তা তথাকথিত সাধারণ এক মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি বুনেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। চরিত্রটি হয়ে উঠেছে আশ্চর্য রকমের জীবন্ত।
আরও পড়ুন-অভিযোগ, চাপ সৃষ্টি করছে ইডি
রজনী
‘রজনী’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রজনী। হতদরিদ্র, জন্মান্ধ, অবিবাহিতা কায়স্থ কন্যা। প্রতিদিন ফুল বিক্রি করত রামসদয় মিত্রের বাড়িতে। রামসদয়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী লবঙ্গলতা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। একদিন রামসদয়ের প্রথম পক্ষের পুত্র শচীন্দ্রনাথ রজনীর চক্ষু পরীক্ষা করে। শচীন্দ্রের হাতের ছোঁয়ায় এবং কথা শুনে মুগ্ধ হয় রজনী। কর্মচারীর পুত্র গোপাল বসুর সঙ্গে রজনীর বিয়ের বন্দোবস্ত করেন লবঙ্গ। বাধা দেয় গোপালের স্ত্রী চাঁপা। রজনীও অসম্মত ছিল এই বিয়েতে। কারণ শচীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরাগ। একদিন চাঁপার ভাই হীরালালের সঙ্গে পালিয়ে যায় রজনী। হীরালাল তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রজনী সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। অপমানিত হীরালাল তাকে ফেলে পালায়। জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ রজনী গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মৃত্যু এত সহজে আসে না। তার জীবনে আসে অমরনাথ। ঘটনাক্রমে জানা যায়, রামসদয় মিত্র রজনীর সম্পত্তি ভোগ করছেন। সেই সম্পত্তি উদ্ধার করে অমরনাথ। তার সঙ্গে রজনীর বিবাহ স্থির হয়। বাধা হয়ে দাঁড়ান লবঙ্গলতা। বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি শচীন্দ্রনাথকে আসরে নামান। সন্ন্যাসী হয়ে যায় অমরনাথ। সাতপাকে বাঁধা পড়ে রজনী ও শচীন্দ্রনাথ। একটা সময় দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় রজনী। বঙ্কিমচন্দ্রের এই নারী চরিত্রটি সারল্যে ভরপুর। নানা সময় হয়েছে পরিস্থিতির শিকার। কিছু ক্ষেত্রে তার নিজের সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পায়নি। কোনও কোনও সময় তাকে করুণার পাত্রী মনে হয়েছে। রজনী চরিত্রটি বড় বেশি পাঠকের মনের কাছাকাছি। যেন আমাদের চেনা কেউ। ঠিক পাশের বাড়ির মেয়ের মতো।
আরও পড়ুন-নববর্ষে রাজ্য জুড়ে তাপপ্রবাহের সতর্কতা
রাধারাণী
‘রাধারাণী’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাধারাণী। যখন তাকে প্রথম দেখা যায়, তখন সে মোটামুটি এগারো বছরের বালিকা। গিয়েছিল মাহেশে রথের মেলায়। তবে রথ দেখতে নয়। সেই শৌখিনতা তাকে মানায় না। আনন্দ, ফুর্তির সঙ্গে তার আড়ি। বাবা নেই। আছেন মা। পরিবারের অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। তবে একটা সময় স্বচ্ছলতা ছিল। অর্থাৎ সে বড়মানুষের মেয়ে। জ্ঞাতির সঙ্গে মোকদ্দমায় লড়ে তার মা সবকিছু হারিয়েছেন। অতি সাধারণ কুটিরে ঠাঁই নিয়ে শারীরিক পরিশ্রম করে মহিলা কোনওভাবে সংসার চালান। বিয়ে দিতে পারেননি মেয়ের। রাধারাণী রথের মেলায় গিয়েছিল বনফুলের মালা বেচতে। টাকা পেলে কিনবে অসুস্থ মায়ের ওষুধ। কিন্তু পরিস্থিতি সঙ্গ দেয় না। তুমুল বৃষ্টিতে ভেস্তে যায় মেলা। বিক্রি হয়নি মালা। অন্ধকারের মধ্যে তাই অসহায় বালিকা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পারে না কান্না চেপে রাখতে।
আরও পড়ুন-জনসংযোগ বাড়াতে নির্দেশ দিলেন নেত্রী
তখন তার আলাপ হয় এক সহৃদয় পুরুষের সঙ্গে। যে পরবর্তী সময়ে নিজের পরিচয় দেয় রুক্মিণীকুমার। কথায় কথায় রাধারাণী পুরুষটিকে তার বনফুলের মালার কথা জানায়। পুরুষ বুঝতে পারে মেয়েটি ভাল পরিবারের। অভাবের কারণে তার এই দশা। মনে মনে করুণা জন্মায় তার প্রতি। পুরুষটি বাড়ির ঠাকুরের জন্য রাধারাণীর মালা কিনতে চায়। বড় খুশি হয় রাধারাণী। হাতে চাঁদ পায়। মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আলো। পুরুষটি কিনে নেয় মালা। বেশি মূল্য দিয়েই। পয়সা নয়, টাকার বিনিময়ে। সেটা বাড়িতে ফিরে বুঝতে পারে রাধারাণী। সে চায় ক্রেতাকে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে। হতদরিদ্র পরিবার। বৃষ্টিদিনে ভিজে কাপড়ে দিন কাটাতে হয়। পরার জন্য নেই দ্বিতীয় কাপড়। সামর্থ নেই ঘরে আলো জ্বালানোর। তবু সে লোভী নয়। পাত্রী হতে চায় না অন্যের দয়াভিক্ষার। ঘটনাক্রমে রুক্মিণীকুমারের সঙ্গে পরে আবার দেখা হয়। রচিত হয় সম্পর্ক। ফিরে যায় কপাল। নির্লোভ মানসিকতা এবং অতিরিক্ত সারল্য রাধারাণী চরিত্রের প্রধান গুণ। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে সৃষ্টি করেছেন পরম যত্নে। পাঠকমনে এই নারীচরিত্রের রয়েছে পাকা আসন।