সেলুলয়েডের সুচিত্রা

একসময় যাঁর হাসি ঝড় তুলত লাখো হৃদয়ে। তিনি মিসেস সেন। রয়ে গেছেন আপামর বাঙালির অন্তর জুড়ে। সাফল্যের পিছনে ছোটেননি অথচ একটা সময় একাই বক্স অফিস দাপিয়েছেন। ৩৬ বছর ছিলেন নিভৃতচারিণী। তিনি বাঙালির মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

গোড়ায় গন্ডগোল
এমপি স্টুডিওটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। শিল্পীদের মাসমাইনে দিতেন তিনি। এখানকার স্টাফ বিভূতি লাহা অগ্রদূত গোষ্ঠীর প্রধান ও চিত্রগ্রাহকও বটে। তিনি এক সন্ধ্যায় মুরলীধরবাবুকে তাঁর অফিসে আশাপূর্ণা দেবীর ‘অগ্নিপরীক্ষা’ উপন্যাস পড়তে দিলেন। পড়ে তিনি মুগ্ধ। বিভূতি লাহাকে গল্পের চিত্রস্বত্ব কিনে চিত্রনাট্য তৈরি এবং শিল্পী নির্বাচনের কথা বললেন। বিভূতি লাহা ধাপে ধাপে সব কাজ সেরে মুরলীধর বাবুকে চিত্রনাট্য শোনালেন। তিনি মুগ্ধ হলেন। গোল বাধল শিল্পী নির্বাচন নিয়ে। বিভূতি লাহা নায়িকা তাপসীর বাবা, মা ও ঠাকুমার চরিত্রে যথাক্রমে কমল মিত্র, চন্দ্রাবতী দেবী, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়ের নাম বললেন।

আরও পড়ুন-আইপিএলে আজ ধোনি-রোহিত দ্বৈরথ

নায়ক কিরীটীর ঠাকুরদার চরিত্রে জহর গঙ্গোপাধ্যায়। এ-পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। তাল কাটল যখন নায়ক কিরীটীর চরিত্রে উত্তমকুমার এবং তাপসীর চরিত্রে সুচিত্রা সেনের নাম বললেন তখন। ঘোর আপত্তি জানালেন মুরলীধর : ‘উত্তমকুমার আমাদেরই স্টাফ। ওকে অনেকগুলো ছবিতে নায়কের চরিত্রে নিয়েছি। কিন্তু ওর পরিচয় ঘটে গিয়েছে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল হিসেবে আর সুচিত্রা সেন দেখতে সুন্দর ওই পর্যন্তই। নায়িকা হিসেবে চলবে না।’ প্রযোজক বললেন : ‘কিরীটীর চরিত্রে বিকাশ রায় ও তাপসীর চরিত্রে অনুভা গুপ্তকে নিন।’ এ-কথা কিছুতেই মানতে পারলেন না বিভূতি লাহা। তিনি উত্তম-সুচিত্রা ছাড়া ছবি করবেন না। তাঁর স্পষ্ট জবাব, ‘আপনি তবে অন্য পরিচালক দেখে নিন।’ বিভূতি লাহাকে চটাতে চাইলেন না মুরলীধর। কারণ তাঁর পরিচালনায় ‘বাবলা’ বিদেশের বাজারে প্রথম পুরস্কৃত বাংলা ছবি। অগত্যা সম্মতি দিলেন মুরলীধর। তবে তিনি একদিনের জন্যও শ্যুটিং চলাকালীন ফ্লোরে গেলেন না। ছবি রিলিজের আগে ফাইনাল প্রোজেকশন পর্যন্ত দেখলেন না। ১৯৫৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছবি মুক্তি পেল। অচিরেই এই ছবি হয়ে উঠল সুপার ডুপার হিট ছবি। ছবির শেষে উত্তম-সুচিত্রার নিবিড় আলিঙ্গনদৃশ্য চিরন্তন প্রেমের এক অপূর্ব অনুভূতি। পরবর্তীকালে এই আলিঙ্গনদৃশ্য যেন অপরিহার্য হয়ে পড়ল এই জুটির ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন-রাজস্থানের বিরুদ্ধে জয়ের খোঁজে দিল্লি

পাবনার মেয়ে রমা
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা জেলায় মামাবাড়িতে করুণাময় দাশগুপ্ত ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের কন্যা সুচিত্রার জন্ম হয়। ডাকনাম রমা। বিয়ে হয় দিবানাথ সেনের সঙ্গে। গোড়ায় চেয়েছিলেন গায়িকা হতে। সেইমতো পার্ক স্ট্রিটের এক স্টুডিওতে গানের অডিশন দিলেন। নির্বাচিত হলেন। সুচিত্রাকে তখন অভিনয়ের জন্য অডিশন দেওয়ানো হয়। বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্রবধূ তিনি। শ্বশুরমশাইয়ের সম্মতি পেতেই হবে নচেৎ উপায় নেই। প্রিয় পুত্রবধূকে দিলেন সম্মতি। তখন রমা কন্যাসন্তানের মা। পরবর্তীতে যিনি খ্যাতনামা অভিনেত্রী মুনমুন সেন। প্রথম অভিনীত ছবি ‘শেষ কোথায়’ মুক্তি পায়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘সাত নম্বর কয়েদি’ (১৯৫৩)। বিপরীতে নায়ক সমর রায়। এই ছবির সহকারী পরিচালক নীতীশ রায় তাঁর নতুন নাম দিলেন ‘সুচিত্রা’। এই নামেই তাঁর স্বীকৃতি। সে-বছরই মুক্তি পেল ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’। সেখানে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া। মুক্তি পেল উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম অভিনীত ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।

আরও পড়ুন-মুঘল ইতিহাস আর পড়ানো হবে না!

হিন্দি ছবিতেও অনবদ্য
বরেণ্য পরিচালক বিমল রায় প্রথম হিন্দি ছবিতে নিয়ে এলেন সুচিত্রাকে। ‘দেবদাস’ ছবিতে পার্বতী তিনি। দেবদাসের চরিত্রে দিলীপকুমার। চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় বৈজয়ন্তীমালা। দর্শকদের মুগ্ধ করলেন সুচিত্রা। পরের ছবি হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মুসাফির’। কাজ করলেন ‘চম্পাকলি’ ছবিতে। দেবানন্দের বিপরীতে করলেন রাজ খোসলা পরিচালিত ‘বোম্বাই কা বাবু’ এবং শঙ্কর মুখার্জি পরিচালিত ‘সারহদ’। ‘মমতা’ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে। বিপরীতে অশোককুমার, ধর্মেন্দ্র। গুলজারের ‘আঁধি’ ছবিতে সঞ্জীবকুমারের বিপরীতে তিনি— আরতি দেবী— এই রাজনৈতিক চরিত্রটিতে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া পড়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। রাজ কাপুর-সহ অনেক পরিচালক-প্রযোজক চেয়েছিলেন সুচিত্রা সেন বোম্বেতে আরও ছবি করুন। কিন্তু তিনি মনের মতো চরিত্র না পেলে করবেন না। ফলে বেশি হিন্দি ছবিতে তাঁকে আমরা পাইনি।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বর্ধিত পার্কিং ফি প্রত্যাহার পুরসভার

হলেন না সত্যজিতের দেবী চৌধুরানী
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে সত্যজিৎ রায় উদ্যোগী হয়েছিলেন।
নামভূমিকাতে সুচিত্রা সেনের কথা ভেবে। প্রযোজক প্রেমচাঁদ আঢ্যি-সহ সত্যজিৎ রায় সুচিত্রার বাড়িতে গিয়েছেন। কথাবার্তা এগিয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। সত্যজিতের তরফে শর্ত ছিল এই ছবিতে সুচিত্রা যখন কাজ করবেন, তখন অন্য কারও ছবিতে তিনি কাজ করতে পারবেন না। সেই শর্ত সুচিত্রা মেনে নিতে পারেননি, ফলে সত্যজিৎ-সুচিত্রা জুটির ‘দেবী চৌধুরানী’ আর তৈরিই হল না। হলে সে-ছবি বাংলা ছবির জগতে একটা মাইলস্টোন হলেও হতে পারত।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বর্ধিত পার্কিং ফি প্রত্যাহার পুরসভার

অধরা সুচিত্রা
একাধিক ছবিতে সুচিত্রা সেন অভিনয় করতে পারেননি ইচ্ছে থাকলেও। যেমন দীনেন গুপ্ত পরিচালিত ‘রোহিণী’ ছবিতে। দীনেন গুপ্ত ‘দেবী চৌধুরানী’র ব্যবসায়িক সাফল্য লাভের পর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর চিত্ররূপের জন্য তৈরি হলেন। যেহেতু ওই নামে কার্তিক চট্টোপাধ্যায় ছবি করছেন তাই নাম পরিবর্তন করে রাখা হল ‘রোহিণী’। রোহিণী চরিত্রের শিল্পী সুচিত্রা। সুচিত্রার ‘রোহিণী’ মুক্তি পেলে কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ দেখতে কে যাবেন? তাই ওই ছবির টেকনিশিয়ানরা সুচিত্রার কাছে সনির্বন্ধ আবেদন রাখলেন ‘রোহিণী’ ছবিতে অভিনয় না করার জন্য। আর তিনি একান্তই যদি অভিনয় করতে যান তবে টেকনিশিয়ানরা ফ্লোরের সামনে শুয়ে থাকবেন। তাঁদের উপর দিয়ে মাড়িয়ে যেতে হবে নায়িকাকে। এহেন অবস্থায় সুচিত্রা সিদ্ধান্ত নিলেন ‘রোহিণী’ ছবিতে অভিনয় না করার। প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রযোজনায় ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে তৈরি হলেন পরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রী। দামিনী চরিত্রে সুচিত্রা সেন। মহরতের দিনে দামিনী-রূপী সুচিত্রা কাজও করলেন। সেই ছবি তৎকালে বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মহরতের দিন রাত্রিবেলা হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় আত্মহত্যা করলেন। কী কারণে সে-রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে ছবিটির কাজ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। অরুন্ধতী দেবী ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের চিত্ররূপের জন্য তৈরি হলেন। নাম ভূমিকাতে সুচিত্রা সেন। স্ক্রিপ্ট সুচিত্রার পছন্দ হয়েছিল। সব যখন ঠিকঠাক তখন অরুন্ধতী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। সুচিত্রা-অরুন্ধতী-মহাশ্বেতা— এই ত্রয়ীর ‘হাজার চুরাশির মা’ আর তৈরি হল না। সমরেশ বসুর ‘নাটের গুরু’ নিয়ে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় অনেক দূর এগিয়েছিলেন। মুখার্জিদা ও তাঁর বউ কোনওদিন মনের দিক থেকে এক হতে পারেননি। তা নিয়ে দমফাটা হাসির গল্প। মিসেস মুখার্জির জন্য সুচিত্রা সেনকে নির্বাচন করলেন অরবিন্দবাবু। কে করবেন নায়কের চরিত্র? প্রথমে ঠিক ছিল উত্তমকুমার। কিন্তু উত্তম-সুচিত্রা জুটির শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’ ফ্লপ করায় সিদ্ধান্ত বদল করতে হল। ঠিক হল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এই জুটির রসায়ন ‘প্রণয়পাশা’ ছবিতে কাজ করেনি। সুচিত্রার ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল সঞ্জীবকুমারকে নিয়ে মুখার্জিদার চরিত্রে অভিনয় করানো। কমেডি চরিত্রে সঞ্জীবকুমার অসাধারণ। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অকালে চলে গেলেন সঞ্জীবকুমার। আর তৈরি হল না সুচিত্রাকে নিয়ে ‘নাটের গুরু’। এরকম অনেক ছবি— যেগুলোয় কাজ করতে গিয়েও অসফল হয়েছেন।

আরও পড়ুন-গুগলের দ্বারস্থ তদন্তকারীরা

ভিড় হতে নিভৃতে
নতুন পরিচালকদের কীভাবে উৎসাহ দিতেন তার দু-একটি নমুনার কথা বলি। ‘দেবদাস’ ছবি করার সময় বিমল রায়ের সহকারী হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়কে স্বনামে ছবি পরিচালনার উৎসাহ দিলেন তিনি। তার পরিণতিতে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘মুসাফির’-এর নায়িকাও হলেন। হরিদাস ভট্টাচার্যের সহকারী হিসেবে তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, শচীন মুখোপাধ্যায় কাজ করছেন। তাঁদের উৎসাহ দিলেন গোষ্ঠী তৈরি করে ছবি পরিচালনা করতে। সেই মতো তৈরি হল ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠী। যাত্রিকের প্রথম দুটি ছবিতেই নায়িকা সুচিত্রা সেন (চাওয়া পাওয়া, স্মৃতিটুকু থাক)। নিজের স্টার ইমেজ বজায় রাখতে তাঁর শ্যুটিং ফ্লোরের গেটের বাইরে সাইনবোর্ডে ঝোলানো থাকতো ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’। আউটডোর শ্যুটিংয়ে পারতপক্ষে যেতেন না। তাই ‘গৃহদাহ’ ছবির সেই বর্ষণমুখর দিনে রেলের কামরার দুরূহ দৃশ্য এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে সুচিত্রাকে যেখানে উত্তমকুমার তুলনা করছেন ‘পথে হল দেরি’ ছবিতে সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা সবই ফ্লোরেই তৈরি। ‘প্রণয়পাশা’ ছবিতে তাঁর শেষ অভিনয়ের পর থেকে জনসমক্ষে আসা তিনি ক্রমে ক্রমে কমিয়ে দিতে দিতে একেবারে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। অর্থ-যশের বিরাট মোহ থেকে কীভাবে নিজেকে উত্তীর্ণ করা যায় সুচিত্রা সেনের কাছ থেকে তা শিক্ষণীয়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘প্রিলিউড’ কাব্যগ্রন্থে নির্জনবাসের কথা বলা হয়েছে। তেমনই নিভৃতচারিণী হয়ে উঠেছিলেন সুচিত্রা সেন। ইংরেজি ছবির দুর্ধর্ষ নায়িকা গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা চলে। গ্রেটার শেষ ছবি ফ্লপ করার পর তিনি নিভৃতচারিণী হয়ে ওঠেন। কোনও কোনও সমালোচক তাঁকে ইনগ্রিড বার্গম্যানের সঙ্গে, কেউ-বা ক্যাথারিন হেপবার্নের সঙ্গেও তাঁর তুলনা করেছেন। এর মূল কারণ তিনি নিজের দাপট সর্বদা বজায় রেখে গিয়েছিলেন। জনসমক্ষে যেতে হবে বলে অনায়াসে তিনি ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন ভারত সরকারের সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার কিংবা বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি।

আরও পড়ুন-দেশে ফের ঊর্ধমুখী কোভিড সংক্রমণ

গায়িকা সুচিত্রা
মেগাফোন রেকর্ডে তাঁর গাওয়া দুটি গান বেরল। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়। গান দুটি হল ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণ আসবে কি’ এবং ‘বনে নয় আজ মনে হয় যেন রঙের আগুন প্রাণে লেগেছে’। সত্তরের দশকের শেষ দিকে রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের দশম অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজির কাছ থেকে দীক্ষা নেন। ভরত মহারাজের (স্বামী অভয়ানন্দ) খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন সুচিত্রা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বঙ্গবিভূষণ’ সুচিত্রার হয়ে গ্রহণ করেছিলেন কন্যা মুনমুন সেন।
উত্তমহীন ছবিতে সুচিত্রা
শুধু উত্তমকুমারের বিপরীতে তিনি স্বচ্ছন্দ। অন্য কোনও নায়ক চলে না— এ ধারণা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছেন সুচিত্রা। দীপ জেলে যাই, উত্তরফাল্গুনী, সাত পাকে বাঁধা, হসপিটাল, ফরিয়াদ, দত্তা— ইত্যাদি ছবিতে তাঁর প্রাণঢালা অভিনয়। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি শ্রেষ্ঠ নায়িকা নির্বাচিত হয়েছিলেন (১৯৬৩)।

আরও পড়ুন-কোভিড মোকাবিলায় তৎপর রাজ্য

শেষের মুহূর্তে
পরবর্তীকালে যখন তিন দশকের উপর তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে তখন সাধারণের মনে একটা প্রশ্নই ঘুরে ঘুরে আসত— তিনি কেমন আছেন, কী করেন, কেমন দেখতে হয়েছেন, কীভাবে সময় কাটান ইত্যাদি নানান প্রশ্ন। বাইরের লোকের কাছে প্রথম আবার দরজা খুললেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নার্সিংহোমে যখন তিনি জীবনমৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সেই সময় দেখতে এলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিদিন প্রায় দু-বেলা দেখতে যেতেন মুখ্যমন্ত্রী। কী চেহারা দেখেছিলেন সেকথা একটি বাংলা দৈনিকে তিনি লিখেও ছিলেন। তখন আমরা জানতে পারি যে, তাঁর চেহারা ছিল আগের মতোই আঁটোসাঁটো। বয়স ছাড়া ভাঙনের কোনও ছাপ ছিল না।

আরও পড়ুন-কর্মরত অবস্থায় মৃত বা শারীরিকভাবে অক্ষম সরকারি কর্মীর পোষ্যদের চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়া সরল করতে উদ্যোগ রাজ্যের

২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি শুক্রবার সকাল সাতটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে সুচিত্রার ব্যক্তিগত ডাক্তার সুব্রত মৈত্রের কাছে ফোন গেল অবস্থা খুব খারাপ। বোঝা গিয়েছিল কী ঘটতে চলেছে। পালস রেট কমছিল। সাড়ে সাতটা নাগাদ অচেতন সুচিত্রা। হৃদ্‌স্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় ওঠানামা করছে। মিনিট দশেকের জন্য কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত। আবার শ্বাসকষ্ট শুরু। কার্ডিও পালমোনারি কম্প্রেশন দেওয়া শুরু করা হয়। যদিও তা কাজে লাগেনি। সকাল আটটা বেজে ২৫ মিনিটে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় সুচিত্রা সেনের হৃদ্‌স্পন্দন। মহানায়িকার জীবনের শেষ মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন দুই জুনিয়র ডাক্তার শাশ্বত মুখোপাধ্যায় ও নির্মল কর। শুক্রবার সকালে মহানায়িকার জীবনস্পন্দন থেমে যাওয়ার মুহূর্তে ‘আইটিইউ ২০৭’ নম্বর কেবিনে এঁরা দুজন ছাড়া কেউ ছিলেন না। মহানায়িকার ইচ্ছে অনুযায়ী চন্দনকাঠের চিতায় তাঁকে দাহ করা হয়। তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু বাঙালির অন্তর জুড়ে তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। এমনই শাশ্বত চিরন্তন সুচিত্রা সেন।

Latest article