আলো দিন কালো দিন
ব্রাহ্মণবেড়িয়ার গোকর্ণ। গ্রামটির অবস্থান পূর্ববঙ্গে, তিতাস নদীর ধারে। মূলত ধীবর সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রায় প্রত্যেকেই দরিদ্র। আলো ফুটতে না ফুটতেই ভেসে যায় নৌকা নিয়ে। ফেরে আলো ফুরোলে। নৌকায় যত বেশি মাছ, ঘরে তত আনন্দ। যদিও রোজদিন একরকম যায় না। কোনওদিন আলো তো কোনওদিন কালো।
আরও পড়ুন-রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, এক ট্র্যাজিক মহানায়কের ইতিহাস
এমনই একটি ধীবর পরিবারে জন্ম অদ্বৈত মল্লবর্মণের। ১৯১৪-র ১ জানুয়ারি। হতদরিদ্র পরিবার। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। অদ্বৈত সকলের নয়নের মণি। বাড়ির তো বটেই। পাড়ারও। চোখে মুখে অদ্ভুত মায়া। না ভালবেসে পারা যায় না। অভাবের মধ্যেই কোনও কোনও দিন খুদকুঁড়োর সংসারে সুখের ঢেউ ওঠে। সেটাও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। সন্ধে নামার মতো। অদ্বৈত শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন। একে একে চলে যায় বাকি তিন ভাই-বোন। জগৎসংসারে একেবারে একা অদ্বৈত। মেধাবী ছাত্র। পড়াশোনায় প্রবল আগ্রহ। কিন্তু টাকা নেই। বইখাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়-হয়। সেইসময় পাশে দাঁড়ায় ধীবর সম্প্রদায়। দূর হয় সমস্যা। শুরু হয় অদ্বৈতর পড়াশোনা। স্কুলের পাঠ শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে। কিন্তু চরম দারিদ্র্যের কারণে অসম্পূর্ণ থেকে যায় কলেজের পাঠ। যেভাবেই হোক রোজগার করতে হবে।
কলকাতায় সাংবাদিকতা
আরও পড়ুন-বিশ্ব পিতা তুমি হে প্রভু
নদীভেজা গ্রামের ছেলে। কাজের আশায় পাড়ি দিলেন কলকাতা। অচেনা অজানা শহর। বড় বড় বাড়ি, রাজপথে গাড়ি। মানিয়ে নিতে সমস্যা। ছোটখাটো ঝড়-ঝাপটা সামলাতে সামলাতে একদিন জুটিয়ে নিলেন কাজ। ‘মাসিক ত্রিপুরা’ পত্রিকায়। শুরু করলেন সাংবাদিকতা। অল্প কিছুদিন পর যোগ দিলেন নরেন দত্তের ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়। সম্পাদক ছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকাটির ঝাঁপ বন্ধ বন্ধ হয়ে যায়। তখন যোগ দেন মওলানা আকরাম খাঁয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। এ-ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন ‘দৈনিক আজাদ’, ‘নবযুগ’, ‘কৃষক’, ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়। বিশ্বভারতীর প্রকাশনা শাখায় কিছুদিন কাজ করেছেন। সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই কেটেছে তাঁর জীবন।
আরও পড়ুন-রাহানে-ঝড়ে হেলায়, মুম্বই জয় সিএসকের
সাহিত্যচর্চা
সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা স্কুলজীবন থেকেই। পড়তে ভালবাসতেন গল্প-কবিতা। মনে মনে ভাবতেন, চেষ্টা করলে আমিও হয়তো লিখতে পারব। ব্রাহ্মণবেড়িয়ার মাইনর স্কুলে পড়ার সময়েই সাহিত্যে হাতেখড়ি। লেখেন কবিতা। হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় সেই লেখা ছাপাও হয়ে যায়। বেড়ে যায় উৎসাহ। মোট ১৪টি কবিতা লিখেছেন। প্রতিটিতেই এসেছে নিজের বিচিত্র জীবনের বয়ান।
কবি থেকে গল্পকার
বেশ কিছুদিন কবিতা লেখার পর গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘সন্তানিকা’। লিখেছিলেন ত্রিশের দশকের শেষভাগে। কেউ কেউ বলেন প্রথম গল্পটিতে যেন তাঁর নিজের জীবনেরই একটি কাহিনির বয়ান করেছেন। চল্লিশের দশকের প্রথম ভাগ। অদ্বৈতর গল্প ছাপা হয় বুদ্ধদেব বসুর ‘এক পয়সার একটি গল্প’ সিরিজে। তাঁর অসামান্য গদ্য নজরে আসে বৃহত্তর পাঠক সমাজের। তাঁকে বলা যায় সময় কিংবা কালের প্রতিনিধি। যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী দলের সঙ্গে। তাঁর নানা লেখায় উঠে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। তুলে ধরেছেন হিটলারের তাণ্ডব। সংক্ষিপ্ত জীবনে লিখেছেন মাত্র ৫টি গল্প। শেষ লেখা গল্প ছিল ‘স্পর্শদোষ’। তিনি একজন অনুসন্ধানী গবেষকও ছিলেন। তাঁর লেখা ২৪টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
নানা রঙের গান
মাঝিমাল্লার গান শুনতে শুনতেই বেড়ে ওঠা। নদীর জলে ওঠানামা খেলা করত তাঁর মনে। গ্রাম থেকে দূরে সরে গেলেও ফেলে আসা সুর থেকে গিয়েছিল কানে। সেখান থেকেই তাঁর মনে জন্ম নেয় গান লেখার ইচ্ছে। লিখেছেন নানা রঙের গান। পল্লিগীতি, ত্রিপুরার বারোমাসি গান, সীতার বারোমাসি, পালা গান। পুতুল-বিয়ের ছড়া সংগ্রহের মাধ্যমে নানা গ্রাম্যপালা ও গান পরম মমতায় তুলে এনেছেন। স্থান দিয়েছেন পত্রিকা ও পাণ্ডুলিপির পাতায়। নিখুঁত বয়ানে উপস্থাপন করেছেন প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির স্বর্ণভাণ্ডারকে। অদ্বৈতর ‘বর্ষা মঙ্গল’, ‘আম্রতত্ত্ব’ প্রভৃতি লেখাগুলো পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন-ভারত সফরে আসছেন ইউক্রেনের উপ-বিদেশমন্ত্রী
তিতাস একটি নদীর নাম
লিখেছেন উপন্যাস। নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনচর্চা, সংগ্রামকে পরম যত্নে সাহিত্যের পাতায় তুলে এনেছেন। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। গদ্য-উপন্যাস হলেও লেখাটি কবিতার মতোই। লেখায় উঠে এসেছে ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষের কাহিনি। এই জীবন তাঁর নিজের জীবন। চরিত্ররা তাঁর আত্মার আত্মীয়। তাই কোনও অংশ আরোপিত মনে হয় না। উজাড় করেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি। উপন্যাসে ধীবরসমাজের নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রামের সাধারণ কাহিনিকে দিয়েছেন অসাধারণ এক মাত্রা। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর ভূমিকাংশে লিখেছিলেন, ‘কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।’
আরও পড়ুন-নাম না করে ফের মোদিকে ভুয়ো ডিগ্রি তোপ কেজরির
উধাও পাণ্ডুলিপি
‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। তবে প্রথম কয়েক কিস্তি প্রকাশের পরে উপন্যাসের মূল পাণ্ডুলিপি রসহ্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণে বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশ। তখন পাঠকরা উপন্যাসের বাকি অংশ প্রকাশের দাবি জানাতে থাকেন। সকলের অনুরোধে উপন্যাসটি শেষ করতে বাধ্য হন অদ্বৈত। এর মধ্যে তিনি আক্রান্ত হন যক্ষ্মায়। হাসপাতালে যাওয়ার সময় উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি বন্ধুদের হাতে তুলে দেন। ১৯৫১-র ১৬ এপ্রিল মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কয়েক বছর পর, ১৯৫৬ সালে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিককুমার ঘটক ১৯৭৩ সালে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে ছবি তৈরি করেন।
আরও পড়ুন-দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষা না নেওয়ার প্রস্তাব
আরও উপন্যাস
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন ‘সাদা হাওয়া’, ‘রাঙামাটি’ নামের আরও দুটি উপন্যাস। যদিও এর কোনওটাই তাঁর জীবিতকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। আর্ভিং স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’ থেকে অনুবাদ করেছিলেন ‘জীবনতৃষ্ণা’। লেখাটি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন অকৃতদার। উপার্জন করেছেন সামান্য। বিলিয়ে দিতেন দুঃস্থদের মধ্যে। নেশা ছিল বই কেনার। সংগ্রহ করেছেন সাহিত্য, দর্শন ও চারুকলা-বিষয়ক বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বই। তাঁর মৃত্যুর পর রামমোহন লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের কাছে যাবতীয় বইপত্র তুলে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-ব্যর্থ ব্যাটিং, টানা তৃতীয় হার দিল্লির
সাহিত্যিকদের চোখে
একটি সাক্ষাৎকারে সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস বলেছিলেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ জেলে জীবনের পাঁচালি। শুধু ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কেন, পরে ‘গঙ্গা’, ‘গহিন গাঙ’, ‘গঙ্গা একটি নদীর নাম’, ‘অবগাহন’— এসব জেলে জীবনভিত্তিক যে-যে উপন্যাস রচিত হয়েছে, এদের কোনওটিই তিতাসের সমতুল্য নয়। নদীপাড়ের কৈবর্তজীবনের অনুপুঙ্খ দলিল বলা যেতে পারে তিতাসকে। আমার মতে, অদ্বৈতের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস এখনও একক এবং তুলনাহীন।
আরও পড়ুন-মহিলাদের পোশাক বিতর্কে কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, তুলনা টানলেন শূর্পণখার সঙ্গে, প্রতিবাদ তৃণমূল কংগ্রেসের
সাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ খুব বেশি গল্প-উপন্যাস লিখেছেন তা নয়। কিন্তু ওঁর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অহংকার। তিতাস নদীর পাড়ের জেলেদের জীবন নিয়ে লিখেছেন। ওই অঞ্চলে উনি জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন। তাই ওই সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনযাপন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অনেক সময় বলা হয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝি সম্প্রদায়ের না হয়েও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ লিখেছেন। পুরোটাই জেনেশুনে লেখা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন নিজের জীবনবৃত্তান্ত। দুটি লেখাই দু’রকম ভাবে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।