বিশ্ব পিতা তুমি হে প্রভু

গুড ফ্রাইডে অর্থাৎ পুণ্য শুক্রবার। কেউ কেউ আবার এই দিনটিকে পবিত্র শুক্রবার অথবা মহান শুক্রবারও বলে থাকেন। তেত্রিশ খ্রিস্টাব্দের সেই পুণ্য শুক্রবারে আমাদের পরম পিতা যিশু খ্রিস্ট মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর তাঁর মৃত্যুকে স্মরণ করতেই গোটা বিশ্বে পালন করা হয়ে থাকে গুড ফ্রাইডে। লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

তেত্রিশ খ্রিস্টাব্দের এক শুক্রবার। জেরুজালেমের ক্যালভারিতে এই দিনটিতে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। তবুও এই দিনটি পরিচিতি পায় গুড ফ্রাইডে হিসেবে। আসলে খ্রিস্টধর্মাবলীদের বিশ্বাস এই দিনটি দুঃখের হলেও অত্যন্ত পবিত্র একটি দিন, কারণ এই দিনটিতেই মানবজাতির স্বার্থে, সাধারণ মানুষজনের জীবন রক্ষা করতেই আত্ম বলিদান দিয়েছিলেন পরম পিতা যিশু খ্রিস্ট। যিশু খ্রিস্টের অন্যতম শিষ্য জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁকে কাঁটার মুকুট পরে ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন-রাহানে-ঝড়ে হেলায়, মুম্বই জয় সিএসকের

পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি—
সে সময় চারিদিকে পাপ আর অন্যায় অত্যাচারে ভরে উঠেছিল। আর এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলেন যিশু। তিনি সবাইকে শান্তির বার্তা দিতে শুরু করেছিলেন, বলেছিলেন মানবতাই পরম ধর্ম। আর তাঁর এই প্রচারের বিরুদ্ধে খেপে উঠেছিলেন ইহুদি ধর্মীয় নেতারা। তাঁরা যিশুর বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই সময় রোমান গভর্নমেন্ট ছিলেন পিলাত। এই ইহুদি ধর্মীয় নেতারা পিলাতের কাছে যিশুকে সাজা দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। সাজা দেওয়ার আবেদন জানানোর পর পিলাত ইহুদি সমাজপতিদের এই আবেদন মঞ্জুর করেন এবং তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী যিশু খ্রিস্টের বিচার ও শাস্তিদানের অনুমতি প্রদান করেন। আর এই বিচার সভায় যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এরপরে প্রভু যিশুর অন্যতম শিষ্য জুডাস এর সহযোগিতায় গেতশিমানি উদ্যান থেকে যিশুকে গ্রেফতার করে সৈন্যদল। যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পুরস্কারস্বরূপ ইহুদি সমাজপতিদের কাছ থেকে ৩০টি রৌপ্য পেয়েছিল জুডাস। সৈন্যদলের কেউই যিশু খ্রিস্টকে চিনত না। জুডাস তাদের বলে রেখেছিল যার গালে সে চুম্বন করবে সেই যিশু। কথামতো জুডাস যিশুর গালে হালকা চুম্বন করে। এবং তার পরেই সৈন্যদল প্রভু যিশুকে ধরতে সক্ষম হয়।

আরও পড়ুন-বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় : সুদীপ

শেষ ভোজসভায়—
লাস্ট সাপার অর্থাৎ শেষ ভোজ বা অন্তিম ভোজ। সেই ভোজসভায় যিশু খ্রিস্ট তাঁর ১২ জন শিষ্যকে নিয়ে একটি বড় টেবিলে শেষ নৈশভোজ সারতে বসেন। সেই ১২ জন প্রাণাধিক শিষ্য হচ্ছেন বার্থোলোমিউ, জেমস, অ্যান্ড্রূ, জুডাস ইস্কারিয়ট, পিটার, জন, টমাস, জেমস (বড়), ফিলিপ, ম্যাথু, জুড আর সাইমন৷ এই অন্তিম ভোজে যিশু তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে বসে রুটি খান এবং মদ্যপান করেন। আর এই নৈশভোজ চলাকালীনই প্রভু যিশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন তাদের মধ্যেই একজন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার একজন অন্যতম প্রিয় শিষ্য তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এবং সেই শিষ্যই তাঁকে তুলে দেবে ইহুদি রক্ষীদলের হাতে।

আরও পড়ুন-৮ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ৮০ লক্ষ মহিলা কর্মীকে ঋণ এবং পরিশোধ, আবার রাজ্যের রেকর্ড

প্রিয় শিষ্য জুডাসই ধরিয়ে দিলেন প্রভু যিশুকে—
অন্তিম নৈশভোজ শেষ করার পর ১২ জন শিষ্য নিয়ে প্রভু যিশু হাজির হয়েছিলেন জেরুজালেমের গেতসেমানে উদ্যানে। শুধু তাঁরা নন সে সময় আরও একটি দল হাজির হয়েছিল সেই উদ্যানে। প্রভু যিশু ছাড়া বাদবাকি সকলের মনই অজানা বিপদের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিল। আর এদের মধ্যে জুডাস ছিল অন্যতম। তবে জুডাসের মন অজানা আতঙ্কে আতঙ্কিত ছিল না, সে সুযোগ খুঁজছিল উপস্থিত ইহুদিরক্ষীদের হাতে যিশুকে তুলে দেওয়ার জন্য। তার ভয় ছিল সে ঠিক মতন এই কাজটি সারতে পারবে কিনা তার জন্য। হঠাৎ করেই জুডাস এসে প্রভু যিশুর গালে চুম্বন করে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্যানের মধ্যে অনেকগুলো আলো জ্বলে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রভু যিশুর শিষ্যদের চোখে পড়ে ইহুদি রক্ষীদল দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে জুডাস কেন প্রভু যিশুর গালে চুম্বন করেছিল তার কারণ অন্য শিষ্যরা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন। চুম্বনটা যে সংকেত ছিল সেটাও তাঁরা বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন যে জুডাস সেই শিষ্য যার কথা প্রভু যিশু অন্তিম ভোজপর্বে বলেছিলেন। যখন যিশুকে সৈন্যদল ধরতে আসে তখন তাঁর শিষ্যরা রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের বাধা দেন যিশু। তিনি নিজেই সৈন্যদলের হাতে ধরা দেন। আগের থেকে সব কিছু জানার পরেও তিনি কোনও কিছুতে বাধা দেননি।

আরও পড়ুন-৮ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ৮০ লক্ষ মহিলা কর্মীকে ঋণ এবং পরিশোধ, আবার রাজ্যের রেকর্ড

এরপর বসল বিচারসভা—
প্রভু যিশুকে গ্রেফতার করার পর সৈন্যদল তাঁকে নিয়ে আসে রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাতের কাছে। প্রভু যিশুর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ সেখানে দায়ের করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে যিশু নাকি নিজেই নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করেছেন আর এটা নাকি রোমান সম্রাট সিজারের অপমান। যিশুর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন পিলাত। দীর্ঘ সময় কথা বলার পরেও পিলাত কিন্তু প্রভু যিশুর কোনও দোষই খুঁজে পাননি। পিলাত দোষ খুঁজে না পেলেও বিচারসভার বাইরে তখন জনতা রীতিমতো রাগে ফুঁসছে, তাদের দাবি যিশুকে শাস্তি দেওয়া হোক, তাদের দাবি ক্রুশবিদ্ধ করা হোক তাঁকে। জনতার দাবি মেনে নিয়ে পিলাত যিশুকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

আরও পড়ুন-বৃদ্ধির হার নামবে ৩ শতাংশের নিচে, পূর্বাভাস আইএমএফের

পিতঃ, ইহাদিগকে ক্ষমা কর; কেননা ইহারা কী করিতেছে তাহা জানে না—
শাস্তি প্রদানের পরে যিশুর ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে শুরু করে রোমান সেনারা। প্রথমে চাবুক দিয়ে তাঁর সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়। সারা গা ফালা ফালা হয়ে যায় চাবুকের আঘাতে। এরপর রোমান সৈন্যরা যিশুর মাথায় পরিয়ে দেয় কাঁটার মুকুট। সেই মুকুটের কাঁটা যিশুর মাথায় গেঁথে যায় এবং সেখান থেকে রক্তধারা মুখমণ্ডল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। এতেও ক্ষান্ত হয় না রোমান সৈন্যদল। যিশুর মুখমণ্ডলেও আঘাত করে এবং এরপর তাঁর কাঁধে তুলে দেওয়া হয় ক্রুশকাঠ। নিজের ক্রুশকাঠ বধ্যভূমি অবধি বহন করে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় প্রভু যিশুকে। জেরুজালেমের গলগথ পাহাড়ের সেই বধ্যভূমিতে প্রভু যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ক্রুশের সঙ্গে দুই হাত আর দুই পা পেরেকবিদ্ধ করে দেয় রোমান সেনারা। ছ ঘণ্টা ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন প্রভু যিশু। তারপর আকাশ কালো করে নেমে এসেছিল মৃত্যু। মৃত্যুর সময় যিশুর মুখ থেকে বেরিয়েছিল সাতটি পরম বাণী তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—
‘‘পিতঃ, ইহাদিগকে ক্ষমা কর; কেননা ইহারা কী করিতেছে তাহা জানে না”।

আরও পড়ুন-পরপর দু’দিন আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়াল

মনে করা হয় প্রভু যিশু যে দিনটিতে মারা গিয়েছিলেন সেই দিনটি শুক্রবার ছিল। আর তাই আজও গোটা পৃথিবী জুড়ে গুড ফ্রাইডে পালন করা হয়ে থাকে।
কেন গুড ফ্রাইডে বলা হয়—
গুড ফ্রাইডে পরম পিতার মৃত্যুদিন হয়েও কেন গুড বা পুণ্য বলা হয়ে থাকে এই প্রশ্নটা আমাদের সবার মনের মধ্যেই উঁকি দেয়। গুড ফ্রাইডেকে গুড ফ্রাইডে বলার কারণ হিসেবে মনে করা হয় এই দিনটিতেই যিশু খ্রিস্ট নিজের ওপরে পৃথিবীর সাধারণ মানুষজনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের বোঝা বহন করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সেই দুঃখ-কষ্টের বোঝা তিনি বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এর ফলে পৃথিবীবাসীর ভাল করে গিয়েছিলেন তিনি। আর তাই এই মৃত্যু যেমন দুঃখের ছিল ঠিক তেমনি এই মৃত্যু ছিল মুক্তিরও।
তবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার তিন দিন পরে প্রভু যিশু পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসেন। আর এই দিনটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছে খুবই আনন্দের ও তাৎপর্যপূর্ণ। যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান তথা নবজন্মকে স্মরণ করতে দেবী ইয়োস্ত্রের নাম অনুসারে দিনটির নাম রাখা হয় ইস্টার।

আরও পড়ুন-মাঝ-আকাশে দরজা খোলার চেষ্টা বিমানযাত্রীর

এই ইস্টারের দিন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ডিম সাজান এবং কাউকে সেদিন কোনও জিনিস উপহারস্বরূপ দিলেও তার মধ্যে ডিম থাকে। ডিম দেওয়ার কারণস্বরূপ যেটা জানা যায় সেটা হল, তাঁরা মনে করেন ডিম ফুটে যেমন একটি নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনি মানুষের কাছেও একটা নতুন করে শুরু করার বার্তা দেয় এই ডিম।
তাঁরা আরও মনে করেন গুড ফ্রাইডের দিন মানবজন্ম থেকে প্রভু যিশু সকল পৃথিবীবাসীর দুঃখ ও ব্যথা-বেদনা নিজে বহন করে মৃত্যুবরণ করে সমস্ত রকমের জাগতিক বাধা থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন আর এই ইস্টারের দিন তিনি আবার এই ধরাধামে জেগে উঠেছিলেন।

Latest article