নারকেল গাছে তীরের মতো বিঁধে আছে ধানঝাড়ার কুলো।
পুকুরের সব জল মাছশুদ্ধ ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে একেবারে ডাঙা জমিতে আছড়ে পড়ে।
ধানের গোলা উড়ে গেছে— অন্যত্র চারপাশে শুধু ধান আর ধান।
ঘরের মাটির দেয়াল চাপা পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। ভাত খাচ্ছিল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাতের থালা।
চারপাশে যতদূর চোখ যায় উপড়ে যাওয়া বড় বড় গাছ… ছড়িয়ে থাকা টালির চাল, লন্ডভন্ড ঘরের জিনিসপত্র।
আরও পড়ুন-প্রবল তাপপ্রবাহে ইউরোপে মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে ২০২২, চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট
উপরের বিধ্বংসী চিত্রকল্প বর্ণনাগুলো সবই গাইঘাটা টর্নেডোর। সালটা ১৯৮৩, ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার। সন্ধে ৭টা নাগাদ, আকাশে ঘন কালো মেঘ, হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলক ও কানফাটানো আওয়াজ, মনে হচ্ছিল আকাশ মাটির দিকে নেমে আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ২৭ জনের মৃত্যু, আহতের সংখ্যা অগুন্তি। ১২টি জেলার প্রায় ৬০০০ মানুষ গৃহহারা। টর্নেডোটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে আরও ৩১ জনের প্রাণ নেয়।
একই রকমভাবে ১৯৭৮ সালের ১৭ এপ্রিল ওডিশার কেওনঝড়ের টর্নেডোতে মৃত ১০০ ও আহত ৫০০ জন মানুষ। ইদানীং কালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে ভয়ানক টর্নেডো হয় ২৬ এপ্রিল ১৯৮৯ বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলাতে। মৃত্যু ১৩০০ জন মানুষের। আহত ১২০০০ জন মানুষ।
আরও পড়ুন-নারীরাই উচ্ছেদ করবে বিজেপিকে
ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সংবাদমাধ্যমের তৎপরতায় মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জায়গায় টর্নেডোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। দিন কয়েক আগে হলদিয়াতেও দেখা গেল টর্নেডো। যদিও খুবই ছোট আকৃতির। সাইক্লোন ইয়াস-এর পরেও এইরকম টর্নেডো হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন ছোট বা বড়র নয়, প্রশ্ন হচ্ছে টর্নেডোর সংখ্যা বৃদ্ধির।
টর্নেডো কী?
সাইক্লোনও থান্ডারস্ট্রম-এর মতো বায়ুমণ্ডলের উলম্ব দিকে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার বাতিক্রান্ত প্রভাবের জন্য হয়। ভূপৃষ্ঠের কোনও বস্তুকে নিমেষে ভয়ানক মোচড় দিয়ে উপরে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা খুব বেশি। টিউবওয়েল, বিদ্যুৎস্তম্ভ, নারকেল গাছ ইত্যাদিকে মুচেড়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। টর্নেডোর ব্যাস ১ মিটার থেকে ১ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। জলে ও স্থলে সমান ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা রাখে। নিমেষে একটি পুকুর বা লেকের সমস্ত জল তুলে অন্য জায়গায় ফেলে দিতে পারে। সমুদ্রের ওপর ঘটলে হাতির শুঁড়ের মতো জলস্তম্ভ তৈরি হয়।
পৌরাণিক মনসামঙ্গল কাব্যে (চাঁদ সওদাগর উপাখ্যানে) কমলে কামিনী ও সপ্তডিঙি ধ্বংসলীলার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এটিও টর্নেডোর পৌরাণিক বিবরণ।
আরও পড়ুন-শচীন-লারার নামে সিডনি মাঠের গেট
টর্নেডো-প্রবণ জায়গা
কানাডা ও উত্তর আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশের সঙ্গে পূর্ব ভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল টর্নেডো-প্রবণ। সমতলে ফ্রন্টাল উইন্ড ও সমতল থেকে ৬—১০ কিলোমিটার উপরে পোলার জেটস্ট্রিম-এর সহায়তায় কানাডা ও উত্তর আমেরিকার প্রদেশগুলিতে ঘন ঘন ভয়ানক বিধ্বংসী টর্নেডো হয়। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ফ্রন্টাল উইন্ড ও ৮ কিমি থেকে ১১ কিমি উপরে সাব-ট্রপিক্যাল জেটস্ট্রিম মান অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় টর্নেডোর প্রাদুর্ভাব কম।
টর্নেডো-প্রবণ সময়
উত্তর গোলার্ধে টর্নেডো-প্রবণ সময় এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত। খুব অল্প আর্দ্রতা থাকলেও টর্নেডো হতে পারে।
আরও পড়ুন-ওঁকারধাম শিবমন্দিরে পুজো দেবেন অভিষেক
টর্নেডোর গঠন
যে-কোনও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য আর্দ্রতা ও তাপের প্রয়োজন। এই জুটি কোনও বিশেষ অবস্থায় বায়ুমণ্ডলের উলম্ব দিকে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। বায়ুমণ্ডলের যে উচ্চতায় জলীয়বাষ্প থেকে জলকণায় পরিণত হয় (কন্ডেন্সেশন লেভেল), সেখানে প্রচুর তাপের উদ্ভব হয়। বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্প উত্তরোত্তর উলম্ব দিকে কন্ডেন্সেশন লেভেলের ওপরে জলকণায় পরিণত হয় আর তাপমাত্রা বাড়িয়ে যেতে থাকে আর পরবর্তী জলীয়বাষ্পের ঊর্ধ্বগতিকে তরান্বিত করে। অর্থাৎ, এই অবস্থায় যত উপরে যাওয়া যাবে, তত তাপমাত্রা বাড়বে। যা স্বাভাবিকের বিপরীত।
আরও পড়ুন-নারীরাই উচ্ছেদ করবে বিজেপিকে
জলীয়বাষ্প না থাকলে এটি ঘটবে না। কাজেই জলীয়বাষ্প ইঞ্জিনের জ্বালানির মতো কাজ করে। কোনও বস্তুকে বায়ুমণ্ডলের উপরে তুলে দিলে তা আবার নিচে চলে আসে। এটি হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের স্থিরতা। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আর কোনও বস্তুকে বায়ুমণ্ডলের উপরে তুলে দিলে সেটা যদি বায়ুমণ্ডলের আরও উপরে চলে যায়, তখন তাকে বলে বায়ুমণ্ডলের অস্থিরতা। টর্নেডোতে ভয়ানক ঊর্ধ্বমুখী গতিতে এই ঘটনা ঘটে। আর অবশ্যই এই ‘বস্তুটি’ হচ্ছে আর্দ্রতা বা জলীয়বাষ্পের পরিমাণ। দুর্ভাগ্যবশত এই ঊর্ধ্বমুখী গতির মান এখনও পর্যন্ত মাপা যায়নি। এই ঊর্ধ্বমুখী গতির মানের উপর নির্ভর করবে ঘটনাটি সাইক্লোন, থান্ডারস্ট্রম না টর্নেডো-তে পরিণত হতে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের এই উলম্ব অস্থিরতা, প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন অনুভূমিক শুষ্ক (ঠান্ডা) বাতাস ও আর্দ্র (উষ্ণ) বাতাসের সংঘর্ষেও হতে পারে। এর ব্যাখ্যা গণিতের ভেক্টর ক্রস প্রোডাক্ট-এর সাহায্যে দেওয়া হয়। যেহেতু পরিবেশদূষণ জলীয় বাষ্পকেও দূষিত করবে, তাই দূষণের ফলে বায়ুর ঊর্ধ্বগতির তারতম্য হওয়া ও তা থেকে টর্নেডো তরান্বিত হওয়া একটি গবেষণার বিষয়। টর্নেডো গঠনের সময়, বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে অভিন্নতা (কনভার্জেন্স) ও উপরের স্তরে বিচ্যুতি (ডাইভার্জেন্স) থাকা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন-অভিষেকের জনসংযোগ যাত্রা, চাপ বাড়ছে বিরোধী শিবিরে
ফুজিতা স্কেল
টর্নেডো বিভিন্ন গতির ও বিভিন্ন রকম চওড়া হতে পারে। প্রায় ৪০ বছর ধরে গতি ও ধ্বংসলীলা দেখে আমেরিকাতে টর্নেডোর ফুজিতা স্কেল ব্যবহার হচ্ছে। ড. থিওডোর ফুজিতা প্রথম প্রণয়ন করেন।
গতি ১১০-১৮৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা— দুর্বল।
১৮৬ থেকে ২৮০ কিমি প্রতি ঘণ্টা— শক্তিশালী।
২৮১ থেকে ৩৪০ কিমি প্রতি ঘণ্টা— বিধ্বংসী।
এই গতি বুফর্ট স্কেল পদ্ধতি থেকে নির্ণয় করা হয়।
আরও পড়ুন-‘মানুষ নিজেদের প্রার্থী নিজেরাই বেছে দিতে পারবেন’ নির্বাচনের আগেই পথ দেখালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্বাভাস
যেহেতু অল্প সময়ের দুরন্ত ঘটনা, তাই এর গাণিতিক পদ্ধতি এখনও কার্যকর হয়নি। তবে মোবাইল ডপলার রেডার ও উপগ্রহচিত্র থেকে গতিবিধি ও অবস্থান জানা যায়, সেই অনুযায়ীই মানুষকে সতর্ক করা সম্ভব। আলিপুরে হাওয়া অফিসে একটি মোবাইল ডপলার SODAR আনা হয়েছিল থান্ডারস্ট্রম ও টর্নেডো অনুসরণের জন্য।